Select Page

বৃহত্তর সিলেটের আরেক নাম এম. সাইফুল রহমানের ১২’তম মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।

বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশের সফল অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী এম. সাইফুর রহমান ৬ অক্টোবর ১৯৩২ সালে বর্তমান মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বাহারমর্দন গ্রামে পিতা শিক্ষানুরাগী আব্দুল বাসিত ও মাতা তালেবুন্নেছার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
শিক্ষা জীবনে এম. সাইফুর রহমান গ্রামের মক্তব ও পাঠশালা শেষ করে তিনি ১৯৪০ সালে জগৎসী গোপালকৃষ্ণ ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তারপর মৌলভীবাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে লেখাপড়ার পর দি এইডেড হাই স্কুল থেকে ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৫১ সালে সিলেট মুরারী চাঁদ (এম.সি) কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে তিনি ১৯৫২’র মহান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় প্রতিবাদী ভূমিকার জন্য গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.কম ডিগ্রী অর্জন করে লন্ডনে চলে যান। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত লন্ডনে অধ্যায়ন করেন এবং দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস (আইসিএইডাব্লিউ) থেকে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট (সিএ) ডিগ্রী অর্জন করেন।

এম. সাইফুর রহমান সফল শিক্ষা জীবন শেষে ১৯৫৯ সালে ব্রিটিশ অক্সিজেন কোম্পানীতে উচ্চ বেতন ও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাসহ চাকুরীতে যোগ দিয়ে বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের শুভ সূচনা করেন। পাকিস্তানের করাচীতে নূতন কর্মস্থলে যোগ দেন কর্মবীর এম. সাইফুর রহমান। ব্রিটিশ অক্সিজেনের উচ্চ বেতনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসাবে পাকিস্তানের রাজধানী করাচীতে অবস্থান ও উচ্চ মহলের সঙ্গে চলাফেরা উঠাবসা করে এম. সাইফুর রহমান বাঙ্গালীদের প্রতি পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিমাতা সুলভ হিংসাত্মক আচরণে মনে কষ্ট পান। ব্যতিত ও মনঃক্ষুণ্ণ হন। তাই বিলাসী জীবন ত্যাগ করে বিশ্ব বিখ্যাত কোম্পানীর উচ্চ বেতনের চাকুরী ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন। তারপর ১৯৬২ সালে তিনি ইংল্যান্ডে অ্যাডভান্সড ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে আর্থিক ও মুদ্রানীতি এবং উন্নয়ন অর্থনীতিতে বিশেষায়িত শিক্ষা গ্রহণ করেন।

১৯৬২ সালে তার দুইজন সহকর্মীকে নিয়ে তিনি ”রহমান রহমান হক এন্ড কোম্পানী” নামে একটি নিরীক্ষা ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন। পেশার প্রতি আনুগত্য ও কঠোর পরিশ্রমের ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে রহমান রহমান হক এন্ড কোম্পানী সমগ্র পাকিস্তানের মধ্যে সর্ববৃহৎ একাউন্টেন্সী অডিট ফার্ম হিসাবে খ্যাতি ও স্বীকৃতি অর্জন করে, যা চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে তার কৃতিত্বের স্মারক হয়ে আছে।

এম. সাইফুর রহমান ১৯৬২ সালে কর্মজীবন শুরু করে ১৯৬৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় বেতন কমিশনে প্রাইভেট সেক্টর হতে একমাত্র সদস্য মনোনীত হন। স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় বেতন কমিশনেরও সদস্য ছিলেন।
এরই মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশাল মন্ত্রীসভার বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মুশতাক আহমদের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ও আশ্রয় প্রশ্রয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মম ভাবে হত্যা করলে দেশে এক প্রকট রাজনৈতিক সংকট ও শূন্যতা দেখা দেয়। ১৯৭৫ পরবর্তী দেশীয় রাজনীতির সংকট ও শূন্যতার মাঝে দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এম. সাইফুর রহমানকে অনুরোধ করেন সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপ প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীরউত্তম।
জিয়াউর রহমানের অনুরোধ ও অনুপ্রেরণায় ১৯৭৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম এর মন্ত্রীসভায় বাণিজ্য উপদেষ্টা হিসাবে যোগদান করে জাতীয় রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করেন এম. সাইফুল রহমান। ১৯৭৭ সালে তিনি জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। যা পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপিতে রূপান্তরিত হয়। এর আহবায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন এম. সাইফুল রহমান, যার আহবায়ক ছিলেন রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মৌলভীবাজার- ৩ আসন থেকে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি প্রথমে বাণিজ্যমন্ত্রী ও পরে অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পরও তিনি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের মন্ত্রীসভায় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে বহাল ছিলেন।
১৯৮২ সালে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের কাছ থেকে স্বৈরশাসক এরশাদ ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করলে বিএনপির শীর্ষনেতাদের সাথে তিনিও গ্রেফতার হন। তারপর ৯০’এর ছাত্র ও গণ আন্দোলনে স্বৈরশাসক এরশাদের পতন হলে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মন্ত্রীসভায় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থী হিসেবে সিলেট- ৪ আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থী হিসেবে মৌলভীবাজার-৩ ও সিলেট-৪ আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থী হিসেবে তিনি সিলেট-১ ও মৌলভীবাজার- ৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় মন্ত্রিসভায় অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশে মুক্ত বাজার সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রবর্তক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত ছিলেন। সবচেয়ে বেশি সময়কাল ধরে তিনি বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন এবং মোট ১২ বার জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করে বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড তৈরী করেন। বিএনপির সবকটি সরকারের আমলে তিনি মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পালন করেন এবং দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারনী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির আমরণ সদস্য ছিলেন।

