আবু হামিদ আল-গাজ্জালীঃ ইমাম গাযালী (র)-এর নাম মুহাম্মাদ। ডাকনাম আবু হামেদ। পিতার নামও মুহাম্মাদ ছিল। তুস জেলায় ৪৫০ হিজরীতে তাহিরান নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার ওসিয়ত মুতাবেক তাঁর এক বন্ধু—যিনি একজন একনিষ্ঠ ‘ইলম-দোস্ত ও সূফী গরীব মুসলমান ছিলেন-তাঁর শিক্ষার বন্দোবস্ত করতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন এবং তাকে কোন মাদরাসায় ভর্তি হবার পরামর্শ দেন। অনন্তর তিনি একটি মাদরাসায় ভর্তি হয়ে শিক্ষা অর্জনে আত্মনিয়ােগ করেন।
ইমাম গাযালী (র) স্বদেশে শায়খ আহমাদ আর-রাযেকানীর নিকট থেকে শাফিঈ মযহাবের ফিকাহশাস্ত্রে তা’লীম হাসিল করেন। এরপর জর্দানে ইমাম আবু নসর ইসমাঈলীর নিকট পড়াশুনা করেন। এরপর নিশাপুর গিয়ে ইমামুল হারামায়নের মাদরাসায় ভর্তি হন এবং অতি অল্পদিনেই তিনি তার ৪০০ সহপাঠীর মধ্যে একটি বিশিষ্ট আসন লাভ করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর খ্যাতিমান উস্তাদের সহযােগী (নায়েব)-তে পরিণত হন, এমন কি ইমামুল-হারামায়ন তার সম্পর্ক বলতেন, “গাযালী (র) হলেন গভীর সমুদ্র।” ইমামুল-হারামায়ন-এর ইনতিকালের পর তিনি নিশাপুর থেকে বহির্গত হন। সে সময় তাঁর বয়স ছিল ২৮ বছর, অথচ তখনাে তাকে বড় বড় বর্ষীয়ান ‘উলামা’র চেয়ে অধিকতর বিশিষ্ট ও কামালিয়তের অধিকারী মনে করা হত।
এর পর ইমাম গাযালী (র) নিজামুল-মুলকের দরবারে যান। তাঁর খ্যাতি ও বিশেষ যােগ্যতার কারণে নিজামুল-মুলক তাকে অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধা সহকারে দরবারে গ্রহণ করেন। এখানে ছিল দুর্লভ রত্নসম। জ্ঞানী-গুণীদের সমাবেশ। জ্ঞানের আলােচনা ও ধর্মীয় মুনাজারা (বিতর্ক) তখনকার দরবার, মজলিস, এমন কি বিবাহানুষ্ঠান ও শােক সভারও একটি অপরিহার্য অঙ্গ ছিল। ইমাম গাযালী (র) যাবতীয় বিতর্ক আলােচনায় সকলের ওপর জয়ী হতেন। তাঁর অতুলনীয় যােগ্যতাদৃষ্টে নিজামুল-মুলক তাঁকে নিজামিয়া মাদরাসার অধ্যক্ষ হিসাবে মনােনীত করেন, যা ছিল সে যুগে একজন ‘আলিমের জন্য সম্মান ও মর্যাদার সর্বোচ্চ সােপান। সে সময় গাযালীর বয়স ৩৪ বছরের বেশী ছিল না।
৪৮৪ হিজরীতে তিনি বিরাট শান-শওকতের সঙ্গে বাগদাদে প্রবেশ করেন এবং নিজামিয়ায় পাঠ দান শুরু করেন। অল্পদিনেই তাঁর যােগ্য শিক্ষকতা, উত্তম আলােচনা ও জ্ঞানের গভীরতার কথা সারা বাগদাদে ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্র- শিক্ষক ও জ্ঞানী-গুণী তার বিদ্যাবত্তা থেকে উপকৃত হবার জন্য চতুর্দিক থেকে নিজামিয়ায় এসে ভীড় জমাতে লাগল। তার দরূস-মাহফিল গােটা মনুষ্যকুলের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়। তিন শ’র মত সমাপ্ত পর্যায়ের ছাত্র, শত শত আমীর-উমারা’ ও রঈস এতে শরীক হতেন। ক্রমে ক্রমে তার উন্নত মস্তিষ্ক ও মেধা, ইলমী ফযীলত ও শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব বাগদাদে এমন প্রভাব-প্রতিপত্তি সৃষ্টি করে যে, তিনি সাম্রাজ্যের নেতৃস্থানীয় সদস্যবর্গের সমমর্যাদা লাভ করেন।
তাঁর সম্পর্কে তাঁর সমসাময়িক শায়খ আবদুল গাফির ফারসী বলেন, “তার জাকজমক ও আড়ম্বরের সামনে আমীর-উমারা’, উযীর, এমন কি স্বয়ং দরবারে খিলাফতের শান-শওকত পর্যন্ত নিষ্প্রভ হয়ে যায়। এমনি সময়ে ৪৮৫ হিজরীতে তাকে ‘আব্বাসী খলীফা মুক ‘তাদী বিল্লাহ মালিক শাহ সালজুকীর বেগম তুর্কান খাতুনের নিকট (যিনি সে সময় সাম্রাজ্যের হর্তা-কর্তা ছিলেন) স্বীয় দূত বানিয়ে পাঠান। খলীফা মুক ‘তাদী বিল্লাহর স্থলাভিষিক্ত খলীফা মুস্তাজহির ইমাম গাযালী (র)-এর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রাখতেন এবং তার একনিষ্ঠ ভক্ত ও অনুরক্ত ছিলেন। তারই নির্দেশে ইমাম গাযালী (র) বাতেনী মতবাদের বিরুদ্বে কিতাব লিখেন এবং খলীফার সঙ্গে সম্পর্কিত করে এর নাম রাখেন ‘মুস্তাজহিরী।
এগার বছরের চলমান জীবন এবং এর অভিজ্ঞতা:
এই চরম উন্নতি ও উত্থানের স্বাভাবিক দাবি ছিল যে, ইমাম গাযালী (র) এতে তৃপ্তি লাভ করবেন এবং এই বৃত্তের মাঝেই তিনি তার গােটা জীবন কাটিয়ে দেবেন, যেমনটি তার কতক উস্তাদ করেছেন। কিন্তু তার অস্থির স্বভাব ও প্রকৃতি, উন্নত মনােবল, দুরন্ত সাহসিকতা উন্নতির এই চরম পর্যায়েও তাকে সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত রাখতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে এই উন্নত মনােবল ও হিম্মতই তাঁকে ইমাম’ ও ‘হুজ্জাতুল-ইসলাম বানিয়েছিল। দুনিয়াতে জাঁকজমক, আড়ম্বর, সম্মান ও পদবীর কুরবানী এবং স্বীয় উদ্দেশ্যের প্রতি একাগ্রতা ও সত্যের প্রতি আকর্ষণের এমন দৃষ্টান্ত বিরল। ইমাম গাযালী (র) স্বয়ং সেসব অবস্থা ও কার্যকারণ বর্ণনা করেছেন যা তাকে এমন পদক্ষেপ গ্রহণে উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং যা তাকে টেনে বের করেছিল শিক্ষা ও দরস প্রদানের কাজ থেকে। যা হােক, শেষ পর্যন্ত তিনি জ্ঞান রাজ্যের বাদশাহী ছেড়ে নিশ্চিত জ্ঞান ও ইন্দ্রিয়াতীত সম্পদের তালাশে বেরিয়ে পড়েন এবং স্বীয় লক্ষ্যে কামিয়াবী লাভ করেন। ‘Al-Munkiju Minaddalal” নামক গ্রন্থে তিনি এ সম্পর্কে লিখেছেন :- বিস্তারিত পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
To read Imam Gazzali Biography in English CLICK here