Select Page
মারেফতের জ্ঞান কিভাবে অর্জন করতে হয় বা আধ্যাত্বিকতা জাগরনের পদ্বতি।

মারেফতের জ্ঞান কিভাবে অর্জন করতে হয় বা আধ্যাত্বিকতা জাগরনের পদ্বতি।

মারেফতের জ্ঞান কিভাবে অর্জন করতে হয়ঃ সৃষ্টিগত ভাবে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে মারেফত বা আধ্যাত্বিকতা লুকায়িত রয়েছে। কারন আমাদের প্রত্যেকের উৎপত্তি পরমাত্মা থেকে। আর আধ্যাত্বিকতার মুল হচ্ছে পরমাত্মা। কিন্তু মারেফত বা আধ্যাত্বিকতা সকলের মধ্যে প্রকাশ পায়না। যাদের মন যতটুকু পরিমান পরমাত্মার নিকটে অবস্থান করে ততটুকু পরিমান আধ্যাত্বিকতাই তাদের মধ্যে জাগরিত হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে পৃথিবিতে খুব অল্প সংখ্যক লোকের মনের ভাব পরমাত্বার ভাবের কাছাকাছি রয়েছে। আর যাদেরই বা কাছাকাছি রয়েছে তাও খুব অল্প ভাব। কারন মানুষের ভাবনা পরমাত্মার দিকে যেতে চায় না। মানুষ পরমাত্মার ভাবনা ভাবতে চায় না। মনুষ ভাবতে চায় না তার মূল কোথায়? সে কোথা থেকে এসেছে? তাই মানুষ তার মূল পরমাত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ফলে তাদের মনে আধ্যাত্বিকতাও জাগ্রত হয় না।

মোটকথা যে যতটূকু পরমাত্মার সাথে বা সৃষ্টির মুলের সাথে সংযুক্ত রয়েছে তার ততটুকু আধ্যাত্বিকতা রয়েছে। আর আমাদের সাথে পরমাত্মার বা সৃষ্টির মূলের সম্পৃক্ততা নেই বলে আমাদের আধ্যাত্বিক জাগরনও হয় না।

মারেফত

আর কারো খুব অল্প আকারে মারেফতের জ্ঞান বা আধ্যাত্বিকতা জাগরিত হয়। আবার কারো একটু বেশি জাগ্রত হয়। তবে চুরান্ত পর্যায়ে জাগ্রত হয় কেবল মহাপুরুষদের মাঝে। আর এই পৃতিবীতে মহাপুরুষ বড়ই দুর্লভ। তবে যার মধ্যে যতটুকু মারেফতের জ্ঞান বা আধ্যাত্বিকতা জাগরিত হয় ততটুকুকে লালন করে আস্তে আস্তে আধ্যাত্বিকতা বাড়াতে হয়। কারন আধ্যাত্বিকতা জাগরন কোন সাধারন বিষয় নয়। এটা সৃষ্টিগত ভাবে মনের মধ্যে থাকতে হয়। আর সৃষ্টিগত ভাবে মনের মধ্যে না থাকলে এটা জাগানো সম্ভব নয়।

উপরে উল্লেখিত কথাগুলি সকলের জন্য প্রযোজ্য নয়। এটা শুধু উচু স্তরের সাধকদের বেলায় প্রযোজ্য। কারন আধ্যাত্বিকতার চুরান্ত পর্যায়ে পৌছার অনুভুতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এটা বর্ণনা দেওয়াও সম্ভব নয়। যে ঐ স্তরে পৌছেছে কেবল সেই তা বুঝতে পারবে। এই জন্য আধ্যাত্বিক মহাপুরুষ জালাল উদ্দিন রুমি (রহ) বলেছেন, যদি সূর্য পৃ্থিবীর কাছে চলে আসে পৃথিবী তা সহ্য করতে পারবে না। পৃথিবী জ্বলে পুরে ছারকার হয়ে যাবে। সেই রুপ ভাবে মানুষের হৃদয়ে যদি হঠাৎ উচু স্তরের আধ্যাত্বিকতা প্রকাশ পায় তাহলে মানুষ সহ্য করতে পারবেনা। মানুষের হৃদয় জ্বলে পুরে ছারকার হয়ে যাবে।

উপরের কথাগুলি এইজন্য বললাম যে, আমরা আধ্যাত্বিকতার অল্প অনুভুতি পেয়েই মনে করি যে, এটাই বুঝি আধ্যাত্বিকতার পরিপক্কতা। না এটা মোটেই না। এটা আধ্যাত্বিকতার ছুয়া মাত্র। আমি আগেই বলেছি পূর্ণ আধ্যাত্বিকতা কোন সাধারন বিষয় নয়। পবিত্র মহাগ্রন্থ গীতাতে বলা হয়েছে, সাধুকুলে জন্ম লাভ করা দুর্লভ জনম। অর্থাৎ একজন আধ্যাত্বিক মহাপুরুষের সংস্পর্শে থাকাই দুর্লভ বা পরম সৌভাগ্যের বিষয়। তাহলে পুর্ন আধ্যাত্বিকতা লাভ করা যে কত বড় দুর্লভ বিষয় তা একটু ভেবে দেখুন।

তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমাদের হৃদয়ে আধ্যাত্বিকতা যদি জাগরিত নাও হয় তবুও বার বার শ্রেষ্টা করা উচিত। কারন জাগ্রত করার শ্রেষ্টা করাও পরম সৌভাগ্যের বিষয়। পৃথিবীতে কয়জনই বা এর শ্রেষ্টা করে।

মারেফতের জ্ঞান বা আধ্যাত্বিকতা জাগরনের পদ্ধতি এবং মারেফত কিভাবে অর্জন করতে হয়।

১। পজেটিভ চিন্তা চেতনাঃ

মানুষ কর্মমুখী। কর্ম করেই মানুষকে বাঁচতে হয়। কিন্তু কর্মের মূলে রয়েছে চিন্তা চেতনা বা মনের ভাব। মানুষের প্রত্যেকটি কর্মের মূলে যেন

পজেটিভ চিন্তা থাকে। মানুষ যেন সব সময় সৎ চিন্তা করে। মানুষ যেন সবসময় নিজের সার্থের কথা চিন্তা না করে পরার্থে নিজেকে বিলিয়ে দেয়। মানুষের কোন কর্ম বা চিন্তাই যেন তার নিজের স্বার্থের জন্য না হয়। মানুষ যেন অসৎ চিন্তা থেকে দূরে থাকে। কারন মানুষের মনের প্রিত্যেকটি চিন্তাই মনের মধ্যে স্তরে স্তরে জমা হতে থাকে। আর স্তরে স্তরে জমাকৃত পজিটিভ চিন্তার সমষ্টি যদি অধিক পরিমান হয় তবেই মানুষের মনের মধ্যে আস্তে আস্তে আধ্যাত্বিকতা জাগরিত হতে শুরু করে।

২। ধ্যানঃ

আধ্যাত্বিক জাগরনের জন্য ধ্যান হচ্ছে অন্যতম শক্তিশালী পদ্ধতি। সৃষ্টির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যত মহাপুরুষ পৃথিবীতে এসেছেন তাদের জীবনী থেকে জানা

ধ্যানযায় যে তারা প্রত্যেকেই জীবনের কোন না কোন সময়ে ধ্যান সাধনা করেছেন। যেমন ইসলাম ধর্মের প্রচারক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) একটানা ১৫ বছর হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যান সাধনা করেছেন। বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারক গৌতম বুদ্ধ সারাজীবন ধ্যান সাধনা করেছেন। হিন্দু ধর্মের গীতাতে ধ্যান সাধনার উপরেই সবছেয়ে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মোট কথা আধ্যাত্বিকতা জাগরনের সবছেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হচ্ছে ধ্যান। ধ্যানের দ্বারাই মানুষ তার নিজের মধ্যে আধ্যাত্বিক জাগরন ঘটাতে পারে।

৩। নিজেকে প্রকৃতিতে বিলিন করে রাখাঃ

এমন ভাবে জীবন যাপন করা যেন জীবনে নিজের কোন ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা না থাকে। সবই যেন প্রকৃতির ইচ্ছা।প্রকৃতির ইচ্ছায় যেন আমরা বেছে আছি। আমার বাড়ী আমার গাড়ী এগুলো যেন কিছুই আমার নয়। এগুলোর প্রতি যেন আমার আধিক মায়া বা আকর্ষন না থাকে।মারেফত আমার বলতে যেন কিছুই নাই। আমি যেন অল্প কয়েকদিনের জন্য এখানে এসেছি। এভাবেই প্রকৃতির কাছে নিজেকে সোপর্দ করতে হবে।এভাবেই নিজের ইচ্ছা আকাঙ্খাকে প্রকৃতির কাছে বিলিন করে দিতে হবে, তবেই মনের মধ্যে আস্তে আস্তে আধ্যাত্বিকতা জাগরিত হবে।

৪। শ্বাস-প্রশ্বাস এর অনুসরনঃ

জন্ম লগ্ন থেকেই আমরা মনের আজান্তে প্রতিনিয়ত শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ে চলছি। এই শ্বাস প্রশ্বাস আদান প্রদান আমাদের জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে ঘটতে থাকে। শ্বাস প্রশ্বাস এর সাথে মনের ভাবের সম্পর্ক রয়েছে। আর মনের ভাবের সাথে আধ্যাত্বিকতার সম্পর্ক রয়েছে। আর যখনই শ্বাস প্রশ্বাস এর অনুসরন করবেন তখনই মন অন্য বিষয় ভাবনা থেকে বিরত হতে শুরু করবে। তখন মন আত্মমুখী হবে।মারেফত

এভাবে মনকে বাহিরের ভাবনা থেকে আত্মমুখী করে তুললে আস্তে আস্তে আধ্যাত্বিকতা জাগরিত হতে শুরু করবে। প্রশ্ন আসতে পারে এটা আপনি কখন করবেন? আপনি প্রতিদিন যে কোন সময় এটা করতে পারেন। যত বেশি করবেন তত ভালো। পারলে সারা দিনই করতে পারেন। কারন এটাতে কাজের কোন ব্যাঘাত ঘটেনা।

৫। গুরু ধ্যান

গুরু ধ্যান হলো মারেফত জাগরনের আরেকটি অন্যতম পদ্বতি। যুগ যুগ ধরে গুরু ধ্যান এর মাধ্যমে তাপসগন আধ্যাতিকতা জাগরন করে আসছেন। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে গুরু ধ্যান পদ্বতি খুবই জনপ্রিয়। বিশেষ করে ইন্ডিয়াতে এর প্রচলন সবছেয়ে বেশি। খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তি বু আলীশাহ কলন্দর, আমির খছরু নিজামুদ্দিন আউলিয়া সবাই গুরু ধ্যান এর মাধ্যমে আধ্যাতিকতার উচ্চ শিখরে আরোহন করেছিলেন। আবার মধ্যপ্রাচ্যে ও যে সব মহাপুরুষ আধ্যাতিকতার উচ্চ শিখরে পৌছেছিলেন তারা ও এ পদ্বতির মাধ্যমে উচ্চ শিখরে পৌছেছিলেন। আব্দুল কাদের জিলানী,জালাল উদ্দিন রুমি,ইমাম গাজ্জালী তাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের লালন সাঁই লিখাতে গুরুবাদ এর ধারনা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।

হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) এর জীবনী-বানী ! গরীবে নেওয়াজ এর কারামত

হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) এর জীবনী-বানী ! গরীবে নেওয়াজ এর কারামত

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী পরিচিতি ও ইতিহাস পাঠে জানা যায়, যে সকল মহান ব্যক্তির অক্লান্ত কর্ম প্রচেষ্টার ফলে বঙ্গ-ভারতে সােনালী ইসলামের নির্মল আদর্শ প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ সম্ভব হয়েছে, তাদের মধ্যে রূহানী জগতের খাটি প্রজ্ঞাদাতা সূফী কুলের শিরােমণি মর্দে মুজাহিদ হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) এর নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়।