বিশ্ববরেণ্য এই রাজনীতিবিদ দেশীয় শিক্ষার মানোন্নয়নে তিনি বিদ্যালয় সমূহে ফুড কর এডুকেশন- শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী চালু করেন। তিনি বলতেন- Education is the foundation of Development. উন্নয়নের ভিত্তিই হল শিক্ষা- সেই লক্ষ্যে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে তিনি ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচী চালু করে ছিলেন। এছাড়াও দেশ্যব্যাপী তার অসীম অগণিত ও অভূতপূর্ব উন্নয়নের ইতিহাস লিখে শেষ করা যাবে না। তাই চুপ রইলাম।

বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বের পাশাপাশি ১৯৯৪ সালে তিনি স্পেনের মাদ্রিদে বিশ্ব ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সুবর্ণ জয়ন্তী সম্মেলনের গভর্নর নির্বাচিত হন। ১৯৮০ থেকে ১৯৮২ ও ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ মেয়াদে তিনি বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি, আইএফএডিতে বাংলাদেশের গভর্নর ছিলেন। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৫ মেয়াদে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি অর্থনৈতিক কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটি একনেকের চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়াও দেশ বিদেশে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বহু সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন।
৫২’র মহান ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য ২০০৫ সালে স্বীকৃতি ও সম্মাননা স্বরূপ একুশে পদক লাভ করেন। এছাড়াও সেনেগালের সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মাননা “অর্ডার নেশন্যাল” পদক লাভ করেন।

বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী, বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য, মহান কীর্তিমান এম. সাইফুর রহমানের অসামান্য অবদান দল, দেশ ও জাতি বিনম্র শ্রদ্ধায় চিরদিন স্মরণ করিবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এম. সাইফুর রহমানের কৃতিত্ব সর্বজন নন্দিত ও প্রশংসিত। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা এবং জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি সর্বদাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। একজন প্রজ্ঞাবান, বিচক্ষণ ও কীর্তিমান অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে যুগান্তকারী অবদান রেখেছেন। তার দক্ষ রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সুনাম অর্জন করেছে।
তিনি বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির অন্যতম পথিকৃৎ। একজন স্বাধীনচেতা, স্পষ্টভাষী, অটুট মনোবল এবং অহিংস ও অহংমুক্ত ব্যক্তিত্বের কারণে তিনি সর্বজন শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন।

বাংলাদেশের ক্রান্তিলগ্নে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে তিনি দেশকেই শুধু অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করেননি বরং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অঙ্গীকারে বিএনপিকে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। জাতীয়তাবাদী দর্শনকে বুকে ধারণ ও লালন করে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে স্বৈরাচারের কবল থেকে গণতন্ত্রের পথে উত্তরণে এম. সাইফুর রহমানের অবদান দেশবাসী ও দল চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।

এই মহান পুরুষ ২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আজকের এইদিনে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায় এক রহস্যজনক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় সিলেটসহ গোটা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের বরপুত্র, বিশ্ববরেণ্য রাজনীতি ও অর্থনীতিবিদ, সিলেট বিভাগের প্রাণ অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমান মৃত্যুবরণ করেন।
আজ ১২’তম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।
আল্লাহ তাহাকে জান্নাতের শ্রেষ্ঠতম আসনে অধিষ্ঠিত করুন। আমীন।
—————————–
শারফিন চৌধুরী রিয়াজ।
ভোটার- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি।