Select Page
মনসুর হাল্লাজ এর জীবনী-বানী-কারামত ও কালাম-হযরত-মানসুর আল–হাল্লাজ

মনসুর হাল্লাজ এর জীবনী-বানী-কারামত ও কালাম-হযরত-মানসুর আল–হাল্লাজ

হযরত হুসাইন মনসুর হাল্লাজ (রহ:)আধ্যাত্বিক জগতের আলোড়ণ সৃষ্টিকারী এক বিস্ময়কর মহাপুরুষ ছিলেন। তাঁর পাণ্ডিত্য ও বাগ্মিতা ছিল যেমন অসাধারণ, তার আধ্যাত্বিক চেতনাও তেমনি ছিল অপরিসীম। তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন । কিন্তু বক্তব্য বিষয়ের গুঢ়ার্থ ছিল দুর্বোধ্য। এবাদতে তাে কথাই নেই। তাঁর আল্লাহ্ প্রেমেরও কোন তুলনা ছিল না। আল্লাহ প্রেমে তিনি ছিলেন নিয়ত অস্থির। আল্লাহর বিরহানলে তিনি দগ্ধ হয়েছেন দিন রাত। আর এজন্য জীবনে কষ্টও পেয়েছেন প্রচুর। শেষ পর্যন্ত নিজের অমূল্য প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। আল্লাহর ওয়াস্তে মানুষের হাতে।

মনসুর হাল্লাজ

মানুষ তার কাজকর্মে বিরক্ত হতেন। তার বহু কাজে আপত্তি ছিল সুফী দরবেশগণেরও। তারা সে সবের প্রতিবাদ করতেন। তার চলাফেরা, কথাবার্তার মর্ম উপলদ্ধি করতে না পেরে তারা বলতেন, তাসাওউফে তাঁর কোন দখল নেই। অবশ্য হযরত আবদুল্লাহ খাফীফ রহমাতুল্লাহ, হযরত শিবলী রহমাতুল্লাহ, হযরত আবুল কাসেম নসরাবাদী রহমাতুল্লাহ, ইবনে আতা রহমাতুল্লাহ প্রমুখ প্রখ্যাত তাপসগণ তাকে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন দরবেশ বলে মনে করতেন। আবার অনেকে তাঁকে কাফের বলেছেন। তাঁর ওপর অত্যাচার করেছেন। অনেকে বলেন, তিনি ছিলেন ইত্তেহাদী। সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে কোন পার্থক্য দেখতে পেতেন না। মূলত এই গঢ়তত্ত্ব সাধারণ মানুষের বােধগম্য নয়। বাগদাদের কিছু লােক হাল্লাজী বা তাঁর অনুসারী বলে দাবী করতেন আর নানা অপকর্মে লিপ্ত হতেন।

‘আনাল হক’

তিনি একবার বলেছিলেন ‘আনাল হক’। অর্থাৎ আমিই আল্লাহ। তার ওপর যে অকথ্য জুলুম হয়, তার কারণই হল এ উক্তি। কিন্তু বর্তমান গ্রন্থকার হযরত ফরীদ উদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ বলেন, আমি এটাকেই অত্যন্ত আশ্চর্য মনে করি যে, হযরত মূসা (আঃ) যখন তুর পর্বতে আল্লাহর জ্যোতি দর্শন করেন, তখন গাছ থেকে ইন্নী আনাল্লাহ’ নিশ্চয় আমি আল্লাহ এই শব্দ শােনা গিয়েছিল। বলা হয়, এ আওয়াজ ছিল স্বয়ং আল্লাহর, গাছের নয় । তা হলে হযরত মানসুর হাল্লাজের রহমাতুল্লাহ মুখ থেকে যখন ‘আনাল হক’ কথাটি বের হয়, তখন কেন বলা হবে না তার মুখের বাণীটি আসলে আল্লাহর বাণী। হযরত হুসাইন মানসুর হাল্লাজের রহমাতুল্লাহ মুখের কথা নয়। হযরত ফরীদ উদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ আরও বলেন, তাঁর বেলায়ও তাে বলা যেতে পারে যে, তার জবানে খােদ আল্লাহই ‘আনাল হক” কথাটি উচ্চারণ করেছেন। এটি হযরত হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ-এর কথা নয়। তিনি নিজে আল্লাহ হওয়ার দাবীও করেননি।

হযরত শায়খ ফরীদ উদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ বলেন, বাগদাদ শহরে হুসাইন মনসুর নামে এক জাদুকর ছিল, কেউ কেউ তার সঙ্গে তাপসকে গুলিয়ে ফেলেছেন। আসল ঘটনা কিন্তু অন্য রকম। জাদুকরের জন্ম ওয়াসেত শহরে আর মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ বাস করতেন বাগদাদে । যাই হােক, হযরত আবদুল্লাহ খফীফ বলেন, হুসাইন মনসুর রহমাতুল্লাহ আল্লাহর মারেফাতে জ্ঞানী ছিলেন। হযরত শিবলী রহমাতুল্লাহ বলেন, হযরত মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ ও আমি- আমরা দুজন একই অবস্থার লােক। পার্থক্যটুকু এই যে, আল্লাহর দাবীদার মনে করে মানুষ তাকে ধ্বংস করেছে, আর আমাকে পাগল মনে করে দূর করে দিয়েছে। | হযরত মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ-এর সঠিক জন্মস্থান জানা যায় না। তবে তার বাল্য ও কৈশাের অতিবাহিত হয় বাগদাদে। আঠারাে বছর বয়সে তিনি ততরে চলে যান। সেখানে হযরত আবদুল্লাহ তশতরী রহমাতুল্লাহ-এর সংস্পর্শে দু’বছর কাটান। তারপর বসরা। বসরা থেকে দাওহারকা। সেখানে হযরত আমর ইবনে ওসমান মক্কী রহমাতুল্লাহ-এর সাহচার্যে আসেন। আর এখানেই তিনি বিবাহ করেন। হযরত ইয়াকুব আতা রহমাতুল্লাহ-এর কন্যাকে। অতঃপর হযরত ইয়াকুব রহমাতুল্লাহ-এর সঙ্গে মনােমালিন্য হওয়ায় তিনি বাগদাদে হযরত জুনায়েদ রহমাতুল্লাহ-এর দরবারে চলে আসেন। এখানে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে তিনি চলে যান মক্কায়। সেখানে এক বছর কাটান। তারপর একদল সুফী সাধকের সঙ্গে তিনি আবার বাগদাদে আসেন। এই সময় তিনি হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহমাতুল্লাহ-এর কাছে একটি জটিল মাসআলার উত্তর জানতে চান। কিন্তু হযরত জুনায়েদ রহমাতুল্লাহ তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন, তুমি কুব শীঘ্রই ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলবে। হযরত মানসুর রহমাতুল্লাহ বলেন, আমি যেদিন ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলব, সেদিন আপনার অঙ্গেও এ সুফী পােশাকের পরিবর্তে মামুলী পােশাক দেখা যাবে।

দু’জনের ভবিষ্যদ্বাণীই সফল হয়। পরবর্তীকালে, তাঁর আপাতঃ শরীয় বিরােধী কার্যকলাপের জন্য দেশের সমগ্র আলেম সমাজ যখন তাঁকে হত্যা করার ফতোয়া দেন, তখন কেবল হযরত জুনায়েদ রহমাতুল্লাহ-ই ফতােয়ায় সই করেননি। কেননা, তখন পর্যন্ত তিনি প্রকৃত সুফীই ছিলেন। সুতরাং তার পক্ষে হযরত মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ-এর হত্যার সিদ্ধান্তে সম্মতি পােষণ করা সম্ভব ছিল না। দেশের খলীফা বললেন, মানসুর রহমাতুল্লাহ-এর বিরুদ্ধে এ ফতােয়াকে যদি শুদ্ধ প্রমাণ করতে হয়, তবে হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহমাতুল্লাহ-এর স্বাক্ষর একান্ত জরুরী। উপায়ান্তর না দেখে হযরত জুনায়েদ রহমাতুল্লাহ সুফীর পােশাক পরিত্যাগ করে খানকা থেকে মাদ্রাসায় চলে গেলেন। আর সেখানে প্রকাশ্য আলেমের পােশাক পরে ফতােয়ায় সই করলেন। তাতে তিনি মন্তব্যে লেখেন, প্রকাশ্য কাজকর্মের দিক থেকে মনসুর প্রাণদন্ডের উপযুক্ত। আর ফতােওয়া প্রদান করা হয় সাধারণতঃ বিচার বা ব্যবস্থা অনুসারেই। গুপ্ত অবস্থা মানুষের জন্য দেখা সব নয়। তার লি’র ব্যবস্থা আল্লাহই করে থাকেন।

হযরত জুনায়েদ রহমাতুল্লাহ-এর কাছে মাসআলার উত্তর না পেয়ে হযরত মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ মনে এত বেশী দুঃখ পান যে, তাকে কিছু না বলেই সস্ত্রীক তশতরে চলে যান। তশতরবাসী তাকে সাদরে গ্রহণ করেন এবং তিনি এক বছরেরও ওপর সেখানে সসম্মানে বাস করেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে মতানৈক্য হতে খুব বেশী দেরী হল না। কারও মন যুগিয়ে চলা ছিল তার স্বভাব বিরুদ্ধ। বিশেষ করে আলেম সমাজকে তিনি তেমন আমল দিতেন না। তার ওপর ছিল হযরতের আমর ইবনে ওসমান মক্কী রহমাতুল্লাহ-এর প্ররোচনা। তিনি তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। তিনি মক্কা থেকে তার বিরুদ্ধে খােরাসানবাসীদের উত্তেজিত করে তােলেন। ফলে মর্মাহত মানসুর রহমাতুল্লাহ দরবেশী পােশাক ছেড়ে সাধারণ বেশে সমাজের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গেলেন। এ যেন এক অজ্ঞাতবাস। আর এভাবে কাটল পাঁচ বছর। তিনি কখনও খোরাসানে, কখনও মাওরান্নহরে, কখনও বা নীমরােজে, সিন্তানে, কেরমানে- ইত্যাদি নানা স্থানে ঘুরে বেড়ান। শেষে গেলেন পারস্যে। আর এখানে রচনা করলেন বহু মূল্যবান গ্রন্থ। তাছাড়া আহওয়াজবাসীদের উপদেশ দিয়ে তাদের অনুকূল্য লাভ করলেন। তাঁর বক্তৃতা, উপদেশ সব কিছুই ছিল গূঢ় রহস্যপূর্ণ। এ জন্য স্থানীয় জনগণ তার নাম দেন হাল্লাজুল আসরার। হাল্লাজ আরবী শব্দ যার অর্থ হল ধুনকার, ধানুকী, যে তুলা ধুনে। শােনা যায়, একবার তুলার স্তুপের দিকে ইশারা করামাত্র সেগুলি খুব সুন্দরভাবে ধুনা হয়ে যায়। আর তখন থেকেই তিনি হাল্লাজ নামে অভিহিত হন।

পাঁচ বছর আত্মগােপনের পর তিনি বসরায় ফিরে আসেন। আর আবারও সুফী পােশাক পরিধান করেন। সেখানে কিছুদিন থাকার পর তিনি যান মক্কায় । কিন্তু সেখানে উপস্থিত হওয়া মাত্রই হযরত ইয়াকুব নাহারজুরী রহমাতুল্লাহ তাকে জাদুকর বলে আখ্যা দেন। বাধ্য হয়ে তিনি আবার ফিরে এলেন বসরায়। ওখানে এক বছর কাটিয়ে আহওয়াজ হয়ে তিনি চলে আসেন হিন্দুস্থানে। হিন্দুস্থান থেকে খােরাসান, মাওরাউন্নহর প্রভৃতি দেশ ঘুরে ঘুরে চলে যান চীনে। তারপর আবার মক্কা শরীফে। এবার সেখানে দু’বছর কাটান। তারপর মক্কা থেকে বিদায় নেবার সময় তার মধ্যে দারুণ পরিবর্তন আসে। তখন তাঁর কথাবার্তা সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে। কাজেই এরপর তিনি যখনই যে দেশে গেছেন তখনই মানুষের কাছে লাঞ্ছিত ও বিতাড়িত হয়েছেন। এক এক সময় তিনি এত বেশী দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণা ও উৎপীড়ন সহ্য করেন যে, আর কোন সাধক-দরবেশকে তা কখনও সহ্য করতে হয়নি। শােনা যায়, তার পূঢ় রহস্যপূর্ণ, দুর্বোধ্য কথা ও আচরণের কারণে তিনি অন্তত পঞ্চাশটি দেশ থেকে বিতাড়িত হন। অথচ ইনিই যখন আগের দফায় বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করেন, তখন তার জ্ঞান মুগ্ধ মানুষ তাকে নানা সম্মানে ও উপাধিতে ভূষিত করেছেন। ভারতবাসী তাকে বলতেন আবুল মুগীস, চীনারা বলতেন, আবুল মুঈন, খােরাসানীরা বলতেন, আবুল মনীর, পারস্যবাসীরা বলতেন, আবু আবদুল্লাহ যাহিদ, খুজিস্তানবাসীরা বলতেন, হাল্লাজুল আসরার, বাগদাদ ও বসরার মানুষ তাঁকে মুগবের নামে সম্মানিত করেন।

শােনা যায়, তিনি দিনে-রাতে চারশ রাকয়াত নফল নামায পড়তেন। কিন্তু নিজের জন্য ঐ নফলকে তিনি ফরজ করে নেন। সবাই বলতেন, তিনি যে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী তাতে এত কষ্ট করার কি দরকার? তিনি তার উত্তরে বলতেন, কষ্ট-ক্লেশ আল্লাহ-প্রেমীদের মনে ঠাই পায় না। কেননা, প্রকৃতপক্ষে তারা মৃত মানুষের মতাে হয়ে যান।

দীর্ঘ বিশ বছর ধরে তিনি একই পােশাকে উপাসনা করতেন। একবার লােকে জোর করে তা খুলে নেয়। তখন দেখা যায়, তার ভেতরে জমে আছে অসংখ্য উকুন । তার কোন কোনটির ওজন নাকি ছিল প্রায় তিন রতি। একজন একটি বিছে দেখতে পেয়ে মারতে যায়। তিনি নিষেধ করেন। বলেন, ওটি তার সঙ্গে রয়েছে প্রায় বারাে বছর।

তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা সম্বন্ধে বর্ণনা দিয়েছেন হযরত রুশী খেরাদ সমরকন্দী। একবার হযরত মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ-এর চারশ সঙ্গী নিয়ে এক বিশাল প্রান্তর অতিক্রম করছিলেন। সঙ্গীরা ক্ষুধায় কাতর হয়ে তাঁকে বললেন, এখন যদি ভুনা মাথা (ছাগলের) ও রুটি খেতে পেতাম তাতে বড় তৃপ্তি হত। তিনি তাদের সারিবদ্ধ অবস্থায় বসিয়ে দিয়ে নিজের পেছনে হাত নিয়ে গিয়ে একটি মাথা ও রুটি এনে একজনকে দিলেন। আর এই ভঙ্গিতে চারশ জনকেই মাথা ও রুটি খাওয়ালেন। কিছুক্ষণ পরে সঙ্গীরা খেজুর খেতে চাইলে তিনি দাড়িয়ে সঙ্গীদের বললেন, তােমরা আমাকে ধরে নাড়া দাও। তারা নাড়া দিতেই প্রচুর পাকা খেজুর পড়তে লাগল। তারা বেশ মজা করে খেজুর খেলেন।

একবার তিনি চলেছেন এক বন্য পথে। সঙ্গে অনেক সঙ্গী। তারা আঙুর খেতে চাইলেন। তিনি তার ডান হাতখানা যেমনি ওপরে ওঠালেন অমনি হাত ভর্তি আঙুর এল। আর এভাবে বেশ কয়েকবার শুন্যে হাত তুলে তিনি পেট ভরে তাদের আঙুর খাওয়ালেন। কিছুক্ষণ পরে তাঁদের হালুয়া খাবার ইচ্ছা হলাে। আর অলৌকিক শক্তি বলে তিনি তাদের সে ইচ্ছাও পূরণ করলেন। একজন বলল, হালুয়ার স্বাদ হুবহু বাগদাদের হালুয়ার মতাে। তিনি বললেন, আল্লাহর রহমতে আমার জন্য বাগদাদের বাজার আর বন-জঙ্গল দুইই সমান। | ঐদিন বাগদাদের বাবে এনতাকিয়া বাজারের এক হালুয়ার দোকান থেকে হালুয়া ভর্তি একটি কড়াই হঠাৎ উধাও হয়। তিনি যখন সদলবলে বাগদাদে পৌছলেন, তখন এক মুরীদের কাছে কড়াইটি দেখতে পেয়ে দোকানদার তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এটি আপনি কোথায় পেলেন? মুরীদ ঘটনাটি বললেন। আর হলুয়া বিক্রেতা অবাক হয়ে হযরত মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ-এর কাছে দীক্ষা নিলেন।

একবার হজ্জ যাত্রায় তাঁর সঙ্গে ছিলেন চার হাজার হজ্জযাত্রী। তাঁদের নিয়ে তিনি মক্কায় পেীছে কাবা ঘরের সামনে ঐ যে দাঁড়ালেন, পুরাে একবছর আর নড়লেন না। এভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। সূর্যের তাপে তার দেহ গলে গিয়ে চর্বি বেরােতে লাগল। গায়ের চামড়া গেল ফেটে। কিন্তু তিনি এক চুলও নড়লেন না। এ অবস্থায় এক লােক প্রতিদিন তাকে একটি রুটি এক কুঁজো পানি দিয়ে আসত। তার থেকে মাত্র ঢোক পানি আর এক টুকরাে রুটি খেয়ে বাকী সব রেখে দিতেন। | হযরত মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ আরাফাতের মাঠে গিয়ে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেন, প্রভু গাে আপনি পথ ভ্রষ্ট মানুষের পথপ্রদর্শক। আমি যদি সত্যিই কাফের হয়ে থাকি, তবে আমার কুফরীই বাড়িয়ে দিন। যখন লােকজন তার চারপাশ থেকে চলে যেত, তখন তিনি আবার দোয়া করতেন, প্রভু! আমি আপনার একত্ব স্বীকার ও বিশ্বাস করেই আপনি ছাড়া আর কারও এবাদত করি না। আর আপনার দেয়া দানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে অক্ষম বলে তা প্রকাশ করতে পারি না। অতএব, আমার অনুরোধ, আমার বদলে আপনিই আপনার নেয়ামতসমূহের শােকর আদায় করুন। কেননা, আপনার প্রদত্ত নেয়ামতসমূহের সম্পূর্ণ শােকর আদায় আপনার কোন বান্দার দ্বারা সম্ভব নয়। সেটি কেবল আপনার দ্বারাই হতে পারে। | হযরত মানসুর রহমাতুল্লাহ হযরত মূসা (আঃ)-এর একটি ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, হযরত মূসা (আঃ) একবার ইবলীসকে জিজ্ঞেস করেন, সে হযরত আদম (আঃ)-কে সেজদা করেনি কেন? ইবলীস বলল, সে আল্লাহর প্রত্যক্ষদর্শী ও সেজদাকারী ছিল। সুতরাং আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে সেজদা করার তার কাছে সঙ্গত নয় বলে মনে হয়েছিল। আল্লাহর দীদারের মূল্য ও গুরুত্ব কী অপরিসীম, হযরত মূসা (আঃ) তা জানেন। আল্লাহর দীদার লাভের প্রতি তার তীব্র বাসনার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ হযরত মূসা (আঃ)-কে বললেন, পাহাড়টার দিকে তাকান। আর আপনিও প্রবল বাসনা নিয়ে পাহাড়টির দিকে দৃষ্টি দেন।

ধৈর্যের সংজ্ঞা কি? এ প্রশ্নের উত্তরে হযরত মনসুর রহমাতুল্লাহ বলেন, হাত-পা কেটে ফেললেও, শূলে চড়ালেও দুঃখ না করা এবং বিচলিত না হওয়ার নাম ধৈর্য। হযরত ফরীদ উদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ বলেন, আশ্চর্য লাগে, হযরত মানসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ-এর প্রতি শূলার যে ঘটনা ঘটল, তাতে এতটুকু দুঃখ বা আক্ষেপ প্রকাশ করলেন না। | হযরত শিবলী রহমাতুল্লাহ গেছেন হযরত হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ-কে হত্যা করতে। হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ বললেন, আমি এমন এক গুরুতর কাজ করার ইচ্ছা করেছি যার কারণে আমি পাগল প্রায় । আর আমি নিজেই তাে মৃত্যুকে আহবান করেছি। অতএব, আপনি আমাকে হত্যা করবেন না।

আগেই বলা হয়েছে, তার ‘আনাল হক’ মানুষের রােষ বৃদ্ধি করে। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, আপনার আল্লাহত্ত্বের দাবী কি কুফরী নয়? তিনি বললেন, আল্লাহর প্রকৃত পরিচয় হল, সবকিছুই তার । আর আপনাদেরই কথায়, তিনি কখনও বিলুপ্ত হন না। তবে কি হুসাইন মানসুর বিলীন হয়ে গেছে।

হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহমাতুল্লাহ-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, হযরত মনসুর রহমাতুল্লাহ-এর কথার অন্য অর্থ করা যায় কিনা। তিনি বললেন, আর সে চেষ্টা করাে না। কেননা, সময় পার হয়ে গেছে। এখন আলেম সমাজ ও খােদ খলীফা তার প্রতি বিরূপ হয়েছেন। তিনিও একবছর ধরে বন্দী। তাঁর অনুসারীরা তার কাছে যাতায়াত করতেন। তিনি তাদের কথার সন্তোষজনক জবাবও দিতেন। কিন্তু এখন লােকজনের যাতায়াত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কয়েকজন বিদগ্ধ পণ্ডিত তার কাছে দু’জন লােককে এ কথা বলে পাঠান যে আনাল হক উচ্চারণ করে তিনি যে অপরাধ করেছেন তার জন্য তওবা করলে তাঁকে মুক্তি দেয়া হবে। তিনি জবাব দিয়েছিলেন, তিনি তা পারবেন না। হযরত আতা রহমাতুল্লাহও তাঁর কাছে গিয়েছিলেন। তার প্রস্তাবও ছিল ঐরকম। কিন্তু তাকেও তিনি একই জবাব দিয়েছেন।

কথিত আছে, প্রথম রাতে তাঁকে বন্দী করা হলে তিনি অদৃশ্য হয়ে যান। দ্বিতীয় রাতে দেখা যায় তিনিও নেই, জেলখানাও নেই। তৃতীয় রাত্রে অবশ্য তাকে এবং জেলখানাকেও দেখা যায়। এ ঘটনার মর্ম জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, প্রথম রাতে আমি আল্লাহর দরবারে চলে গিয়েছিলাম । দ্বিতীয় রাতে খােদ আল্লাহ এখানে উপস্থিত ছিলেন । তৃতীয় রাত্রে জেলখানা ও আমি আবার হাজির হলাম। কেননা, শরীয়তের বিধান রক্ষার জন্য আল্লাহ আবার আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখন তােমরা তােমাদের কর্তব্য পালন কর।

কথিত আছে, তিনি কারাগারে দৈনিক এক হাজার রাকাআত নফল নামায পড়তেন। তাকে প্রশ্ন করা হয়, আপনি যখন নিজেকে আল্লাহ্ বলে ঘোষণা করছেন, তখন এ নামায কার উদ্দেশ্যে? তিনি উত্তর দেন, আমার সম্বন্ধে আমিই ভালাে জানি।।

শােনা যায়, কারাগারে তখন তিনশ কয়েদী ছিল। তিনি তাদের মুক্তি দিতে পারেন বলে ঘােষনা করেন। কিভাবে তা সম্ভব বলে তাঁকে প্রশ্ন করা হল। কেননা তিনি নিজেও একজন বন্দী। পারলে আগে তিনি নিজেকেই মুক্ত করুন না? হযরত মনসুর রহমাতুল্লাহ বলেন, আমি যে আল্লাহর বন্দী। আর শরীয়তেরও অনুসরণ করি। না হলে ইচ্ছা করলে চোখের ইশরায় সব শৃঙ্খল ছিন্ন করতে পারি। এই বলে আঙুলের ইশরায় সত্যিই সব কয়েদীর শেকল ছিড়ে ফেললেন। কয়েদীরা বলল, আমরা এখন বেরােব কেমন করে? জেলের দরজা যে বন্ধ। তিনি তখন ইশরা করতেই দেয়ালে কয়েকটি জানালা তৈরী হয়ে গেল। কয়েদীদের বললেন, যাও, চলে যাও।

তারা বলল: আপনি আসবেন না?

তিনি বললেন, প্রভুর সঙ্গে আমার একটা গােপন ব্যাপার আছে। তার মীমাংসা হবে শূলে চড়ে। পরদিন প্রহরীরা দেখল, জেল শূন্য। একটিও কয়েদী নেই। তারা জিজ্ঞেস করল, কয়েদীরা কোথায়? তিনি বললেন, আমি সবাইকে ছেড়ে দিয়েছি।

তবে আপনি থেকে গেলেন কেন? তিনি বললেন। আমার ওপর মালিকের খেদ রয়েছে। সে জন্য অপেক্ষা করছি।

খলীফার কাছে এ সংবাদ পৌছালে তিনি হুকুম দিলেন, চাবুক মেরে তাকে কতল করা হােক। তা না হলে আরও বিপত্তি ঘটতে পারে। নির্দেশমত তাকে কারাগার থেকে বের করে এনে তিনশ ঘা চাবুক বসানাে হল। কিন্তু তাতেও তার আনাল হক উচ্চারণ বন্ধ হল না। বরং আরও জোরে তিনি তা করতে লাগলেন। যে লােকটি আঘাত করছিল, সে বলল, প্রতিটি আঘাতে শােনা গেছে, মানসুর ভয় পেও না।

এত আঘাত সত্ত্বেও তিনি নির্বিকার, অবিচল। তারপর তাঁকে শূলে চড়াবার জন্য নিয়ে যাওয়া হল। এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখার জন্য প্রায় লক্ষাধিক লােকের সমাবেশ ঘটে। সেই বিশাল জনতার দিকে তাকিয়ে তিনি বলে উঠলেন, হক, হক, আনাল হক। এমন সময় এক দরবেশ তাঁর সামনে এসে বললেন, প্রেম কি বস্তু? তিনি বললেন, আজ নিজের চোখেই তা দেখতে পাবেন। কাল এবং পরশুও দেখতে পাবেন। অর্থাৎ, প্রথম দিন তাঁকে হত্যা করা হবে। দ্বিতীয় দিন তার মরদেহ পুড়িয়ে ছাই করা হবে। তৃতীয় দিন সে ছাই বাতাসে উড়িয়ে দেয়া হবে। এগুলিই হল প্রেমের নিদর্শন।

তাঁকে যখন শূলে চড়ানাে হয়, তখন তাঁর সেবক এসে তাঁর শেষ উপদেশ প্রার্থনা করেন। তিনি বললেন, নিজেকে যেকোন সৎ কাজে নিয়ােজিত রেখাে। না হলে রিপু তােমাকে মন্দ কাজে লাগিয়ে দেবে। তার ছেলে এসে কিছু শুনতে চাইলেন। তিনি বললেন, দুনিয়ার সবাই পুণ্য কর্মের চেষ্টায় আছে। তুমি এমন একটি কাজের চেষ্টা কর, যার একটি কণা সারা বিশ্বের মানুষ ও জ্বিনের আমল হতেও উত্তম হয়। সেটি হল হাকীকতের একটি অণু। অতঃপর তিনি সানন্দে শূলকাঠের দিকে এগিয়ে গেলেন। আপনার এত খুশী কিসের? কেউ তাঁকে শুধাল। তিনি বললেন, কারণ, আমি আমার ডেরায় যাচ্ছি। এর চেয়ে বেশী আনন্দের সময় আর কখন হবে? এবার তিনি বিড়বিড় করে আবৃত্তি করতে লাগলেনঃ আমার বন্ধু আমার প্রতি মােটেই অবিচার করেননি। অতিথিকে যেমন পবিত্র ও উত্তম শরাব পান করানাে হয়, আমার প্রভুও আমাকে তেমনি পান করিয়েছেন। শরাবের পাত্র কয়েকবার পান করার পর কাপ ও তরবারি-সহ এগিয়ে যাবার জন্য বন্ধু আমাকে সাদরে আহ্বান জানালেন। আর এই হল ঐ ব্যক্তির উপযুক্ত আযাব যে গ্রীষ্মকালে অজগরের সঙ্গে বসে পুরাতন শরাব পান করে। তাকে নিয়ে যাওয়া হল শুলের তলায়। তিনি শুল চুম্বন করলেন। তারপর শূলের সিড়িতে পা রেখে বললেন, বীর পুরুষের মেরাজ হল শুলদণ্ড। এবার তিনি কিবলামুখী হয়ে আল্লাহর দরবারে মােনাজাত করলেন, প্রভু গাে! যা চেয়েছিলাম তাই পেলাম । যখন তাকে শূলে চড়ানাে হল, তখন তাঁর শিষ্যগণ বললেন, হুজুর! যারা আপনার ওপর নিষ্ঠুর ব্যবহার করল, আর আমরা যারা আপনার সমর্থক, তাদের প্রতি আপনার ধারণা কি? তিনি বললেন, যারা আমার প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার দেখাল, তারা দ্বিগুণ পুণ্য অর্জন করবে। আর যারা আমাকে সমর্থন করেছে ও আমার প্রতি পবিত্র ধারণা পােষণ করেছে, তারা পাবে মাত্র একটি সওয়াব। কেননা, তােমরা আমার প্রতি কেবল ভালাে ধারণাই পােষণ করেছ। আর তারা একত্ববাদের শক্তি ও শরীয়তের কঠিন বিধান-এ দুইয়ের তাড়নায় তাড়িত। মনে রেখাে, ইসলামে তওহীদই আসল। আর ভালো ধারণা তার শাখা মাত্র।

তিনি নাকি যৌবনে এক তরুণীর প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। সে কথা তার মনে এল। আর বললেন, এতদিন পর আজ তার প্রতিশােধ নেয়া হল। এবার হযরত শিবলী রহমাতুল্লাহ এসে তাঁকে তাসাওউফ বা সাধনা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, আপনি যা দেখেছেন তা তাসাওউফের নিম্ন শ্রেণী। তাহলে উচ্চ কোন্‌টি? শিবলী রহমাতুল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, সেটি আপনার জ্ঞানের বাইরে। এবার তার ওপর পাথর ছোঁড়া শুরু হল। এমন কি হযরত শিবলী রহমাতুল্লাহ ও একটি ঢিল নিক্ষেপ করলেন। আর হযরত হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ আর্তনাদ করে উঠলেন। লােকে তাকে বললেন, এত পাথর ছোঁড়া হচ্ছে, অথচ আপনি নির্বিকার। কিন্তু শিবলী রহমাতুল্লাহ-এর সামান্য ঢিলের আঘাতে আপনি অমন চিৎকার করলেন কেন? তিনি বললেন, যারা পাথর নিক্ষেপ করছে তারা রয়েছে অজ্ঞানতার আঁধারে । কিন্তু হযরত শিবলী রহমাতুল্লাহ-এর মতাে জানাশােনা লােক আমার ওপর ঢিল ছুঁড়ছেন, এ দুঃখ কি সহ্য করা যায়?

শূলে চড়িয়ে প্রথমে তার হাত কেটে দেয়া হয়। তিনি মন্তব্য করলেন, এ লেকটির এই হাত কাটা সহজ বটে, কিন্তু যে অদৃশ্য হাত দিয়ে সে আরশের ওপর থেকে গৌরবের মুকুট টেনে আনছে, তা কে কাটতে পারে? তারপর তাঁর পা কাটা হল । তখনও তার সহাস্য মন্তব্য; এই পায়ের সাহায্যে পৃথিবীতে চলাফেরা করেছি। আর এখন এই পা কেটে ফেলা হল। কিন্তু আমার যে অদৃশ্য পা আছে, জান্নাতে আমি তার সাহায্যেই বিচরণ করব। তােমাদের ক্ষমতা থাকলে সে পা কেটে নাও দেখি! বলে দু’হাতের রক্ত নিয়ে তিনি মুখে মাখতে লাগলেন। এ আপনি কি করছেন? তাকে সবাই বলে। তিনি বললেন, আমার শরীরের রক্ত ঝরছে প্রচুর। তাই মুখখানি সাদা হয়ে গেছে। তােমাদের মনে হতে পারে, বুঝি বা ভয়েই মুখখানি সাদা হয়ে গেছে। তাই মুখে রক্ত মেখে লাল করে নিলাম। | তারপর তিনি হাতে রক্ত মাখতে লাগলেন। বললেন, ওজু বানাচ্ছি। লােকে বলে কি রকম? তিনি বললেন, দু’রাকায়াত এশকের নামায আছে, যা রক্ত দ্বারা ওজু করে আদায় করতে হয়। | এরপর তাঁর চোখ উপড়ে ফেলা হল। আর এ দৃশ্য দেখতে না পেরে জনগণ কান্নায় ভেঙে পড়ল। অবশ্য কেউ কেউ তখনও তার দিকে পাথর ছুঁড়ছিল। এবার তার জিভ কাটতে উদ্যত হলে তিনি একটু থামতে বললেন। তারপর শূন্যে দৃষ্টি ছড়িয়ে বললেন, প্রভু! এরা যে আমাকে এত কষ্ট দিল এজন্য এদের আপনার অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত করবেন না। যদিও তারা আমার হাত পা কেটেছে, তবুও তারা সবাই রয়েছে আপনার পথে। তারা যদি আমার মাথাও কেটে নেয়, তবুও তাদের উদ্দেশ্য শুধু আপনারই দীদার লাভ করা।

এবার তার নাক ও কান কেটে দেয়া হল। তার ওপর প্রস্তর নিক্ষেপ তখনও বন্ধ হয়নি। তার শেষ কথা হলঃ আমি একত্ববাদের প্রেমিক। একত্বের প্রতি প্রেম হল, এককে একই জানা আর অন্য কাউকে সেখানে স্থান না দেয়া। তারপর তিনি এই আয়াতটি পাঠ করলেন; “যারা ঈমান আনে না এবং কিয়ামতকে অবিশ্বাস করে তা থেকে পালিয়ে যায়, অথচ তারা অন্তরে জানে যে, এ অবধারিত সত্য, তারাই সহাস্যে রাসূলে করীম রহমাতুল্লাহ-কে তাড়াতাড়ি কিয়ামত এনে দেখাতে বলে। আর যারা ঈমান আনে (সেই ভয়ঙ্কর দিনে নাম শুনে) ভয়ে ভীত হয় ও কুকর্ম থেকে বিরত থাকে, তারাই কিয়ামতকে সত্য বলে জানে ও মনে প্রাণে বিস্বাস করে।”

এটুকু বলার পরই তার জিভ কেটে নেয়া হল । তখন দিনের আলাে ফুরিয়ে এল । এল সন্ধ্যা। এবার খলীফার নির্দেশ দেহ থেকে তার মাথা বিচ্ছিন্ন করা হােক। এ আদেশ পালনে ঘাতকেরা প্রস্তুত। হঠাৎ মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ স-শব্দে হেসে উঠলেন কিন্তু জনতার মধ্যে জেগে উঠল কান্নার রােল। আর সেই হাসি কান্নার মধ্যেই তার শিরচ্ছেদ করা হল । আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রতিটি অঙ্গ উচ্চারণ করতে শুরু করল আনাল হক, আনাল হক। তখন সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে টুকরাে টুকরাে করা হল। বাকী রইল শুধু গলা আর পিঠ। কিন্তু তাঁর খণ্ডিত অঙ্গ থেকেও নিনাদিত হল আনাল হক আনাল হক। শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দু মাটিতে পড়ে আনাল হক বলতে শুরু করল। আর এমনিভাবে রাত কেটে গেল। দ্বিতীয় দিন সবাই স-বিস্ময়ে দেখল, আগে শুধু এক মুখে আনাল হক উচ্চারিত হচ্ছিল। এখন তা শতমুখে উচ্চারিত হচ্ছে। খলীফার লােকজন এবাৱ হতবুদ্ধি হয়ে গেল। তারা তার খণ্ডিত দেহাংশগুলি আগুনে পুড়ে ছাই করে ফেলল। কিন্তু তাতে বিপদ বেড়ে গেল সহস্র গুণ । প্রতিটি ভস্মকণা থেকে শব্দ উঠতে থাকল আনাল হক, আনাল হক।

বেগতিক বুঝে খলীফা নির্দেশ দিলেন, তার দেহ-ভস্ম দজলা নদীতে ফেলে দেয়া হােক। কিংকর্তব্যবিমূঢ় প্রশাসন কর্মীরা তাই করল। কিন্তু তার ফল হল আরও মারাত্মক। হঠাৎ দজলা নদী ফুঁসে উঠল বিপুল জলােচ্ছাসে । আর উৎক্ষিপ্ত তরঙ্গ আনাল হক আনাল হক বলতে বলতে প্রচণ্ড বেগে আছড়ে পড়ল নদী-তটে। জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হল। হয়ত ক্রুদ্ধ নদী বাগদাদ মহানগরী গ্রাস করে ফেলবে। সবাই তখন দিশেহারা।

হযরত মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ ঐ ক্ষমতাবলে ভবিষ্যতের কথা জেনে নিয়েছিলেন। তাই তিনি তাঁর এক শিষ্যকে বলে যান, তার দেহ ভস্ম দজলা বক্ষে নিপতিত হলে তা ভীষণ আকার ধারণ করবে। তখন তিনি যেন তার খিরকাটি নদীকে দেখিয়ে দেন। তা হলে সে শান্ত হয়ে যাবে। হঠাৎ কথাটি মনে পড়ল ঐ শিষ্যের। তিনি তাড়াতাড়ি তার খিরকাটি নিয়ে নদীর সামনে ধরলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে নদী শান্ত হয়ে গেল। নিক্ষিপ্ত ভস্ম এসে জমা হল নদী-তীরে। আর তা তুলে নিয়ে লােকেরা কবর খুঁড়ে তাতে দাফন করল । ভয়ংকর এক বিপর্যয় থেকে দেশ ও জাতি রক্ষা পেল। অন্য কোন তাপসের মৃত্যুর পর মানুষ এমন বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করেনি। একজন বিখ্যাত জ্ঞানী বলেন, যখনই হষরত মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ-এর প্রতি অমানবিক আচরণের মর্মান্তিক দৃশ্যটি মানস পটে ভেসে ওঠে, তখন আপনা থেকে আমার মনে একটি প্রশ্নের উদয় হয় যে, তার সাথে এরূপ ব্যবহার করা হল কেন? আর এ প্রশ্নও মনের মধ্যে নিয়ত ঘুরপাক খায়, যারা তাঁর প্রতি এ ধরনের নিষ্ঠুর আচরণ করল, রােজ কিয়ামতে তাদের অবস্থা কী দাঁড়াবে? হযরত আব্বাস তুসী রহমাতুল্লাহ বলেন, রােজ কিয়ামতে হাশরের মাঠে তাঁকে বেঁধে রাখা হবে, না হলে তার দ্বারা এক তুমুল কান্ড সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

কোন এক দরবেশ বলেন, যে রাতে হযরত মনসুর রহমাতুল্লাহ-কে শূলে দেয়া হয়, সে রাতে ভাের পর্যন্ত তিনি শূল কাঠের নিচে মােরাকাবায় কাটিয়ে দেন। ভােরের দিকে তিনি এক অদৃশ্য বাণী শুনতে পান। তাতে বলা হয়, আমি আমার গােপন রহস্যাবলীর একমাত্র রহস্য মানসুরের কাছে উন্মোচন করেছিলাম যা সে জনসমক্ষে প্রকাশ করে দিল। যার ফলে তাকে এরূপ কঠোর পরিণতির শিকার হতে হল। কোন শাহী রহস্য ফাঁস করে দিলে তার পরিণতি এরূপই হয়ে থাকে।