একথা বাস্তাব সত্য যে তিনিই সাধক কুলের সম্রাট সুফীবৃন্দের গৌরব, তাপসগণের শিরমণি ইসলামী রেনেসাঁর অগ্রনায়ক হযরত মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহতার বিচিত্র জীবন কাহিনী ধ্যানােপাসনার জন্য প্রেরণাদানকারী হিসাবে আমাদের নিকট খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ইতিহাসের পাতা খুললে আমরা দেখতে পাই ইসলামের জন্য তার আত্মত্যাগ তাকে ইতিহাসের সােনালী পাতায় অবিস্মরণীয় করে রেখেছে। সত্যি কথা বলতে কি তার জীবন কাহিনী বহু কর্তি ও সাধনা সমৃদ্ধ ছিল। আলেম কুলের শিরমণি হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ সােনালী ইসলামের নির্মল আদর্শ প্রচারে বহু বাধা বিপত্তির সম্মুখিন হয়ে শেষ পর্যন্ত সফলতার স্বর্ণ শিখরে আরােহণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

ঐতিহাসিকগণ বলেন, বঙ্গ-ভারতের ইসলাম প্রচারেখাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) যে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন, তাহা ইতিহাসের পাতায় চিরকাল অম্লান হয়ে থাকবে। তাকে কেন্দ্র করে অনেক উপাখ্যান রচিত হয়েছে। পরিশেষে আমরা এইরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে সত্যের সৈনিক হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) এমন একজন আদর্শ স্থানীয় মানুষ ছিলেন যে পার্থিব ভােগ বিলাসিতা দূরের কথা কৃচ্ছ সাধনায়ই কেটে ছিল তা সারাজীবন। ইতিহাসবেত্তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে জানা যায়, আলেম কুলের শিরমণি হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ-এর হাতে অসংখ্য মুসলমান ও অমুসলমান বাইয়াত গ্রহণ করে নিজেদের জীবন ধন্য করেছেন। ( মারেফত কি এবং মারেফত কাকে বলে )

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী
খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী

জন্ম ও বংশ পরিচয় :-

 

রূহানী জগতের খাটি প্রজ্ঞাদাতা হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী সাহেবের জন্ম হয় সিস্তানের গনজর পল্লীতে। ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিকোণ থেকে জানা যায়, তার পিতা খাজা গিয়াসুদ্দীন ছিলেন একাধারে খােদাভক্ত আবেদ এবং বিত্তশালী ব্যক্তি। তিনি সর্বদা কুরান ও সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন যাপন করতে চেষ্টা করতেন। সুতরাং খাজা সাহেব বাল্যকালে অত্যন্ত যত্ন ও স্নেহের সাথে প্রতিপালিত হয়ে ছিলেন। হযরত খাজা মঈনুদ্দীন হাসান চিশতী সানজারী রহমাতুল্লাহ পবিত্র আরবের সুবিখ্যাত কুরাইশ বংশদ্ভূত হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুর নিম্নতর বংশধর ছিলেন। ইতিহাস পাঠে জানা যায়, তিনি মাতৃ বংশসূত্র ও পিতৃ বংশসূত্র উভয় দিক দিয়াই সত্যের সৈনিক শেরে খােদার সহিত ওঁতপােতভাবে জড়িত ছিলেন। সত্যের সেনানী হযরত খাজা গরীবে নেওয়াজ মঈনুদ্দীন হাসান চিশতী রহমাতুল্লাহ এর জন্ম সাল ও তারিখ সম্বন্ধেও সুসাহিত্যিক লেখকদের মধ্যে বেশ মত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। ( জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী )

১। সিয়ারুল আকতারের লেখকের মতে সত্যের অগ্রনায়ক হযরত খাজা গরীবে নেওয়াজ রহমাতুল্লাহ এর জন্মসাল হল ৫৩৭ হিজরী। তিনি বহু চিন্তা ভাবনা যুক্তি তর্ক ও বিস্তারিত আলােচনার পর তার জন্ম দিন হিসাবে ৫৩৭ হিজরী সালের ১৪ই রজব সােমবারকে মনােনয়ন করেছেন এবং তিনি, এ কথা বলেছেন যে সুফীকুলের শিরমণি ইসলামী রেনেসাঁর অগ্রনায়ক খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ উক্ত তারিখেই ধরাধামে আগমন করেছেন।

২। অন্যদিকে খাজা সাহেবের রহমাতুল্লাহ সাল ও তারিখ সম্বন্ধে প্রসিদ্ধ গ্রন্থ সজিনাতুন আসফিয়ার-এর লেখক উল্লেখ করেছেন যে, আলেম কুলের শিরমণি হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) হিজরী ৫৩০ সনের ১৪ই রজব সােমবার বােহে সাদিকের সময় এ ধরাধামে আগমন করেছেন। উক্ত আলােচনা হতে অনুধাবন করা যেতে পারে যে, উভয় লেখকই দুইটি বিষয়ে একমত এবং একটি বিষয়ে ভিন্নমত পােষণ করতেছেন। যে বিষয়দ্বয়ে তারা একমত প্রকাশ করেছেন তাহা হল ১৪ই রজব এবং সােমবার। কিন্তু সনের ক্ষেত্রে উভয় এমন মত পােষণ করেছেন যে এখন দুই মতের মধ্যে সাত বছরের ব্যবধান রয়েছে। তবে খাজা গরীব নেওয়াজ রহমাতুল্লাহ যে কোন সালেই জন্মগ্রহণ করুন না কেন, ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামী ব্যান্ডকে সমুন্নত করবার জন্য তিন যে অবদান রেখে গেছেন তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে।

ইতিহাস পাঠে জানা যায়, সৈয়দা উমমুল ওয়ারা গর্ভাবস্থায় অনেক নেক স্বপ্ন দেখেছিলেন। এমনও দেখা গেছে বহু সময় তিনি নিজের স্বপ্নের কথা সলজ্জভাবে স্বামী হযরত খাজা গিয়াসুদ্দীন রহমাতুল্লাহ এর নিকট ব্যক্ত করতেন। পূন্যবান ও বিচক্ষণ স্বামী তাকে নানাভাবে প্রবােধ দান করতেন এবং মনে মনে ভাৰী সুসন্তানের চন্দ্র মুখ দেখবার প্রত্যাশায় উৎফুল্ল হয়ে উঠতেন। | সত্যি কথা বলতে হয়, একদিন তাদের বাসগৃহে উজ্জ্বল করে রূহানী জগতের খাটি প্রদাতা সত্যের দিশারী খাজা গরীব নেওয়াজ রহমাতুল্লাহ ধরাধামে পদার্পন করেন। তার আগমনে সারা পরিবারে আনন্দের ফোয়ারা ছুটলো। ইতিহাস বেত্তারা বলেন, তার আগমনের তিন কিংবা সাত দিন পর, নবজাত শিশুর নাম রাখা হয় মঈনুদ্দীন কিন্তু বিবি উম্মু ওয়ার ও খাজা গিয়াসুদ্দীন রহমাতুল্লাহ তাকে হাসান নামেই ডাকতেন। যার কারণে ইতিহাস বেত্তারা এ জীবনীকার হাসান-শব্দটিকে তার আসল নামের সহিত সংযুক্ত করে তার নামকে মঈনুদ্দীন হাসান বলে উল্লেখ করেন।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী
খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী

বাল্য জীবনঃ

ইসলামের দিশারী সুফীসুধক হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) এর বয়স যখন সাত বৎসরে উপনিত হয়েছে, তখন হতেই তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়মিত আদায় করতেন। শুধু নামাজ আদায় করে ক্ষ্যান্ত হতেন না। এই বাচ্চা বয়সে তিনি নিয়মিত রােজা রাখতেন ও জিকিরের মজলিসে যােগ দিতেন। যদি কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কথা তার কানে আসত, শুনিমাত্রই তিনি বাধাবিপত্তি পেরিয়ে মজলিসে অংশগ্রহণ করতেন। প্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণ একটু চিন্তা করলেই অনুধাবন করতে পারবেন যে, খাজা মঈনউদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ বাল্যকালে কতদূর খােদাভীতি অর্জন করেছিলেন, যাহা নিম্নের ঘটনার দ্বারাই প্রতিফলিত হবে।

একদা তিনি স্বীয় পিতার সাথে ঈদের নামাজ পড়তে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন, এহেন সময় পথিমধ্যে এক অন্ধ ও অসহায় বালককে ময়লা ও ছেড়া কাপড় পরিধান করে নামাজ পড়তে দেখলেন। সত্যি, খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ, উহা দেখিবামাত্রই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। ইহাতে তার হৃদয়ের মনিকোঠায় এক অজানা ব্যথার উদয় হল। তিনি এ বালকের অবস্থা দেখতে দাঁড়ায়ে বহুক্ষণ চিন্তা করলেন। ইতিহাস বেত্তারা বলেন, তাপৰ পিতার অনুমতি ও নির্দেশের অপেক্ষা না করে নিজের পরিধেয় নতুন বস্ত্র খুলিয়া অন্ধ বালকটিকে পরিধান করালেন এবং হরষিত চিত্তে মহান করুণার আধার আল্লাহ জাল্লা শানুর শুকুরিয়া আদায় করলেন এবং নিঃস্ব অবস্থায় ঈদের নামাজ আদায় করে মনের হয়ে নিজ গৃহে প্রতীত্যন করলেন। হানী জগতের খাটি প্রজ্ঞাদাতা হযরত খাজা মঈনউদ্দি চিশতী রহমাতুল্লাহ এর সমুদয় কার্য কলাপই হযরত খাজা গিয়াসুদ্দীন (রাঃ) অদূরে থেকে নিরীক্ষণ করলেন, এবং মনে মনে বিশ্বনিয়ন্তা আল্লাহ রাব্দুল আলামীনের শুকর গুজারী করলেন।

উপসংহারে একথা বলা যেতে পারে যে, সূফী সাধক আলেম কুলের শিরমণি হযরত খাজা মঈনউদ্দিন চিশতী রহমাতুল্লাহ ইসলামের ইতিহাসের তথা ইতিহাসের পাতায় চির ভাস্কর হয়ে থাকবেন, তা তার বাল্যকালের প্রতিভা, চালচলন থেকেই প্রকাশ পেয়েছিল। ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে, হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী রহমাতুল্লাহ ছিলেন দুনিয়ার গছে আজম, কুতুবুল আক্তার এবং সমগ্র জিল ও ইনসানগণের পথ প্রদর্শক। তিনি যে বেলায়েতী গগনের দীপ্তিমান সূর্যস্বরূপ হবেন তা তার বাল্যকালেয় প্রতিচ্ছৰি থেকেই অনুধবন করা যেত। ইসলামের ইতহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায়, তিনি মাতৃ গর্ভ হতে তিনি অলীরূপে ভূমিষ্ট হয়েছিলেন। ( জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী )

একথা বাস্তব সত্য যে শিশুকাল হতেই তিনি অকল্পনীয় কারামত এবং ঐশী, ক্ষমাসমূহের অধিকারী ছিলেন। একথাও শুনা যায় কেবলমাত্র যখন সাত বৎসর বয়সে উপনিত হয়েছিলেন এ সময় তিনি অর্থসহ ঐশীগ্রন্থ আল কোরান হেফজ করেন। অল্প দিনের মধ্যে তিনি ইলমে হাদীস ও ইলমে ফেকাতত পান্ডিত্ব অর্জন করেন। প্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণ শুনলে অবাৰ হবেন সত্যের অগ্রনায়ক খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী রহমাতুল্লাহ মাত্র পনের বছর বয়সে এলমে তাছাউফ তত্ব সম্পর্কিত একখানা মূল্যবান গ্রন্থ তক্ত প্রণীত হয়েছিল। বাল্যকালের এসব নিদর্শন থেকেই প্রমাণ করেছিল যে তিনি ইসলামের একজন অলী হবেন।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী

ত্রিজীবন ও অধ্যবসায়ঃ

যে ব্যক্তি এলমে দ্বীন হাসিলের উদ্দেশ্যে বের হয়, ফিরে আসার পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহর পথেই থাকে।” (আল হাদীস) | খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ সেই সময়ে দ্বীন অর্জনের নিমিত্ত ঘরবাড়ী পরিত্যাগ করলেন। প্রথমে তিনি সমৱকাৰ গমন করলেন। সে সময় সমরকন্দ ও বােখরা ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র হিসাবে বিখ্যাত ছিল। বড় বড় মােহাদ্দেছ, ফকীহ, দার্শনিক ও চিন্তাশীল পণ্ডিতগণ সেখানে বাস করতেন। খাজা সাহেব প্রথমে কোরআন শরীফ হেফজ করলেন। অতঃপর তাফসীর, হাদীছ, ফেকা, ওসূল মানতেক ইত্যাদি বিষয় অধ্যায়ন করলেন। তখনকার দিনে সাধারণত মানুষের স্মৃতিশক্তি প্রখর ছিল। খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ এর স্মৃতিশক্তি ছিল তার চাইতেও প্রখর। কোরআন শরীফ হেফম করতে তার মাত্র গুটিকয়েক দিন সময় ব্যয়িত হয়েছিল। তাফসীর হাদীছ ইত্যাদি শিক্ষা করতেও তার খুব বেশি দিন লাগে নাই। বিশেষতঃ দুনিয়ার পিছনে তার কোন আকর্ষণ ছিল না বলিয়া একনিষ্ঠ ভাবে তিনি সাধনা করতে পেরেছিলেন এবং এর ফলেই শিক্ষাক্ষেত্রে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি প্রচুর দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হন। যাহেরী বিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করেও তার তৃষ্ণাতুর মনের আন-পিপাসা নিবৃত হইল না। তিনি বােখরা পরিত্যাগ করে আবার নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করলেন।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী

খাজা ওসমান হারুনী রহমাতুল্লাহ নিকট বাইয়াত গ্রহণঃ

ইসলামের ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায়; তৎকালে নিশাপুরের অধিবাসী খাজা ওসমানহারুনী ছিলেন সুফী জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র। আলেম কুলের শিরমণি যুগ সেরা তাপস। ইসলামী রেনেসাঁর অগ্রনায়ক হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ, আধ্যাত্মিক জগতের শেষ প্রান্তে পেীছার মানষে দেশ বিদেশে যােগ্য মাশায়েখ খুছতেছিলেন। যাই হােক অনেক খোজাখুজির পর শেষ পর্যন্ত যােগ্য মাশায়েক খাজা ওসমান হারুনী হমাহ কে পেয়ে অবশেষে তার নিকট মুরীদ হয়ে আধ্যাত্মিক জগতের পথকে সুগম করলেন এবং নিজেকে ধন্য করলেন।

ইতিহাস বেত্তারা বলেন, রুহানী জগতের আঁটি প্রজ্ঞাদাতা হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ আড়াই বছরকাল পীরের খেতমতে ছিলেন। কঠোর ইবাদত, রিয়াযাত ও মোরাকাবা মােশাহিদৱ মাধ্যমে তিনি বাতেনী কামালিয়াত অর্জন করে সফর শুরু করলেন। ইতিহাস বেক্তারা বলেন, প্রথমে তিনি মক্কা শরীফে উপস্থিত হয়ে হজ্জ পালন করলেন। এর পর মদিনা শরীফে নিখিল বিশ্বের ত্রাণকর্তা সুপারিশের কান্ডারী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর পবিত্র রওজা মােৰাৱক যিয়ারত করবার সময় শুনতে পাইলেন, নৰীয়ে দোজাহান হযরত মুহাম্মদ (সঃ) তাকে বলতেছেন, তোমাকে আমি হিন্দুস্থানের বেলায়েত অর্জন করতেছি। তুমি যেখানে যেয়ে সােনালী ইসলামের নির্মল আদর্শের কথা মানুষের মাঝে প্রচার কর। সত্য কথা বলতে কি, সত্যের সৈনিক হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রাঃ) যখন এই দেশে আগমন করলেন, তখন হিন্দুস্থানের প্রায় সর্বত্রই মুর্তি পূজার প্রচলন ছিল। সত্যি কথা বলতে হয় সিন্ধু বিজয়ের ফলে এই দেশে মুসলিম সভ্যতা যতটুকু প্রসার লাভ করেছিল, কালের প্রভাবে তাও বিলিন হয়ে গিয়েছিল। | খােদাদ্রোহীদের প্রতারণার জালে আবদ্ধ হয়ে এই দেশবাসী দেব দেবীর পূজায় নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন। তাদের শােচনীয় পরিনামের কথা স্মরণ করে রুহানী জগতের খাটি প্রজ্ঞাদাতা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ ভ্রান্ত মানবদিগকে সত্যিকার খোদার দিকে ফিরায়ে আনার জন্য আত্ম নিয়ােগ করলেন। ( জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী )

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী

দিল্লীর প্রতিকূল অবস্থাঃ

ইতিহাস বেত্তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে জানা যায়, যে, দিল্লীর রাজা ছিলেন তখন পৃথ্বিরাজ। তারাইনের প্রথম যুদ্ধে তিনি বিপ্লবী বীর মুহাম্মদ ঘুরীর মত বাহাদুরকেও পরাজিত করেছিলেন। মুহাম্মদ ঘুরীর এই আক্রমণ সমস্ত হিন্দু দিগকে মুসলিম বিদ্বেষী করে তুলছিল। হিন্দুগণ মুসলমানদিগকে নীচ আত ও মে বলে ধারণা করত এবং তাদের কথা শুনলে চটে যেত। এহেন ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে রুহানী জগতের খাটি প্রজ্ঞাদাতা আলেম কুলের শিরমণি মর্দে মুজাহিদ খাজা সাহেব আল্লাহর শপথ নিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করে সর্বস্তরের মানুষকে গােনালী ইসলামের দিকে আহবান দিতে লাগলেন। দেশ বিদেশ হতে মানুষ তার দরবারে আসত।

মহান আল্লাহ জাল্লা শানুর অসীম কৃপায় খাজা সাহেবের সুমিষ্ট ভাষণ ও আন্তরিক রুহানিয়াতের প্রভাবে ক্রমে ক্রমে লােকেরা সত্যের দিকে ঝুকে পড়ল। তার অলৌকিক ক্ষমতা দর্শনে ও যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য শ্ৰবনে বহু গোঁড়া হিন্দু তাকে শ্রদ্ধার সৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন। প্রিয় পাঠক, পাঠিকাগণ উক্ত আলােচনা থেকেই অনুধাবন করতে পারেন যে সত্যের সৈনিক হযরত খাজা সাহেব কত উচ্চ পর্যায়ের লোক ছিলেন। একথা দিবালোকের ন্যায় সমুজল যে হযরত খাজা মঈনুদ্দীন সাধক কুলের শিরমণি ছিলেন। ইতিহাসের পাতা খুললে দেখা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বস্তরের মানুষের কিকট তিনি একজন সর্বজন মান্য ও এজাজান তাপস ব্যক্তি ছিলেন। সত্যি কথা বলতে হয় ইসলাম প্রচারে তার অবদান ছিল অবিস্বরনীয়।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী 

আজমীর গমনঃ

খাজা বাবার জীবনী ও অলৌকিক ঘটনাঃ

খাজা সাহেব তার প্রাণপ্রিয় মুরীদ খাজা কুতুবুদ্দীনকে দিল্লীতে রেখে আজমীরের দিকে রওয়ানা হলেন। খাজা সাহেব আজমীরে গমন করে যেখানে নিজ বাসভূমি স্থাপন করলেন তা ছিল হিন্দু রাজার চারণভূমি। আলেমকুলের শিৱমণি খাজা মঈনুমীন চিশতী রহমাতুল্লাহ-কে দেখে রাখালগণ বিরক্ত হলেন, শুধু বিরক্ত নয় শেষ পর্যন্ত সেইখান হতে তাকে চলে যাওয়ার জন্য বলল। প্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণ এই ভেবে দেখুন খাজা সাহেব কতদূর আল্লাহর মায়ার বান্দা ছিলেন।

সন্ধ্যার সময় রাখালগাল উটগুলাে সহাস্থানে রেখে চলে গেলেন। পরের দিন খুব ভােরে রাখালগণ এসে দেখলাে উটের চামড়া মাটির সাথে যুক্ত হয়ে আছে। এহেন অবস্থা দেখে রাখালগণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন, অগত্যা রাখালগণ সাধক কুলের শিরমণি খাজা সাহেবের পদপ্রান্তে পড়ে মাফ চাইল। মাফ চাওয়া মাত্রই দেখলাে উটগুলাে যথাস্থানে দাঁড়াইয়া রয়েছে। অল্পক্ষণের মধ্যে এই অলৌক্কি ঘটনা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। এই ঘটনার পর থেকেই তার কাছে বহু হিন্দু ইসলাম গ্রহণ করলেন।

আনা সাগরের তীরবর্তী মন্দির এর কথা সর্বজন বিদিত যে, রাজকীয় রাখালদের উৎপীড়নে সাধক কুলের শিরমণি হযরত খাজা সাহেব ঐতিহাসিক আনা সাগর তীরবর্তী ঝর্ণার নিকট আস্তানা স্থাপন করেন, তিনি সেখান থেকে ইসলাম প্রচার করে চলছেন। ইতিহাসবেত্তাদের মতে, ঐতিহাসিক আনা সাগরের দুই তীরে বহু সংখ্যক মন্দির বিদ্যমান ছিল। এখানে এসে তিনশত পূজারী পূজা করত। দেশর নামি দামি ব্যক্তিবর্গ ও রাজ পরিষদের লোকজন মাঝে মাঝে এসে এই সকল মন্দিরে পূজা করত। ইতিহাস বেত্তাদের মুখে একথাও শুনা যায় মন্দিরে প্রতিদিন তিন মন তেল খরচা হতাে। বহুদিন ধরে পূজা সাধনের কাজ নির্বিঘ্নে চলে আসছিল। একদিন সন্ধ্যার সময় পূজারীরা মধুমাখা আজানের ধ্বনি শুনতে পেয়ে জজ ফকীরের স্পর্ধা দেখে অবাক হয়ে গেল।

পূজারীগণ রাজ সিংহাসনে গিয়ে অভিযােগ করল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় অভিযোগ শুনে রাজা ক্রোধান্ধ হয়ে সেই মুহূর্তে একদল সিপাহী প্রেরণ করলেন। সত্যি কথা বলতে হয় রাজার আদেশ পেয়ে সিপাহীরা রুহানী জগতের খাটি প্রজ্ঞাদাতা হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ সাবের উপর খেপে গেল। আক্রোশ করে খ্যান্ত হলেন না, বরং খাজা সাহেবকে তাড়াইয়া দিতে উদ্যত হল। রাজকীয় সৈন্য বাহিনীয়রা সূফী কুলের শিরমণি হযরত খাজা সাহেবের নিকটবর্তী হয়ে নানা প্রকার গালাগালি বর্ষণ করতে লাগল। এদিকে সত্যের সৈনিক হযরত খাজা সাহেব আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। রাজকীয় সৈন্যবাহিনীরা যে তাকে বিভিন্ন ভাষায় গালিগালাজ দিতেছে সেদিকে মােটই তার খেয়াল ছিল না। যাই হােক খাজা সাহেব ধ্যান শেষে তাদেরকে নরমভাবে জিজ্ঞেস করলেন তােমরা কি চাও? সত্যি, তোমাদের আমি বলি তােমরা সামনে আর এক কদমও এসাে না, তাহলে তােমাদের উপর আল্লাহর গজব বর্ষিত হবে।

খাজা বাবার জীবনী ও ইতিহাস পাঠে জানা যায়, রাজকীয় বাহিনী খাজা সাহেবের এই আদেশ অমান্য করে সামনে অগ্রসর হতে লাগল। অগত্য খাজা সাহেব তাদের দিকে এক মুষ্ঠি ধূলি নিক্ষেপ করলেন। সত্যি, ধূলি নিক্ষেপ করা মাত্রই রাজকীয় বাহিনীর সৈন্যদল পাগল হয়ে চিৎকার করতে করতে পালায়ে বাঁচল। ইতিহাস বেত্তাদের কাছে একথা সুস্পষ্ট যে সৈন্য দলের কেউ অন্ধ, কেউ বধির, কেউ খঞ্জ আর কেউ মাতাল হয়ে গেলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই রাজার নিকট এই অলৌকিক কাজের কথা পৌছাল। প্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণ এখান থেকেই অনুধাবন করতে পারেন যে, সত্যের সেনানী সূফী সাধক হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী কত উচ্চ পর্যায়ের আল্লার ওলী ছিলেন।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী

গরীবে নেওয়াজ এর কারামত

রামদেব ও অজয় পালের ইসলাম গ্রহণঃ

 

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় পৃথ্বিরাজ ভাবছিলেন যে আলেমকূলের শিরমণি হযরত খাজা গরীবে নেওয়াজ একজন অসামান্য যাদুকর, এই চিন্তা ভাবনা করার পর শেষ পর্যন্ত তৎকালীন নামকরা যাদুকর রামদেব ও অজয় পালকে তলব করলেন। আর আদেশ পেয়ে তারা তড়িৎগতিতে খাজা সাহেবের নিকট হাজির হল। ঐ সময়, সাধক হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। তাদের আগমনে ধ্যান ভঙ্গ করে তাদের প্রতি জ্যোতির্ময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। একথা সর্বদা মনে রাখতে হবে হেদায়েত করার মালিক একমাত্র আল্লাহই, সত্যিই মুহূর্তের মধ্যে রামদেব ও অজয় পালের হৃদয়ে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা দেখা দিল। মহান করুণার আঁধার আল্লাহ জাল্লা শানুহুর কুদরত কে বুঝতে পারে? তাৎক্ষণিকভাবে তারা রুহানী জগতের খাটি প্রজ্ঞাদাতা হযরত খাজা সাহেবের পদপ্রন্তে লুটিয়ে পড়ল এবং ইসলামের ছায়া তলে আশ্রয় নিল । ( মারেফত কি এবং মারেফত কাকে বলে )

 

প্রিয় পাঠক পাঠিকাগণ একটু ভেবে দেখুন আল্লার অলীকে তাড়াতে এসে তারা নিজেরাই ইসলাম ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করলেন। আলেমকূলের শিমণি হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রামদেবের ইসলাম গ্রহণ করার পর তার নাম রাখলেন ‘মুহাম্মদ সাদী, অভিধান সূত্রে জানা যায়, সাদী অর্থ ভাগ্যবান। পরবর্তীতে রামদেব কামেল ওলী হিসেবে সুনাম সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। অজয় পাল ইসলাম গ্রহণ করার পর খাজা সাহেব তার নাম রাখেন আবদুল্লা বিয়ানী।

পৃথিরাজের উপর খাজা সাহেবের অভিশাপ

পৃথিরাজের উপর খাজা সাহেবের অভিশাপ ইহিহাস বেত্তারা বলেন, প্রথম তরাইনের যুদ্বে মুহাম্মদ ঘুরী পরাজিত হয়ে পুনরায় দ্বিতীয়বার যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। অতীব সত্য কথা যে, এই যুদ্ধে পৃথ্বিরাজ বিপুল সৈন্যবাহিনী নিয়ে পরাজিত ও নিহত হলেন। ইতিহাসবিদগণ ও ইসলামী জ্ঞানতাপসগণ বলেন, দ্বিতীয় তরাইনের যুদ্ধের পশ্চাতে সূফী কুলেল শিরমণি হযরত খাজা সাহেব-এর অভিশাপ খুবই কার্যকরী হয়েছিল। প্রথমতঃ সাধককুলের শিরমণি হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ সাহেব পৃথ্বিরাজকে ইসলাম গ্রহণ করবার জন্য এক চিঠিতে দাওয়াত দিয়েছিলেন। খাজা সাহেব তার মূল্যবান চিঠির মধ্যে উল্লেখ করেন যে, পৃথ্বিরাজ একথা সর্বজন বিদিত যে, মূর্তি অচেতন পদার্থ তার কোন শক্তি নেই। সে মানব জাতির কোন প্রকার উপকার করতে পারে না। মহান আল্লাহ জাল্লা শানুহ এক, অদ্বিতীয় তার কোন শরীক নেই। অতএব, তুমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সােনালী ইতিহাসের নির্মল আদর্শ অনুযায়ী জীবন গঠন কর। তোমার উপর আল্লাহর রহমতের করুণা বর্ষিত হবে।

 

খাজা সাহেবের চিঠি পেয়ে পৃথ্বিরাজ ক্রোধে উন্মাদ হয়েছিলেন। দ্বিতীয়তঃ পৃথ্বিরাজ খাজা সাহেবের এক ভক্ত মুরীদ কর্মচারীকে অন্যায়ভাবে চাকুরী হতে বরখাস্ত করায় খাজা সাহেব একথা শুনে এক টুকরাে কাগজে লিখে পাঠান “আমি তোমাকে জীবিত অবস্থায় মুসলিম সৈন্যদের হাতে সােপর্দ করলাম। প্রিয় পাঠকপাঠিকাগণ রুহানী জগতের খাটি প্রজ্ঞাদাতা খাজা সাহেবের এই অভিশাপ সত্যে পরিণত হয়েছে, তা একটু খেয়াল দিয়ে শুনুন এবং চিন্তা করে দেখুন খাজা সাহেব কতদূর আল্লাহ ওয়ালা ছিলেন।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী

চিশতীয়া তরীকা ?

 

একথা সর্বজন বিদিত যে ইলমে মারেফাতের অনেকগুলি তরীকার মধ্যে চারটি তরীকাই আসল, যথাঃ-চিশতীয়, কাদিরীয়া, নকশবন্দীয়া মুজাদ্দেদীয়া। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে জানা যায় চিশতী হিন্দুস্থানের একটি গ্রামের নাম । সাধক ‘কুলের শিরমণি সত্যের সৈনিক হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ ও তরীকার অধিকাংশ তাপসগণ এই গ্রামে অবস্থান করতেন বলে তার নামানুসারে তাদের প্রবর্তিত তৈরিকার নাম চিশতীয়া তরীকা হয়েছে। ইতিহাস, বেত্তারা বলেন, চিশতিয়া তরিকা যদিও খাজা সাহেবের আগেই প্রচলিত ছিল। কিন্তু এই তরীকার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ লাভ করে তারই সময় হতে। এই তরিকার অজিফা ও আমল অত্যন্ত সহজ ও সরল হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষ অতি সহজে এই তরীকার চর্চা ও অনুসরণ করতে সক্ষম হয়।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী

খাজা বাবার কতিপয় বিশেষ উপদেশাবলীঃ

 

বিভিন্ন সময়ে সূফী সাধক হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ নিজ শিষ্যবর্গকে যে সব মূল্যবান নসীহত প্রদান করেছেন তার তুলনা হয় না। নিম্নে তার কতিপয় নসীহত দেওয়া হলঃ

১। এলেম গভীর সাগর সাদৃশ্য, মারেফত উহার তরঙ্গ।

 

২। দান করলেই খােদায়ী নেয়ামত লাভ করা সম্ভব।

 

৩। আরেফের(কামেল লোকের) নিদর্শন এই যে, তিনি মৃত্যুকে বন্ধু মনে করেন এবং প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে তিনি খােদাকে স্মরণ করেন।’

 

৪। মুহাব্বতের নিদর্শন এই যে, বান্দা আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করবে এবং সাথে সাথে তার এ ভয়ও থাকবে যেন তার নৈকট্য হতে সে বঞ্চিত না হয়।

 

৫। পিতামাতার দিকে ভক্তিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকানও এবাদত।

 

৬। হতভাগা সেই লােক, যে নিজেকে গুণাহর কাজে লিপ্ত করে।

 

৭। পরিশ্রম ব্যতীত কোন কিছুই লাভ করা সম্ভব নয়।

৮। চার শ্রেণীর লােক খুবই ভালঃ ১মঃ যে দরবেশ সর্বদা নিজেকে ধনী মনে করে। অর্থাৎ সম্বলহীন হওয়া সত্ত্বেও যে নিজের দারিদ্র কখনও প্রকাশ করে না। ২য়ঃ যে ক্ষুধার্ত নিজেকে তৃপ্ত ভাবে, ৩য়ঃ যে চিন্তাক্লিষ্ট বিপন্ন সর্বদা হাসিমুখে থাকে, ৪র্থঃ যে লােক শত্রুর সহিত বন্ধু সুলভ আচরণ করে।

 

৯। সর্ব প্রথম যে বিষয়টি মানুষের উপর ফরয করা হয়েছে, তা হল আল্লাহর মারেফত।

 

১০। তাওবার শুরু কয়েকটি-জাহেলের সংসর্গ পরিত্যাগ করা, ভ্রান্তিদের থেকে দূরে থাকা, অবিশ্বাসীদের সান্নিধ্য পরিহার করা, খােদার প্রিয় বান্দাদের সােহবত অবলম্বন করা ও নেক কাজে মনােনিবেশ করা ।

 

১১। নেক করার চাইতে নেককারের সােহবত যত উত্তম, পাপ করার চাইতে পাপীর সােহবত তত খারাপ।

 

১২। কোরআন শরীফ, কাবাগৃহ, পিতামাতা, আলেম ও ওস্তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করা এবাদতের শামিল।

 

১৩। আরেফ(কামেল লোক) যখন নীরব থাকেন,তখন তুমি মনে করবে তিনি প্রভুর সাথে কথা বলতেছেন।

১৫। ঐ ব্যক্তি প্রকৃত দরবেশ যার কাছে এসে কোন লােক খালি হাতে ফেরত যায়না।

 

১৬। ভালবাসার প্রকৃত দাবীদার ঐ সকল লােক, যারা সর্বদা বন্ধুর কথা শুনতে ভালোবাসে।

 

১৭। সত্যিকার বন্ধু ঐ ব্যক্তি, যে বন্ধুর দেওয়া বিপদকে হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করে।

 

১৮। একজন মুসলিম ভাইকে বেইজ্জতি বা অপদস্থ করলে যত ক্ষতি হয় সারাজীবন গুনার কাজে লিপ্ত থাকলেও তত ক্ষতি হয় না। |

 

১৯। যে সকল কথা বা কাজ আল্লাহ পাক অপছন্দ করেন, বান্দাও যদি সেই সকল কাজ ও কথা ঘৃণা করতে শিখে, তবেই তার দােস্তী সে অনায়াসে লাভ করতে পারে।

 

২০। ক্ষুধার্তকে অন্নদান, অভাগ্রস্তের অভাবপূরণ ও শত্রুর সাথে সদাচরণ, চরিত্রের বিশেষ গুণ।

 

২১। ঐ ব্যক্তিই প্রকৃত প্রেমিক যার ইহলােক ও পরলােকের সকল আশা ত্যাগ করে একমাত্র মহান মাহবুব আল্লাহ তায়ালার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে।

 

২২। কোন লােক ততক্ষণ আরেফ(কামেল) হতে পারে না, যতক্ষণ না সে নিজ অস্তিত্ব একেবারে ভুলে না যায়।

 

২৩। প্রেমের পথে যে অটল থাকে, প্রেমাগ্নি তার অস্তিত্বকে বিলোপ করে দেয়।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী

ইন্তেকাল ও দাফনঃ

একথা সর্বজন বিদিত যে মানুষ মরণশীল। জন্মিলে মরতে হয়। এ নীতির উপর ভিত্তি করে বিশ্ব নিয়ন্তা আল্লাহ রাব্দুল আলামীনের প্রিয় হাবীব নিখিল বিশ্বের ত্রাণকর্তা সুপারিশের কান্ডারী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর মত নবীও মৃত্যুর শীতল স্পর্শ হতে পরিত্রাণ পাননি। অতপর রুহানী জগতের খাটি প্রজ্ঞাপাতা হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ ও একদিন চীর বিদায়ের ইঙ্গিত প্রাপ্ত হলেন তার মহা প্রস্থানের সময় ঘনাইয়া আসল। ইতিহাস পাঠে জানা যায়, তার মৃত্যু সম্বন্ধে কথিত আছে যে আলেমকুলের শিরমণি হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী যে রাত্রে ইহধাম ত্যাগ করেছিলেন, সেই রাত্রিতে বিশ্বনিয়ন্তা আল্লাহ রাব্দুল আলামীনের অসংখ্যক অলীআল্লাহ থাকে দেখতে পান যে সাইয়্যেদুল মুরসালিন হযরত মুহাম্মদ (সঃ) বলতেছেন মঈনুদ্দীন আল্লাহ পাকের বন্ধু । আমরা তাকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করবার জন্য আগমন করছি ।

 

ইতিহাস বেত্তরা বলেন, হিজরী ৬২৭ সালের ৬ই রজব তারিখে ইশার নামাজ আদায় করবার পর সুফী সাধক হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রাহঃ) নিজ কক্ষে ঢুকলেন এবং ভিতর হতে উক্ত কামরা বন্ধ করে দিলেন, ক্রমে ফজরের সময় হল। অতীব দুঃখের বিষয় হল প্রতিদিনের মত আর হুজুরার দরজা খুলল না। খাদেমগণ অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। পরিশেষে দরজা ভেঙ্গে দেখা গেল যে সূফী সাধক রুহানী জগতের খাটি প্রজ্ঞাদাতা হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী সাহেবের প্রাণ বায়ু শেষ হয়ে গেছে। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। খাজা সাহেবের ইহধাম ত্যাগের সংবাদ শুনে জনসাধারণ অত্যন্ত মর্মাহত হয়। দেশ বিদেশ হতে মানুষের ঢল নেমে আসল। তার জানাযার নামাজে অসংখ্য লােক শরীক হন। তার সুযােগ্য পুত্র খাজা ফখরুদ্দীন রহমতুল্লাহ জানাযার নামাজ পড়ান। তিনি যে হুজরায় মৃত্যু বরণ করেন সেই দুজরাতেই তাকে দাফন করা হয়।

আবু হামিদ আল-গাজ্জালি (রহঃ)

আবু হামিদ আল-গাজ্জালি (রহঃ)

আবু হামিদ আল-গাজ্জালীঃ ইমাম গাযালী (র)-এর নাম মুহাম্মাদ। ডাকনাম আবু হামেদ। পিতার নামও মুহাম্মাদ ছিল। তুস জেলায় ৪৫০ হিজরীতে তাহিরান নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার ওসিয়ত মুতাবেক তাঁর এক বন্ধু—যিনি একজন একনিষ্ঠ ‘ইলম-দোস্ত ও সূফী গরীব মুসলমান ছিলেন-তাঁর শিক্ষার বন্দোবস্ত করতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন এবং তাকে কোন মাদরাসায় ভর্তি হবার পরামর্শ দেন। অনন্তর তিনি একটি মাদরাসায় ভর্তি হয়ে শিক্ষা অর্জনে আত্মনিয়ােগ করেন।

ইমাম গাযালী (র) স্বদেশে শায়খ আহমাদ আর-রাযেকানীর নিকট থেকে শাফিঈ মযহাবের ফিকাহশাস্ত্রে তা’লীম হাসিল করেন। এরপর জর্দানে ইমাম আবু নসর ইসমাঈলীর নিকট পড়াশুনা করেন। এরপর নিশাপুর গিয়ে ইমামুল হারামায়নের মাদরাসায় ভর্তি হন এবং অতি অল্পদিনেই তিনি তার ৪০০ সহপাঠীর মধ্যে একটি বিশিষ্ট আসন লাভ করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর খ্যাতিমান উস্তাদের সহযােগী (নায়েব)-তে পরিণত হন, এমন কি ইমামুল-হারামায়ন তার সম্পর্ক বলতেন, “গাযালী (র) হলেন গভীর সমুদ্র।” ইমামুল-হারামায়ন-এর ইনতিকালের পর তিনি নিশাপুর থেকে বহির্গত হন। সে সময় তাঁর বয়স ছিল ২৮ বছর, অথচ তখনাে তাকে বড় বড় বর্ষীয়ান ‘উলামা’র চেয়ে অধিকতর বিশিষ্ট ও কামালিয়তের অধিকারী মনে করা হত।

এর পর ইমাম গাযালী (র) নিজামুল-মুলকের দরবারে যান। তাঁর খ্যাতি ও বিশেষ যােগ্যতার কারণে নিজামুল-মুলক তাকে অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধা সহকারে দরবারে গ্রহণ করেন। এখানে ছিল দুর্লভ রত্নসম। জ্ঞানী-গুণীদের সমাবেশ। জ্ঞানের আলােচনা ও ধর্মীয় মুনাজারা (বিতর্ক) তখনকার দরবার, মজলিস, এমন কি বিবাহানুষ্ঠান ও শােক সভারও একটি অপরিহার্য অঙ্গ ছিল। ইমাম গাযালী (র) যাবতীয় বিতর্ক আলােচনায় সকলের ওপর জয়ী হতেন। তাঁর অতুলনীয় যােগ্যতাদৃষ্টে নিজামুল-মুলক তাঁকে নিজামিয়া মাদরাসার অধ্যক্ষ হিসাবে মনােনীত করেন, যা ছিল সে যুগে একজন ‘আলিমের জন্য সম্মান ও মর্যাদার সর্বোচ্চ সােপান। সে সময় গাযালীর বয়স ৩৪ বছরের বেশী ছিল না।Imam Ghazali

৪৮৪ হিজরীতে তিনি বিরাট শান-শওকতের সঙ্গে বাগদাদে প্রবেশ করেন এবং নিজামিয়ায় পাঠ দান শুরু করেন। অল্পদিনেই তাঁর যােগ্য শিক্ষকতা, উত্তম আলােচনা ও জ্ঞানের গভীরতার কথা সারা বাগদাদে ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্র- শিক্ষক ও জ্ঞানী-গুণী তার বিদ্যাবত্তা থেকে উপকৃত হবার জন্য চতুর্দিক থেকে নিজামিয়ায় এসে ভীড় জমাতে লাগল। তার দরূস-মাহফিল গােটা মনুষ্যকুলের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়। তিন শ’র মত সমাপ্ত পর্যায়ের ছাত্র, শত শত আমীর-উমারা’ ও রঈস এতে শরীক হতেন। ক্রমে ক্রমে তার উন্নত মস্তিষ্ক ও মেধা, ইলমী ফযীলত ও শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব বাগদাদে এমন প্রভাব-প্রতিপত্তি সৃষ্টি করে যে, তিনি সাম্রাজ্যের নেতৃস্থানীয় সদস্যবর্গের সমমর্যাদা লাভ করেন।

তাঁর সম্পর্কে তাঁর সমসাময়িক শায়খ আবদুল গাফির ফারসী বলেন, “তার জাকজমক ও আড়ম্বরের সামনে আমীর-উমারা’, উযীর, এমন কি স্বয়ং দরবারে খিলাফতের শান-শওকত পর্যন্ত নিষ্প্রভ হয়ে যায়। এমনি সময়ে ৪৮৫ হিজরীতে তাকে ‘আব্বাসী খলীফা মুক ‘তাদী বিল্লাহ মালিক শাহ সালজুকীর বেগম তুর্কান খাতুনের নিকট (যিনি সে সময় সাম্রাজ্যের হর্তা-কর্তা ছিলেন) স্বীয় দূত বানিয়ে পাঠান। খলীফা মুক ‘তাদী বিল্লাহর স্থলাভিষিক্ত খলীফা মুস্তাজহির ইমাম গাযালী (র)-এর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রাখতেন এবং তার একনিষ্ঠ ভক্ত ও অনুরক্ত ছিলেন। তারই নির্দেশে ইমাম গাযালী (র) বাতেনী মতবাদের বিরুদ্বে কিতাব লিখেন এবং খলীফার সঙ্গে সম্পর্কিত করে এর নাম রাখেন ‘মুস্তাজহিরী।

এগার বছরের চলমান জীবন এবং এর অভিজ্ঞতা:

এই চরম উন্নতি ও উত্থানের স্বাভাবিক দাবি ছিল যে, ইমাম গাযালী (র) এতে তৃপ্তি লাভ করবেন এবং এই বৃত্তের মাঝেই তিনি তার গােটা জীবন কাটিয়ে দেবেন, যেমনটি তার কতক উস্তাদ করেছেন। কিন্তু তার অস্থির স্বভাব ও প্রকৃতি, উন্নত মনােবল, দুরন্ত সাহসিকতা উন্নতির এই চরম পর্যায়েও তাকে সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত রাখতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে এই উন্নত মনােবল ও হিম্মতই তাঁকে ইমাম’ ও ‘হুজ্জাতুল-ইসলাম বানিয়েছিল। দুনিয়াতে জাঁকজমক, আড়ম্বর, সম্মান ও পদবীর কুরবানী এবং স্বীয় উদ্দেশ্যের প্রতি একাগ্রতা ও সত্যের প্রতি আকর্ষণের এমন দৃষ্টান্ত বিরল। ইমাম গাযালী (র) স্বয়ং সেসব অবস্থা ও কার্যকারণ বর্ণনা করেছেন যা তাকে এমন পদক্ষেপ গ্রহণে উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং যা তাকে টেনে বের করেছিল শিক্ষা ও দরস প্রদানের কাজ থেকে। যা হােক, শেষ পর্যন্ত তিনি জ্ঞান রাজ্যের বাদশাহী ছেড়ে নিশ্চিত জ্ঞান ও ইন্দ্রিয়াতীত সম্পদের তালাশে বেরিয়ে পড়েন এবং স্বীয় লক্ষ্যে কামিয়াবী লাভ করেন। ‘Al-Munkiju Minaddalal” নামক গ্রন্থে তিনি এ সম্পর্কে লিখেছেন :- বিস্তারিত পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

To read Imam Gazzali Biography in English CLICK here

মাইজভান্ডারী জীবন কাহিনী- বানী ও কারামত

মাইজভান্ডারী জীবন কাহিনী- বানী ও কারামত

সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (রহঃ)।।।

সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (রহঃ)। মাইজভান্ডারী তরীকার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি । তিনি জন্ম গ্রহন করেন (রহঃ) বাংলা ১২৩৩ এবং ১৮২৬ সালের ১লা মাঘ মাইজভান্ডার শরীফে । তিনি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)এর বংশধর ছিলেন। তার পিতা ছিলেন সৈয়দ মতিউল্লাহ (রহঃ) এবং মাতা ছিলেন সৈয়দা খায়রুন্নেছা বিবি (রহঃ)। চার বছর বয়সে নিজ গ্রামের মক্তবে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। অতঃপর তিনি কলকাতায় চলে যান এবং ১২৬৮ হিজরি সনে তিনি কলকাতায় তার শিক্ষাজীবন শুরু করেন। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সহিত শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১২৬৯ হিজরি সালে তিনি যশোর জেলায় যান এবং সেখানে তিনি কাজী পদে যোগদান করেন। ১২৭০ হিজরিতে তিনি কাজী পদ থেকে পদত্যাগ করে কলকাতায় চলে যান এবং কলকাতায়মুন্সি বু-আলী মাদ্‌রাসার প্রধান মোদার্‌রেছের পদে নিয়োযিত হন।

মাইজভান্ডারী

শেখ সৈয়দ আবু শাহমা মুহাম্মদ ছালেহ আল কাদেরী লাহোরী (রহঃ) ছিলেন আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী(রহঃ) এর পীর। আর আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী(রহঃ) তিনি তরিকতের বড় ভাই হযরত সৈয়দ দেলাওয়ার আলী পাকবাজ (রহঃ) এঁর কাছ থেকে কুতুবিয়তের ফয়েজ অর্জন করেন। ১৮৫৭ সালে হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী তাঁর পীরে ত্বরিকতের নির্দেশে নিজ গ্রাম মাইজভান্ডারে চলে আসেন। এরপর থেকে আস্তে আস্তে মাইজভান্ডার আধ্যাত্মিক সাধক ও দোয়া প্রত্যাশীদের ভীড়ে পরিনত হয় এবং ক্রমান্বয়ে এই সাধকের বাসগৃহ মানবতার কল্যানকর এক উচ্চমার্গীয় আধ্যাত্মিক দরবারে পরিণত হয়। লোকসমাজে পরিচিতি পায় ‘মাইজভান্ডার দরবার শরীফ’ হিসেবে।

জিয়াউল হক মাইজভান্ডারীর জীবনী

গোলামুর রহমান বাবা ভান্ডারীর অলৌকিক ঘটনা বা কারামত

জিয়াউল হক মাইজভান্ডারীর ২০টি বানী

জিয়াউল হক মাইজভান্ডারীর ১৮টি বানী


 

মনসুর হাল্লাজ এর জিবনী জানতে এখানে ক্লিক করুন।

ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) এর জীবনী । আবু হামিদ আল-গাজ্জালি

ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) এর জীবনী । আবু হামিদ আল-গাজ্জালি

ইমাম গাজ্জালী বা আবু হামিদ আল-গাজ্জালি (রহঃ) এর জীবনী

Al-Munkiju Minaddalal” নামক গ্রন্থে ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) লিখেছেন :- শৈশব থেকেই আমার স্বভাব ছিল সব কিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা এবং যে কোন তথ্য সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য চিন্তা-ভাবনা করা। প্রতিটি ফের্কা ও দলের সঙ্গে আমি মিশতাম এবং তাদের আকীদা ও ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে অবহিত হবার চেষ্টা করতাম। এর ফলে ক্রমে ক্রমে আমা থেকে তাকলীদ তথা অন্ধ পরানুগত্যের বন্ধন ছুটে যায়। যে আকীদা-বিশ্বাস শৈশব থেকেই আমার মস্তিষ্কে দানা বেঁধেছিল তা নড়বড়ে ও শিথিল হয়ে পড়ে। আমি লক্ষ্য করলাম যে, একজন খৃষ্টান ও একজন ইহুদি তাদের নিজ নিজ ‘আকীদাবিশ্বাসের ওপর লালিত-পালিত হয়। প্রকৃত ইলম এই যে, তাতে কোন প্রকার সন্দেহের এতটুকু অবকাশ কিংবা আশংকা থাকবে না।

উদাহরণত, আমার এ ব্যাপারে স্থির বিশ্বাস আছে যে, দশ সংখ্যাটি তিন-এর অধিক। এখন যদি কেউ বলে, “তিন সংখ্যাটিই অধিক এবং আমি আমার দাবির সপক্ষে আমার এই লাঠিটাকে সাপ বানাতে পারি”, অতঃপর তিনি যদি তা বানিয়ে দেখিয়েও দেন তবুও তা আমার জ্ঞানের ক্ষেত্রে এতটুকু সন্দেহ কিংবা সংশয় সৃষ্টি করবে না। আমি বিস্মিত হব ঠিকই, কিন্তু তা আমার স্থির ও নিশ্চিত বিশ্বাসে এতটুকু চিড় ধরাতে পারবে না। আমার বিশ্বাস অটল ও অনড় থাকবে যে, তিনের চেয়ে দশ বেশী। আমি গভীরভাবে ভেবে দেখে বুঝতে পারলাম যে, এ ধরনের নিশ্চিত জ্ঞান কেবল অনুভূতিলব্ধ ও অপরিহার্য সত্য সম্পর্কিত বিষয়াবলীর গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ। কিন্তু যখন আরও বেশী সাধনা চালালাম তখন জানতে পারলাম, এতেও সন্দেহের অবকাশ পুরােপুরি বিদ্যমান। আমি দেখলাম যে, পঞ্চেন্দ্রিয়ের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ইন্দ্রিয় হচ্ছে দৃষ্টিশক্তি, অথচ এতেও ভুল হয়।

আমার এই সন্দেহ এত দূর বৃদ্ধি পেল যে, আমার ইন্দ্রিয়ানুভূতির নিশ্চিত হবার ব্যাপারে কোন নিশ্চয়তাই থাকল না। পুনরায় আমি বুদ্ধিবৃত্তির ওপর গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করলাম। কিন্তু তাকে ইন্দ্রিয়ানুভূতির চেয়েও বেশী সন্দেহযুক্ত পেলাম। প্রায় দু’মাস অবধি আমার এই দোদুল্যমান অবস্থা চলতে থাকল এবং আমার ওপর সােফিষ্ট মতবাদের প্রাধান্য বজায় রইল। অতঃপর আল্লাহ পাক আমাকে এই বিমারী থেকে আরােগ্য দান করলেন এবং আমার স্বভাবে সুস্থতা ও ভারসাম্য ফিরে এল এবংবুদ্ধিবৃত্তিক ও যুক্তিনির্ভর অপরিহার্য সত্যের ওপর তৃপ্তি ফিরে পেলাম, বরং এটি ছিল আমার অন্তরাত্মায় আল্লাহপ্রদত্ত নূরের আকস্মিক ঝলকানি। এই ব্যাধি থেকে আরােগ্য লাভ করবার পর এখন আমার সামনে চারটি দল রয়ে গেল-যাদের সত্য-সন্ধানী বলে মনে হচ্ছিল।

মুতাকাল্লিমীন-যারা জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী বলে দাবি করত; বাতেনীদের দাবি ছিল যে, তাদের নিকট বিশেষ শিক্ষামালা গুপ্ত রহস্য আছে এবং তারা সরাসরি নিস্পাপ ইমাম (ইমামে মা’সূ’ম) থেকে হাকীকতে ‘ইলম তথা জ্ঞানের হাকীকত হাসিল করেছে; দার্শনিকদের বক্তব্য হ’ল, কেবল তারাই যুক্তিবাদী এবং কেবল তারাই দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে কথা বলেন। সূফীগণ নিজেদেরকে কাশফ ও হৃদ তথা অন্তর্দৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণ জ্ঞানের অধিকারী মনে করেন। আমি প্রতিটি দলের কিতাবাদি ও চিন্তাধারা অধ্যয়ন করলাম। কিন্তু কারাে ব্যাপারেই নিশ্চিন্ত হতে পারিনি। ইলমে কালাম সম্পর্কে এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের (মুহাক্কিক) রচিত গ্রন্থাদি পড়ি এবং নিজেও এই বিষয়বস্তুর ওপর বই-পুস্তক লিখি। আমি দেখলাম যে, যদিও এটি এমন একটি বিষয় যা স্বীয় উদ্দেশ্য পূরণ করে, কিন্তু তা আমাকে সান্ত্বনা প্রদানের জন্য যথেষ্ট নয়। কেননা তার ভেতর এমন সব প্রস্তাবনার ওপর ভিত্তি রাখা হয়েছে যা সম্মুখস্থ প্রতিপক্ষের পেশকৃত এবং মুতাকাল্লিমীন (ধর্মতাত্ত্বিক) যেগুলােকে কেবল অন্ধ আনুগত্যের কারণে মেনে নিয়েছেন অথবা তা ইজমা কিংবা কুরআন ও হাদীছ-এর নয়।

এসব জিনিস সেই ব্যক্তির মুকাবিলায় খুব একটা কার্যকর নয়, যারা যুক্তিসঙ্গত অপরিহার্য সত্য ছাড়া আর কিছু স্বীকার করে না। দর্শন সম্পর্কে মতামত কায়েম করবার জন্য প্রথমে আমি গবেষণামূলক মনােভঙ্গী নিয়ে তা করাকে অত্যাবশ্যক মনে করলাম যদিও অধ্যাপনা ও পুস্তক রচনায় অত্যন্ত ব্যস্ত থাকায় ফুরসত মিলত খুব কম। আমার দরসের মাহফিলে বাগদাদের তিন-তিন শ’ ছাত্র যােগদান, করত। এতদসত্ত্বেও আমি এজন্য কিছুটা সময় বের করে নিলাম এবং দু’ বছরের ভেতরই দর্শনের তাবৎ জ্ঞান-ভাণ্ডার অধ্যয়ন করে দেখলাম। অতঃপর এক বছর পর্যন্ত এর ওপর চিন্তা-ভাবনা করলাম। আমি দেখলাম, তাদের জ্ঞান ছয় প্রকারের ঃ যথাঃ অংকশাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা, প্রকৃতিবিদ্যা বা প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, রাষ্ট্রনীতি, নীতিশাস্ত্র ও ধর্মশাস্ত্র। প্রথম পাঁচ প্রকারের জ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের হাঁ-না কোন সম্পর্কই নেই এবং ধর্মের ইতিবাচক দিক সপ্রমাণ করবার জন্য সে সবের অস্বীকৃতিরও কোন প্রয়ােজন নেই। কতক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের টক্কর লাগে, কিন্তু তা কতিপয় জিনিসে মাত্র।

এই ব্যাপারে নীতিগতভাবে এই ‘আকীদা পােষণ করতে হবে যে, প্রকৃতি বা স্বভাব আল্লাহর এখতিয়ারাধীন এবং বিজ্ঞান স্বয়ম্ভর ও স্বশাসিত নয়। অবশ্য যে সমস্ত লােক ঐ সমস্ত জ্ঞান ও নিবন্ধে দার্শনিকদের মেধা ও সূক্ষ্মদৃষ্টি লক্ষ্য। কবে তারা সাধারণত ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং মনে করে যে, জ্ঞানের সকল শাখা-প্রশাখায়ই বুঝি তাদের এরূপ অধিকার রয়েছে! অথচ এটা জরুরী নয় যে, কোন ব্যক্তির জ্ঞান-বিজ্ঞানের একটি বিশেষ শাখায় অতুলনীয় দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা আছে বলে এর সব শাখাতেই তার দক্ষতা থাকবে। এরপর যখন তারা এই সমস্ত লােকের মধ্যে ধর্মহীনতা ও ধর্মকে অস্বীকার করবার মানসিক প্রবণতা লক্ষ্য করে তখন তারা এসব জ্ঞানী ও বিজ্ঞানীদের প্রতি অন্ধ আনুগত্যবশত ধর্মকে অস্বীকার এবং ধর্মের ভূমিকাকে হাল্কা ও খাটো করে দেখবার প্রয়াস পায়।

অপরদিকে ইসলামের কতক নাদান দোস্ত দার্শনিকদের প্রতিটি দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত এবং তাদের প্রতিটি দাবিকেই প্রত্যাখ্যান করাকে তাদের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য বলে গণ্য করেন এবং এটাকে তারা ইসলামের খিদমত বলে মনে করেন। এমন কি তারা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাদের সকল অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণকেও অস্বীকার করতে এগিয়ে যান। এর একটি ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া এই যে, যে সব লোেক তাদের বিজ্ঞান সম্পর্কীয় মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গির সত্যতার ব্যাপারে নিশ্চিত এবং তাদের নিকট সে সব বস্ত প্রমাণিত ,সত্যের চূড়ায় উপনীত, উপরিউক্ত ধর্মান্ধতার কারণে তাদের ইসলাম সম্পর্কে আকীদাই নড়বড়ে হয়ে যায় এবং দর্শনশাস্ত্র অস্বীকার করার পরিবর্তে তারা ইসলাম সম্পর্কেই বিরূপ ধারণা পােষণ করতে থাকেন।

মােট কথা, আমি এই সিদ্ধান্তে পৌছলাম যে, দর্শনশাস্ত্র দ্বারা আমার চিত্ত সান্ত্বনা পাবে না এবং বুদ্ধি একাকী সকল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য আয়ত্ত করতে পারে না বা সকল অসুবিধা দূর করবার ক্ষমতাও রাখে না।

থাকল বাতেনীয়া সম্প্রদায়। এ সম্পর্কে আমার গ্রন্থ ‘মুস্তাজহিরী’ রচনা করতে গিয়ে তাদের মযহাব সম্পর্কে বেশ ভালভাবে অধ্যয়ন করার সুযােগ পেয়েছিলাম। আমি দেখতে পেলাম তাদের ‘আকীদার ভিত্তি যুগের ইমামের শিক্ষার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু যুগের ইমামের অস্তিত্ব ও তার সত্যতা প্রমাণ সাপেক্ষ বস্তু এবং এ দু’টোই সীমাতিরিক্ত সন্দেহে ভরপুর। এখন রইল কেবল তাসাওউফ। সার্বক্ষণিকভাবে তাসাওউফের প্রতি আমি মনােনিবেশ করলাম। তাসাওউফ যেমন জ্ঞানগত বিষয়- তেমনি ব্যবহারিক বিষয়ও বটে। আমার কাছে জ্ঞানগত ব্যাপার অনেকটা সহজ ছিল। আমি আবু তালিব মক্কীর “তু’ল-কুব, হারিছ মুহাসিবীর রচিত গ্রন্থাদি ও হযরতজুনায়দ বাগদাদী, হযরত শিবলী,হযরত আবু ইয়াযীদ বিস্তামী (র)-এর ‘মালফুজাত’ পড়লাম এবং ইলম-এর রাস্তা ধরে যা কিছু অর্জন করা যায় তা অর্জন করলাম। অতঃপর আমি বুঝতে পারলাম যে, মূল হাকীকত তথা আসল সত্য পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যমে নয়, বরং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, যওক বা স্বাদ, তন্ময় সাধনা ও অবস্থার পরিবর্তনের দ্বারা পৌছা যায়।

যে জ্ঞান আমার পুঁজি ছিল, চাই তা শরীয়ত সম্পর্কিত হােক অথবা বুদ্ধিবৃত্তিক, তারা আমি আল্লাহর অস্তিত, নবুওত ও আখিরাতের (পারলৌকিক জীবনের) ওপর সুদৃঢ় ঈমান লাভ করেছিলাম। অবশ্য তা কেবল দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতেই নয়, বরং ঐ সব কার্যকারণ, ঘটনাপরম্পরা ও বিচিত্র অভিজ্ঞতার মাধ্যমে লাভ করেছিলাম যার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া মুশকিল। আমার কাছে এটা বেশ ভাল রকম পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, পারলৌকিক সৌভাগ্য লাভের পন্থা কেবল তাকওয়া তথা আল্লাহ-ভীতি অবলম্বন করা এবং তথা প্রবৃত্তিকে তার কামনা থেকে ফিরিয়ে রাখা। এজন্য যে কৌশল অবলম্বন করতে হবে তা হল, এই নশ্বর পৃথিবীর মায়া ও আকর্ষণ ত্যাগ করে পারলৌকিক জীবনের প্রতি আকর্ষণ বাড়ানাে এবং পূর্ণ একাগ্রতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে আল্লাহর দিকে মনােনিবেশের মাধ্যমে অন্তরের দুর্নিবার স্বাভাবিক আকর্ষণকে দুনিয়া থেকে ছিন্ন করা। আর তা একমাত্র পার্থিব শান-শওকত, ধন-সম্পদ, মান-মর্যাদা ও ভােগ-লালসার আকর্ষণ পরিত্যাগ করার মাধ্যমেই সম্ভব হতে পারে। আমি আমার অবস্থা গভীরভাবে নিরীক্ষণ করলাম।

বুঝতে পারলাম যে, আমার আপাদমস্তক পার্থিব আসক্তির কঠিন শিখরে আবদ্ধ। আমার সর্বোত্তম আমল হিসাবে শিক্ষা দান ছিল উল্লেখ করার মত। কিন্তু গভীরভাবে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, আমার গােটা সাধনা ও মনঃসংযােগই ছিল সেই সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি যা তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না এবং আখিরাতের স্বার্থের প্রতিও তা তেমন কল্যাণকর ছিল না। আমার অধ্যাপনার পেছনে যে নিয়ত ক্রিয়াশীল ছিল সে সম্পর্কে আমি ভেবে দেখলাম এবং বুঝতে পারলাম যে, তা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ছিল না, বরং তার পেছনে পার্থিব শান-শওকত বৃদ্ধি, প্রভাব-প্রতিপত্তি কায়েম ও সুখ্যাতি অর্জনের মানসিকতাটাই সর্বাধিক সক্রিয় ছিল। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস হ’ল যে, আমি ধ্বংসােনুখ নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমি যদি আমার অবস্থার সংস্কার সাধনে প্রয়াসী না হই তা হলে আমার জন্য তা কঠিন বিপদের কারণ হবে।

দীর্ঘকাল পর্যন্ত আমি এই সব ছেড়ে-ছুঁড়ে বাগদাদ পরিত্যাগ করার চিন্তাভাবনা করতে থাকি। কিন্তু চূড়ান্ত ফয়সালায় উপনীত হতে ব্যর্থ হই। ছ’মাস এরূপ দ্বিধা-দ্বন্দের মাঝে কেটে যায়। কখনাে পার্থিব কামনা-বাসনা আমাকে আকৃষ্ট করত, আবার কখনাে আমার ঈমান আমাকে ডেকে বলত, “যাত্রার সময় নিকটবর্তী, জীবন বড় ক্ষণস্থায়ী, অথচ চলার পথ অনেক দীর্ঘ। এই সব “ইলম ও আমল স্রেফ লােক দেখানাে ভণ্ডামি ও প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়।” কখনাে আমার ‘নফস(শয়তানী প্রবৃত্তি) আমাকে বলত, “এসব সাময়িক চিত্তবৈকল্যমাত্র। আল্লাহ পাক তােমাকে যা কিছু প্রভাব-প্রতিপত্তি ও মান-মর্যাদা দান করেছেন- বাগদাদ ছেড়ে দেবার পর যদি আবার কখনাে ফিরে আস তাহলে এগুলাে আবার ফিরে পাওয়া তােমার পক্ষে মুশকিল হবে।” মােট কথা, এই উভয়বিধ টানাপােড়েনের মাঝে আরও ছয়টি মাস কেটে গেল, এমন কি পরিস্থিতি আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আমার মুখের ভাষা হ’ল বন্ধ, যেন কেউ আমার মুখে তালা লাগিয়ে দিয়েছে। আমি চেষ্টা করতাম আমার নিকট আগত ও নির্গত লােকদের (ছাত্র ও অতিথি-অভ্যাগত) মনস্তৃষ্টির জন্য একই দিনে সব কিছু পড়িয়ে দিই। কিন্তু কি করব, আমার জিহ্বা আমার সহযােগিতা করছিল না এবং আমার মুখ দিয়ে একটি শব্দও উচ্চারিত হচ্ছিল না।

জিহ্বা ও মুখের এই আড়ষ্টতা আমার অন্তরে দুশ্চিন্তা ও বেদনার সৃষ্টি করল, যার ফলে আমার হযম শক্তিও লােপ পেতে লাগল, এমন কি এক চুমুক পানি পান ও এক লােকমা খাদ্য হযম করাও আমার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে উঠল। ক্রমান্বয়ে আমার শারীরিক শক্তিতেও ভাটা দেখা দিল। শেষাবধি চিকিৎসকেরাও আমার চিকিৎসার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে পড়লেন এবং বললেন: আসলে অসুখ আপনার হৃদয়-অভ্যন্তরে এবং তার প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে আপনার সর্বশরীরে। যতদিন আপনার মন থেকে এ অসুখ না সারবে ততদিন পর্যন্ত কোন চিকিৎসাই ফলপ্রসূ হবে না। অগত্যা আমি আল্লাহর শরণাপন্ন হলাম এবং নিতান্ত অসহায়ভাবে কাতর স্বরে তাঁকে ডাকতে লাগলাম। এর ফলে আমার পক্ষে এই প্রভাব-প্রতিপত্তি, পদ-মর্যাদা, ধন-সম্পদ ও পরিবার-পরিজন সব কিছু ছেড়ে দেওয়া সহজ মনে হতে লাগল। আমি মক্কা শরীফ গমনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করলাম। আমার অন্তরের এই বাসনা ছিল যে, আমি শামও সফর করব। এরপর অত্যন্ত চমৎকারভাবে আমি বাগদাদ ত্যাগ করবার বন্দোবস্ত করে ফেললাম।

ইরাকবাসী যখন আমার অভিপ্রায় সম্পর্কে অবহিত হ’ল তখন তারা চতুর্দিক থেকে আমাকে ভৎসনা করতে লাগল। কেননা কারাের ধারণায় এটা আসছিল যে, এত সব কিছু ছেড়ে দেবার পেছনে কোন ধর্মীয় কারণ থাকতে পারে। কেননা তাদের ধারণায় আমি তাে ধর্মীয় খিদমতের জন্য সর্বোচ্চ পদটিতে সমাসীন ছিলামই। অতঃপর জনমনে নানারূপ জল্পনা-কল্পনা শুরু হল। যারা রাজধানী থেকে দূরে অবস্থান করতেন তারা মনে করলেন যে, এর ভেতর সরকারী কর্মকর্তাদের ইশারা-ইঙ্গিত রয়ে গেছে অর্থাৎ সরকারী কোপানলই আমার এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে কাজ করছে। কিন্তু যাঁরা সরকারী মহলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত তারা দেখছিলেন যে, সরকারী মহল আমাকে ধরে রাখবার জন্য কি প্রাণান্তকর কোশেশই না করছে। তারা বলেছিলেন, ইসলামের এই রওনক ও জ্ঞানমার্গের এই উজ্জ্বল জোতিষ্কের ওপর কারাে বদনজর পড়েছে, আর তাইতেই তিনি সব কিছু অবহেলায় ত্যাগ করে নিরুদ্দেশের পথে পা বাড়িয়েছেন। এ ছাড়া তাদের আর কিই-বা বলার থাকতে পারে!

মােট কথা, আমি বাগদাদ ত্যাগ করলাম। আমার নিকট মাল-মাস্তা যা কিছু ছিল, চলার মত কিছু রেখে বাকী সব কিছুই বিলি-বণ্টন করে দিলাম। বাগদাদ থেকে আমি শামে এলাম এবং সেখানে দু’বছরের কাছাকাছি থাকলাম। সেখানে আমার কাজ রিয়াযত ও মুজাহাদা, নিঃসঙ্গ জীবন যাপন ও নির্জনতা অবলম্বন ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ইলমে তাসাওউফ থেকে আমি কিছু হাসিল করেছিলাম। সেই মুতাবিক তাযকিয়ায়ে নফস তথা আত্মশুদ্ধি, চারিত্রিক সংশােধন, পরিমার্জন ও আল্লাহর যিকিরের জন্য নিজ কলবকে পরিকৃতকরণের কাজে মগ্ন থাকি। অনেক দিন পর্যন্ত আমি দামেস্কের মসজিদেই ই’তিকাফরত ছিলাম। মসজিদের মিনারে আরােহণ করতাম এবং সমস্ত দিন দরজা বন্ধ করে সেখানেই বসে থাকতাম।