হযরত শিবলী রহমাতুল্লাহ বলেন, তার দেহ ভস্ম দাফন করার পর তিনি সেখানেই সারা রাত উপাসনায় কাটিয়ে দেন। ভােরবেলায় আল্লাহর দরবারে মােনাজাত করেন। হে প্রভু, মানসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ একজন মুমিন বান্দা ছিলেন। তিনি তত্ত্বজ্ঞানী, প্রেমিক, তওহীদবাদী। তা সত্ত্বেও আপনি তাঁকে এমন কঠিন অবস্থায় ফেলে দিলেন? তাঁর প্রার্থনা তখনও শেষ হয়নি। হঠাৎ তার ঘুম নামে দু’চোখে আর তিনি স্বপ্ন দেখেন, রােজ কিয়ামত উপস্থিত। আল্লাহ পাক ঘােষণা করছেন, আমি তার সঙ্গে এরূপ ব্যবহার এজন্য করেছি যে, সে আমার গােপন রহস্য মানুষের কাছে ফাস করে দিত। যে গােপন রহস্য দজলা নদীর ওপর প্রকাশ করা উচিত ছিল সে তা মানুষের কাছে প্রকাশ করে দিয়েছিল। হযরত শিবলী রহমাতুল্লাহ দ্বিতীয় রাতে পুনরায় তাঁকে স্বপ্নযােগে দেখেন। আর তার অবস্থা জানতে চান। তিনি উত্তর দেন, আল্লাহ তাকে অনুপম জান্নাতে জায়গা দিয়েছেন। তিনি আরও জানতে চান, তাঁর সমর্থক ও বিরােধী এই দু’দলের সঙ্গে আল্লাহ কিরূপ ব্যবহার করবেন। তিনি বললেন, দু’দলের ওপরই আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষিত হবে। একদল আমাকে বিশেষভাবে জানত ও আমার সম্বন্ধে ভালাে ধারণা করত। অন্য দল জানত না, কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যই আমার বিরােধিতা করত । তাই উভয় দলই আল্লাহর প্রিয় ও করুণার পাত্র বলে বিবেচিত।

কোন এক দরবেশ স্বপ্ন দেখেন, হাশরের মাঠে হযরত মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ শরাবের পেয়ালা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু তার দেহের সঙ্গে মাথা যুক্ত নয়। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, পৃথিবীতে যাদের শিরচ্ছেদ হয়েছে, তারাই হাশরের মাঠে শরাবের পেয়ালার অধিকারী হবে।

হযরত শিবলী রহমাতুল্লাহ বলেন, হযরত মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ-কে যখন শূলে তােলা হয়, তখন ইবলীস তাঁর সামনে এসে বলে, আপনি যা বলেছেন আমিও তাই বলেছিলাম। আপনি আনাল হক বলছেন, আমি বলতাম আনা খাইরুন (আমি সর্বোত্তম)। তবে কেন আপনার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ আর আমার প্রতি অভিশাপ অবতীর্ণ হল? হযরত মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ জবাব দেন, তুমি তা বলেছিলে অহমিকা-প্রসূত হয়ে স্বেচ্চায়। আর আমি আনাল হক বলেছিলাম আমার আমিত্ব সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে আল্লাহরই ইচ্ছায় । এই হল অনুগ্রহ ও অভিশাপের কারণ। জেনে রেখাে, অহঙ্কার আল্লাহর দরবারে অত্যন্ত দৃণিত, নিকৃষ্ট। পক্ষান্তরে আমিত্ব বিসর্জন দেয়া হল আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয় ও পছন্দনীয় কাজ। | হযরত মূসা (আঃ) সম্পর্কে তাঁর অভিমত জানতে চাওয়া হলে হযরত মানসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ বলেন, তিনি ছিলেন সর্বাবস্থায় সত্য ও ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ফেরাউন সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যঃ সে-ও খাঁটি ছিল। কেননা, আল্লাহ ‘খাস’ ও ‘আম” (বিশেষ ও সাধারণ) দুই শ্রেণীর মানুষ সৃষ্টি করেছেন। উভয় শ্রেণীই নিজ নিজ পথে চলে। আর উভয় শ্রেণীর পথ-প্রদর্শক হলেন আল্লাহ। তিনি বলেনঃ

১, আল্লাহর স্মরণে লিপ্ত হয়ে যারা ইহলােক-পরলােক সবকিছু ভুলে যায়, তারাই আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে।

২. সুফী ব্যক্তি বড় একা এই কারণে যে, আল্লাহ ছাড়া তিনি কোন কিছুর খবর রাখেননা । অন্যরাও তার সম্বন্ধে কোন কিছু জানতে পারে না।

৩. ঈমানের আলােয় আল্লাহর অনুসন্ধান কর।

৪. হেকমত তীর সদৃশ। আল্লাহ তীরন্দাজ। আর তার নিশানা সৃষ্টিজগত।

৫. মুমিন তিনিই যিনি ধন-সম্পদকে দুষণীয় মনে করে স্বপ্নের রাজ্যে সন্তোষ অবলম্বন করেন।

৬. বিপর্যয়ে ধৈর্যধারণ করা ও আল্লাহকে ভালােভাবে জেনে নেয়াই হল সর্বোৎকৃষ্ট চরিত্র।

৭. আমলকে অসততা থেকে পবিত্র রাখাই হল আখলাক।

৮. সাধারণ মানুষের জ্ঞান, তত্ত্বজ্ঞানীর আধ্যাত্ম-চিন্তা, বিদ্বানগণের জ্যোতি এবং পূর্ববর্তী মুক্তিপ্রাপ্তদের পথই হল প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একই আল্লাহর পথে সম্পৃক্ত ও জড়িত।

৯. বাদশাহ যেমন ভােগবিলাস, রাজ্য দখল প্রভৃতি কাজে ব্যস্ত, অনুরূপভাবে আমরাও সদা-সর্বদা বিপদ-আপদ আসায় ব্যস্ত থাকি।

১০. উপাসনার মঞ্জিল পার হবার পর মানুষ স্বাধীনতা লাভ করে।

১১. বেশী লম্বা হাত কী দোয়ার না এবাদতের? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কোন হাতই লক্ষ্যস্থলে পৌছাতে পারে না। কেননা, প্রার্থনার হাত পৌছাতে পারে স্বীকৃতির সীমা পর্যন্ত। আর এবাদতের হাত পৌছায় শরীয়তের দামান পর্যন্ত। খাটি দাসগণের কাছে এরা কোনটিই পছন্দনীয় নয়।

১২. আল্লাহর হাকীকত যার জন্য খুলে যায়, সামান্য কাজের মাধ্যমেই তা হয়ে যায়। পক্ষান্তরে যার প্রতি তা উন্মুক্ত হবার নয়, বহু সৎ কাজের বিনিময়েও তা কখনই হয় না।

১৩. যতক্ষণ পর্যন্ত বিপদ-আপদে ধৈর্য ধারণ করা না যাবে, আল্লাহর এনায়েত সে পর্যন্ত হাসিল করা সম্ভব হবে না।

সূত্রঃ-তাযকেরাতুল আউলিয়া

মনসুর হাল্লাজ এর জীবনী পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

খাজা বাবার জীবনী

খাজা বাবার জীবনী

খাজা বাবার জীবনী, বানীঅলৌকিক ঘটনা এবং বিশেষ উপদেশাবলীঃ

খাজা বাবার জীবনীঃ হযরত খাজা গরীব-উন-নওয়াজ বুরহানুল আশেকীন, সেরাজুস সালেকীন, মুরাসিল মুশকিন, শামছিল আরেফীন, আতায়ে রসূল, সূলতানুল আওলিয়া, রৌশনজামীর, খাজায়ে খাজেগান, পীরে পীরান, কুতুবে রব্বানী, মাহবুকে সােবহানী, হযরত খাজা মঈনুখীন হাসান চিশতী সনজরী দুম্মা আজমেরী (রাঃ) হযরত রসূলে খােদা (সাঃ)-এর পৌত্র হযরত ইমাম হাসান (রাঃ)-এর বংশধর। হযরত খাজা গরীব-উন-নওয়াজের পিতার নাম হযরত সৈয়দ গিয়াসুদ্দীন হাসান সজী । সঞ্জরের অন্তর্গত সিস্তান নামক স্থানে হযরত খাজা বুজুর্গ জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব ও বাল্যকাল সিস্তানেই তিনি অতিবাহিত করেন। যখন তার বয়স ১৫ বছর তখন তার আব্বা পরলােক গমন করেন। মরহুম আব্বার রেখে যাওয়া সম্পত্তির অংশ যা তিনি পেলেন তার পরিমাণ ধনী হওয়ার জন্য কম ছিল না। ( মারেফত কি এবং মারেফত কাকে বলে )

একদিন খাজা ইব্রাহিম (রঃ) নামের এক মজ্জুব (আল্লার প্রেমে উদাস বুজুর্গ) ভার আঙ্গুর বাগানে প্রবেশ করলেন। হযরত খাজা গরীব-উন-নওয়াজ মজ্জুবের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা নিবেদনের পর একগুচ্ছ তাজা আঙ্গুর তার খেদমতে পেশ করলেন। হযরত খাজা ইব্রাহিম অত্যন্ত সন্তুষ্ট চিত্তে আঙ্গুর ভক্ষণ করলেন এবং কুলির মধ্য থেকে কয়েকটা দানা বের করে স্বীয় দাত দিয়ে ভেঙ্গে হযরত খাজা বাবাকে খেতে দিলেন। তিনি দানা কয়টি খেয়ে নিলেন। খাওয়ার পরপরই তাঁর অন্তর্দৃষ্টি খুলে গেল এবং দুনিয়ার প্রতি বিতৃষ্ণা জেগে উঠলাে। এরপর তিনি তার সমস্ত সম্পত্তি খােদার রাস্তায় দান করে দিলেন এবং সত্যের সন্ধানে নিজের জন্মভূমি ত্যাগ করে বােখারায় চলে গেলেন। ( খাজা বাবার সম্পুর্ন জীবনী পড়তে এখানে ক্লিক করুন )

 

সে সময় বােখারা জ্ঞানার্জনের কেন্দ্র ছিল। সেখানে যেয়ে কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সম্পূর্ণ কোরান শরীফ মুখস্ত করে ফেললেন। অর্থাৎ হাফেজে কোরানের মর্যাদা অর্জন করলেন। কিন্তু বেশীর ভাগ লেখকের মতে তিনি তাঁর গ্রামের মকতবে ৭ বছর বয়সেই সম্পূর্ণ কোরান শরীফ মুখস্ত করে হাফেজ হওয়ার সম্মান লাভ করেন। তারপর অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা সমাপ্ত করে আল্লাহ রাম্বুল আলামিনের পথের পথিকদের অনুসন্ধানে বের হলেন।

 

ইরাকের অন্তর্গত নিশাপুর তখন ধর্মীয় ও বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রাণকেন্দ্র ছিল এবং এই নিশাপুরের অদূরে হারূন নামক স্থানে তখন প্রখ্যাত কামেল বুজুর্গ হযরত খাজা ওসমান হারুনী কুন্দেসা ছিররুহুল বারী-এর খানকাহ শরীফ ছিল। হযরত খাজা বাবা এই কামেল বুজুর্গের নিকট বয়াত গ্রহণ করে ধন্য হলেন। মুরিদ হওয়ার পর ২০ বছর তিনি স্বীয় পীরের খেদমতে নিয়ােজিত ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি ১২ বার তার মুর্শেদের সাথে দেশ ভ্রমণ করেন। তখন পায়ে হেঁটে চলা ব্যতীত অন্য কোন ভ্রমণ উপযােগী বাহন ছিল না, যার জন্য সব ভ্রমণগুলােই তারা পায়ে হেঁটে সম্পন্ন করেছেন।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী

প্রত্যেক ভ্রমণের সময়েই মুরশেদের প্রয়ােজনীয় মালপত্র স্বীয় মস্তকে বহন করে নিয়ে যেতেন। খেলাফতপ্রাপ্তি ও সাজ্জাদানশীন হওয়ার পর স্বীয় মুর্শেদ হতে বিদায় নিয়ে বাগদাদের আলিয়া মাদ্রাসায় উপস্থিত হলেন। পরে সরকারে দোজাহান হযরত রসূলে মকবুল (সাঃ)- এর নির্দেশে ৪০ জন সঙ্গীসহ হিন্দুস্থান অভিমুখে রওয়ানা হন। এ সময়ে হিন্দুস্থানে হিন্দুরাজাদের রাজত্ব এবং হিন্দু বসবাসকারীদের সংখ্যাই ছিল সবচে বেশি। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা ছিল নামমাত্র। হযরত খাজা হিন্দুস্থানে প্রবেশ করে প্রথমে লাহােরে দাতা গঞ্জেবস্ (রঃ)-এর মাজার শরীফে চল্লিশ দিন অবস্থান করেন। সেখান থেকে সরাসরি তিনি দিল্লিতে আগমন করেন এবং কিছুদিন অবস্থান করেন। ( খাজা বাবার সম্পুর্ন জীবনী পড়তে এখানে ক্লিক করুন )

 

এ সময় হতেই তিনি ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়ােগ করেন এবং হিন্দু ধর্মবিলম্বীদের প্রতি ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করে ইসলাম গ্রহণের অনুরােধ জানান। হিন্দুদের নিকট এ প্রস্তাব গ্রহণ করা দুঃসাধ্য হয়ে দেখা দেয়। তারা এ প্রচারের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তুলে এবং খাজা বুজুর্গের ক্ষতি সাধনে মনােনিবেশ করে। কিন্তু স্বয়ং আল্লাহ যার সহায় মানুষ তার কি করতে পারে? হিন্দুদের মধ্য হতে একজন শক্তিশালী যুবক হুজুরকে শহীদ করার জন্য মাহফিলে প্রবেশ করে। সংগে তার তীক্ষ্ণধার এক ছােরা লুকিয়ে রেখে সামনে এগিয়ে এসে সুযােগের অপেক্ষা করতে থাকে। হজুর তার মনােভাব বুঝতে পেরে সুধামিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, “চুপচাপ আছ কেন? ছুড়ি বের করে নিজের কাজ সমাধান কর অযথা সময় নষ্ট করে লাভ কি?” এ কথা শােনার সাথে সাথেই সে ভীত হয়ে পড়ল এবং খাজা বাবার এ অলৌকিক ক্ষমতা দেখে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ল এবং নিজের কৃতকর্মের জন্য হজুরের পায়ে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলাে। খাজা বুজুর্গ তাকে ক্ষমা করলেন। ( জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী )

 

তখন সে অত্যন্ত পবিত্র অন্তরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলাে। পরবর্তী সময়ে সে নিজেকে খাজা বাবার গােলামিতে আবদ্ধ করার সংকল্প ঘােষণা করলাে। এ সংবাদ অতি দ্রুত হিন্দু সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লাে। ফলে দলে দলে বিধর্মীরা এসে হজুরের নিকট ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে লাগলাে। (আল্হামদুলিল্লাহ)।

হিন্দুরাজাদের মধ্যে তখন পৃথ্বীরাজ ছিল খুব শক্তিশালী এবং তার রাজধানী ছিল আজমীরে। খাজা গরীব-উন-নওয়াজ তাই দিল্লি ছেড়ে আজমীর অভিমুখে রওয়ানা হলেন এবং যথাসময়ে আজমীর পেীছে প্রথমেই পৃথ্বীরাজকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য অনুরােধ জানালেন। কিন্তু এ সৌভাগ্য তার ললাটে ছিল না। তাই সে ঈমানও আনল না বরং পাল্টা আক্রমণ, নির্যাতন ও নানা প্রকার অসুবিধায় ফেলার জন্য যা যা করা দরকার তার কোন কিছুই বাকি রাখল না। প্রথম প্রথম ক্ষুদ্র শক্তি প্রয়ােগে কাজ না হওয়ায় পরে শাদী দৈত্যকে খাজা বাবার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলল এবং শাদী দৈত্য বিরাট বিরাট পাথর পাহাড়ের ওপর থেকে খাজা বাবার মজলিসের ওপর নিক্ষেপ করতে লাগলাে। কিন্তু খাজা বাবার ইশারায় পাথরগুলাে দূরে যেয়ে পড়তে লাগলাে। শাদী দৈত্য খাজা বাবার কোন ক্ষতি সাধনই করতে পারলাে না। এত বড় শক্তিশালী দৈত্যকে নিয়ােগ করেও যখন রাজা কোন সুবিধা করতে পারলাে না তখন হিন্দুস্থানের সর্বশ্রেষ্ঠ যাদুকর স্বীয় ভ্রাতা জয়পাল যােগীকে ডেকে পাঠালাে। ( জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী )

 

জয়পালের ছােট হতে বড় বড় সব যাদু যখন বিফল হলাে তখন সে তার সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ যাদু প্রয়ােগ করলাে কিন্তু তবু কোন কাজ হলাে না। জয়পাল অস্থির হয়ে উঠল এবং চিন্তা করতে লাগল এ লােক কোনু শক্তির অধিকারী, যার জন্য এ বিদেশীদের সামান্যতম ক্ষতিও সে করতে পারলাে না, তখন জয়পালের স্থির বিশ্বাস হলাে খাজা বুজুর্গ নিশ্চয়ই অলৌকিক-ঐশী শক্তির অধিকারী যা অন্য কোন ধর্মাবলম্বীদের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়। কেননা, সে জানতাে যে সারা ভারতবর্ষে এমন কোন শক্তিধর যােগী-তাপস নেই যে তার একটিমাত্র যাদুর মােকাবেলা করতে সক্ষম হবে। যার অগ্নিবাণ নিক্ষেপে পাথর পর্যন্ত স্কুলে যায়, অথচ এ কোন শক্তি বলে বলিয়ান যার কাছে সমস্ত যাদুই ধুলিস্যাৎ হয়ে গেলাে!

সমস্ত ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পেরে জয়পাল গরীবে নওয়াজের মজলিসে প্রবেশ করলাে এবং খাজা বাবার কদম মােবারকে মস্তক রেখে ইসলামের নিকট আত্মসমর্পণ করলাে । ইসলাম গ্রহণ করার পরে জয়পাল আবদুল্লাহ নাম গ্রহণ করে নিজেকে খাজা বুজুর্গের একজন প্রধান খাদেম হিসেবে নিয়ােজিত রাখার সৌভাগ্য অর্জন করলেন। জয়পালের যােগসাধনার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল অমরত্ব লাভ করা। খাজা গরীব-উন-নওয়াজ তার মনের অভিপ্রায় জানতে পেরে রাবুল আলামিনের দরবার হতে তার এ প্রার্থনা মঞ্জুর করিয়ে আনলেন। তখন হতে তার মর্যাদা হলাে “খিজিরে বিয়াবান” (বন জঙ্গলের খিজির) এবং বিয়াবান শব্দটি নামের সাথে যুক্ত হয়ে নাম হলাে আবদুল্লাহ বিয়ানী। এরপর হতে তিনি আবদুল্লাহ বিয়ানী নামেই খ্যাত। ভারতের অন্তর্গত মধ্যপ্রদেশের কুরুপাণ্ডবে অবস্থিত একটা পাহাড়ী জঙ্গল (সেটা এখন আবদুল্লাহ বিয়ানের জঙ্গল নামে পরিচিত), সেখানে তার আস্তানাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর ফারুনে বিরাট মেলা বসে এবং প্রথম বৃহস্পতিবার ফাতেহা হয়। পৃথ্বীরাজের সমস্ত লােকজন ঈমান আনলেও পৃথ্বীরাজ কিন্তু ঈমান আনল না। অবশেষে খাজা বুজুর্গ দুঃখিত হয়ে পৃথ্বীরাজকে লিখে পাঠালেন, “মা তুরা জিন্দাহ মুসলমানানে সপরদেম।” অর্থ-আমরা জীবিত বন্দী অবস্থায় তােমাকে মুসলমানদের হাতে অর্পণ করলাম।” ( মারেফত কি এবং মারেফত কাকে বলে )

এ চিঠি দেয়ার পরপরই সুলতান শাহাবুদ্দীন মােহাম্মদ ঘােরীর সাথে পৃথ্বীরাজের যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ জীবিত বন্দী হয়। পরে তাকে হত্যা করা হয়। খাজা বাবা জীবনের চল্লিশটি বছর হিন্দুস্থানের মাটিতে স্রষ্টার সৃষ্টিকে সঠিক পথে নিয়ােজিত করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। লক্ষ লক্ষ বিধর্মী নরনারী স্বেচ্ছাপ্রণােদিত হয়ে ইসলামের মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে হযরত খাজা বুজুর্গকে পাওয়ার আশায় তার হাতে হাত রেখে ইসলামের প্রতি ঈমান এনে মুসলমান হয়েছে এবং হযরত খাজা বাবার গােলামি লাভ করে গৌরবান্বিত হয়েছে। ৬৩৩ হিজরীর ৬ই রজব রােববার দারুল খায়ের, আজমীর শরীফে হযরত খাজা বুজুর্গ ইহলােক বর্জন করেন (তাঁর বেসাল শরীফ অর্থাৎ মহামহিমের সাথে মহামিলন ঘটে)। রুহ মােবারক দেহত্যাগ করার পর তার পেশানী মােবারকে (ললাটে) নূরের অক্ষরে লেখা ছিল “মাতা হাবীবুললাহ ফি হুব্বিল্লাহু” অর্থাৎ খােদার প্রেমে খােদার বন্ধু বিদায় নিল। ( খাজা বাবার সম্পুর্ন জীবনী বানী এবং উপদেশাবলী পড়তে এখানে ক্লিক করুন )

 

রওজা মােবারক আজমীর শরীফের দারুলখায়েরে জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল দর্শনপ্রার্থীদের জন্য আজও উন্মুক্ত রয়েছে। আল হামদুলিল্লাহ আলা জালেক।

ম্যায় গােলাম। খাজাকা তলব কি রাহুমে হাম জিত্ কা সার্মা সমঝতে হ্যায়। দ্বারে খাজা কো বাবে মনজিলে ইরফান সমঝুতে হায় খােদাওন্দে জাহাঁ কে লুছে খাজা ইয়ে দিওয়ানে তােমহারে নাম কো ভি ম্যায় ইমা সমঝতে হয়। নিগাহোঁ মে তােমহারি হায় হাদীসে মুস্তফা খাজা তােমহারি গােতােগা কো শারহে কোৱা সমঝুতে হ্যায় হামে খাজা হে উলফাত হায়, গােলামে সনজরী হাম হ্যায় হর এক মুশকিল কো আপনি জিত মে আসা সমতে হায়। ইয়ে মানা, আয়ে মুঈনুদ্দীন! তুমছে দূর হ্যায়, লেকিন তােমহে হর ওয়াক্ত আপনে দিল মে হাম মেহম সমতে হ্যায় ।

 

– মনসুর আজমেরী

আমি খাজার গােলাম। অনুসন্ধানের পথকে আমি জীবন উপকরণ মনে ক। খাজার দরবারকে পরিচয়ের ঠিকানা মনে করি। খােদার জগতে প্রেমে, খাজা আমি দিওয়ানা। তােমার নামকেও ঈমানের মূল মনে করি। তােমার দৃষ্টিতে আছে মােস্তফার হাদীস, হে খাজা, তােমার প্রবচনকে কোরানের সারমর্ম মনে করি। প্রেমিক আমি খাজার গােলাম সনজরীর দুঃখকষ্ট প্রতিটিকে, তােমার স্মরণে সহজ মনে করি। মানি, আছি আমি তােমা হতে বহু দুরে হে মুঈনুদ্দীন, কিন্তু মেহমান তুমি মাের অন্তরে সতত।

 

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) এর সম্পূর্ণ জীবনী পড়তে এখানে ক্লিক করুন।