অবশেষে আমি বায়তুল-মুকাদ্দাসে আসি। সেখানেও আমি দৈনিক মসজিদে সাখরার অভ্যন্তরে চলে যেতাম এবং দরজা বন্ধ করে সময় কাটাতাম। অতঃপর সায়্যিদুনা হযরত ইবরাহীম (আ)-এর রওয়া যিয়ারতের পর আমার মনে হজে বায়তুল্লাহ ও যিয়ারতে রওযা পাক (সা)-এর প্রবল বাসনা জাগ্রত হ’ল এবং মক্কা মুকাররামা ও মদীনা মুনাওয়ারার বরকত লাভ করে উপকৃত হবার খেয়াল জাগল। অনন্তর আমি হজ্জে গমন করলাম। হজ্জ করার পর পরিবার-পরিজনের প্রতি স্বাভাবিক আকর্ষণ ও সন্তান-সন্ততির ডাকে আমাকে দেশে ফিরতে হ’ল, অথচ একদিন দেশের নাম শুনলেই আমি কয়েক মাইল পালাতাম। সেখানে গিয়েও আমি একাকিত্বের মাঝেই কাটাবার ব্যবস্থা করলাম, আত্মশুদ্ধির ব্যাপারে এতটুকু অলসতার প্রশ্রয় দিলাম না। কিন্তু নানান ঘটনা-প্রবাহ, পরিবার-পরিজনের চিন্তা ও অর্থনৈতিক প্রয়ােজন তথা জীবিকার তাগিদ আমার স্বভাব ও প্রকৃতিতে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি করত এবং এতে মনের একাগ্রতা ও চিত্তের প্রশান্তি অখণ্ডভাবে জুটত না।

কিন্তু তাতে আমি নিরাশ হতাম না; সময় সময় এ থেকে বরং লাভবানই হতাম। এভাবে কাটিয়ে দিলাম দশটি বছর। এই নির্জন নিঃসঙ্গ মুহূর্তগুলােতে আমার নিকট যে সব রহস্য উদঘাটিত হয়েছে এবং আমি যা লাভ করেছি তার বিস্তারিত বর্ণনা দান সম্ভব নয়। তবে পাঠকের উপকারের জন্য এতটুকু অবশ্যই বলব যে, আমি নিশ্চিতভাবেই অবহিত হয়েছি যে, কেবল সূফীরাই আল্লাহর পথের পথিক। তাঁদের সীরাত (জীবনচরিত)-ই সর্বোত্তম সীরাত, তাদের পথই সর্বাধিক সুদৃঢ়, তাঁদের আখলাক তথা নৈতিক চরিত্রই সর্বাধিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত, বিশুদ্ধ ও সঠিক। বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধি, জ্ঞানীদের হিকমত ও শরীয়তের সূক্ষ্ম রহস্যবিদদের ইলম মিলেও যদি তাদের সীরাত ও নৈতিক চরিত্র থেকে উত্তম কিছু আনতে চায় তবে তা সম্ভব নয়। তাদের সকল প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য গতি ও স্থৈর্য নবুওতের প্রদীপালােক থেকে উৎসারিত এবং নবুওতের জ্যোতি থেকে বড় কোন আলাে এ ধরার বুকে নেই যা থেকে আলাে-কণা পাওয়া যেতে পারে।

ইমাম গাজ্জালী বা আবু হামিদ আল-গাজ্জালি (রহঃ) এর জীবনী

জনসমাবেশের দিকে প্রত্যাবর্তন:-

সম্ভব ছিল ইমাম গাযালী (র) এই নিঃসঙ্গ জীবন ও নির্জনতার মাঝেই থেকে যেতেন এবং বাকী জীবনও রূহানী আনন্দ উপভােগ এবং একাগ্রতার আরাম ও পরিতৃপ্তির মাঝেই কাটিয়ে দিতেন। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা তার থেকে যে বিরাট মহান খিদমত নিতে চাচ্ছিলেন তার জন্য অপরিহার্য ছিল যে, তিনি নির্জনবাস থেকে বেরিয়ে আসবেন এবং পঠন-পাঠন, রচনা সংকলন ও সামাজিক জীবন এখতিয়ার করবেন যাতে করে গােটা সৃষ্টিকুলের কল্যাণ সাধিত হয়, ধর্মদ্রোহী মতবাদ ও দর্শন প্রত্যাখ্যাত হয় এবং জ্ঞানগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও সত্যতা প্রমাণিত হয়। বিশেষ করে আল্লাহ তা’আলা তাঁকে এমন নিশ্চিত জ্ঞান, বিশ্বাস ও পর্যবেক্ষণের স্তরে পৌঁছে দিয়েছিলেন যে, তৎকালীন মুসলিম বিশ্বে তার থেকে অধিক যথার্থ ও যােগ্য ব্যক্তিত্ব আর কেউ ছিলেন না।

যেহেতু এই কর্মের পেছনে আল্লাহর মঞ্জুরী ছিল এবং ইসলামেরও এর ভীষণ প্রয়ােজন ছিল, এজন্য স্বয়ং তার নিজের মনেই এর অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হল এবং এ ধারণাও প্রাধান্য পেল যে, এটি সাধনার ধন এবং এটি আম্বিয়া-ই-কিরাম (‘আ)-এর প্রতিনিধিত্ব, যুগের দাবি ও সর্বোত্তম ইবাদত। তিনি তার নিজ অনুভূতিকে খােদ নিজেই বর্ণনা করেছেন এবং নিঃসঙ্গ জীবন থেকে জনসমাবেশে ফিরে আসার কারণও লিপিবদ্ধ করেছেন।

আমি দেখতে পেলাম যে, দর্শনশাস্ত্রের প্রভাবে তাসাওউফের বহু দাবিদারের গােমরাহী, অনেক ‘আলিম-উলামা’র বে’আমল জীবন ও মুতাকাল্লিমার ত্রুটিপূর্ণ ও দুর্বল প্রতিনিধিত্বের কারণে অধিকাংশ শ্রেণীর ঈমান দোদুল্যমান ও নড়বড়ে হয়ে গেছে এবং আকীদা তথা ধর্মবিশ্বাসের ওপর এর খুবই খারাপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে। দর্শনশাস্ত্রজাত বহু লােক শরীয়তের প্রকাশ্য বিধি-বিধান ও হুকুম-আহকামের পালন করে বটে, কিন্তু নবুওত ও দীনের হাকীকতের ওপর তাদের ঈমান নেই। কতক লােক কেবল শারীরিক ব্যায়ামের ধারণায় নামায পড়ে, কেউ পড়ে কেবল সােসাইটি ও নগরবাসীর অভ্যাসের অনুসরণ এবং নিজেদের হেফাজতের জন্য। কতক লােক শর’ঈ হুকুম-আহকামের বস্তুগত সুবিধা লাভ এবং সেগুলাে পালন না করলে জাগতিক ক্ষতি হবে ধারণা করে তা পালন করে। আমি দেখছি যে, আমি সে সব সন্দেহ নিরসন করবার মত যােগ্যতা রাখি এবং সহজেই তা করতে পারি, এমন কি ঐ সব লােককে পর্দান্তরালে প্রেরণ আমার কাছে পানি পান করার চেয়েও অধিকতর সহজ বলে মনে হয়।

এতদৃষ্টে আমার মনে শক্তভাবে এই ধারণার সৃষ্টি হ’ল যে, আমার এই কাজই করা উচিত এবং এটাই সময়ের অপরিহার্য দায়িত্ব ও কর্তব্য। আমি আপন মনেই বললাম, “এই নিঃসঙ্গ ও জনমানবের সঙ্গে সম্পর্কহীন জীবন তােমার জন্য কবে এবং কখন জায়েয হ’ল? রােগ-ব্যাধি চতুর্দিকে ছড়িয়ে গেছে। চিকিৎসক নিজেই আজ রােগী। আল্লাহর সৃষ্ট জগত আজ ধ্বংসের প্রান্তে এসে উপনীত।” অতঃপর আমি বললাম, “এই এতবড় বিরাট ও মহান দায়িত্ব তােমা দ্বারা কিভাবে পালিত হতে পারে। বর্তমান যুগ তাে নবী যুগ থেকে বহু দূরে এসে গেছে। চারদিকে বাতিলেরই রাজত্ব। যদি তুমি আল্লাহর সৃষ্টিজগতকে তাদের প্রিয় ও পরিচিত বস্তুসমূহ থেকে সরিয়ে নিয়ে আসতে চেষ্টা কর তাহলে গােটা যুগ-যমানা তােমার বিরােধী হয়ে যাবে। তুমি একাকী কিভাবে তাদের মুকাবিলা করবে এবং কীভাবে জীবন যাপন করবে।(Imam Gazzali)

এটা তাে তখনই সম্ভব যখন যুগ-যমানা অনুকূল হয় এবং সমকালীন সুলতানও দীনদার হন।” আমি এই বলে আমার মনকে বুঝ দিলাম এবং নিজের জন্য নিঃসঙ্গ ও নির্জন জীবন যাপন জায়েয বলে অভিহিত করলাম। কিন্তু আল্লাহ তা’আলার অন্য কিছু মঞ্জুর ছিল। তিনি তর্কালীন সুলতানের মনে নিজেই একটি বিপ্লবত্মক পরিবর্তন এনে দিলেন। তিনি (সুলতান) আমাকে এই ফেতনা মুকাবিলা করবার জন্য নিশাপুর পেীছবার জন্য জোর তাগিদসহ নির্দেশ দিলেন। সুলতানের এই নির্দেশ এই পর্যায়ের ছিল যে, আমি অনুভব করলাম, যদি আমি এই হুকুম তামিল না করি তাহলে এর পরিণতি সুলতানের অসন্তুষ্টি পর্যন্ত পৌঁছবে। আমি ভাবলাম যে, এবার আমার জন্য আর কোন ওযর অবশিষ্ট রইল না। এরপরও যদি আমি নির্জনতা অবলম্বন করি এবং নিঃসঙ্গ জীবনকেই বেছে নিই তা হবে আমার অলসতা, আরামপ্রিয়তা এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যের বােঝা হালকা করবারই নামান্তর, তা হবে পরীক্ষা ও দুঃখকষ্টপূর্ণ অবস্থা থেকে গা বাঁচিয়ে চলবার স্বার্থেই, অথচ আল্লাহ পাক ইরশাদ করেনঃ

أنسب الناس أن يتركوا أن يقولوا امثا وهم يفتنون – ولقد قثا الذين من قبلهم فليعلمن الله الذين صدقوا وليعلمن الكذبين

“মানুষ কি মনে করে যে, আমরা ঈমান এনেছি’ একথা বললেই ওদেরকে পরীক্ষা না করেই অব্যাহতি দেওয়া হবে! আমি তাে এদের পূর্ববর্তীদেরকেও পরীক্ষা করেছিলাম; আল্লাহ অবশ্যই প্রকাশ করে দেবেন কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী”। | -সূরা আনকাবুত, ২-৩ আয়াত। অধিকন্তু রসূল করীম (সা)-এর প্রতি, যিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত ও মর্যাদাবান ছিলেন, ইরশাদ করেনঃ

ولقد كذبت رسل من قبلك فصبروا على ماقبوا وأوثوا حتى أتاهم نصرنا – ولا مبدل لكلمات الله – ولقد جاءك من با المرسلين

“তােমার পূর্বেও অনেক রসূলকে অবশ্যই মিথ্যাবাদী বলা হয়েছিল; কিন্তু তাদেরকে মিথ্যাবাদী আখ্যা দেওয়া ও ক্লেশ দেওয়া সত্ত্বেও তারা ধৈর্য ধারণ করেছিল যে পর্যন্ত না আমার সাহায্য তাদের নিকট এসেছে। আল্লাহর আদেশে কেউ পরিবর্তন করতে পারে না। রসূলদের কিছু সংবাদ তােমার নিকট অবশ্যই এসেছে।”

-সূরা আন’আম, ৩৪ আয়াত।

আমি কতিপয় সূফী ও আধ্যাত্মিক পুরুষের সঙ্গে এ ব্যাপারে পরামর্শ করলাম। তারা সকলেই একমত হয়ে আমাকে নির্জনতা ছেড়ে বেরিয়ে আসবার পরামর্শ দিলেন। এর সমর্থনে আল্লাহর বহু সৎকর্মশীল বান্দা একাদিক্রমে স্বপ্ন দেখেন যা থেকে আমি অবহিত হই যে, আমার এ পদক্ষেপ বিরাট কল্যাণ ও বরকতের কারণ হবে এবং হিজরী পঞ্চম শতাব্দীর শুরুতে যার এক মাস মাত্র বাকী- সম্ভবত কোন বিরাট ও মহান সংস্কারমূলক কাজ হবে। আর তা এজন্য যে, হাদীছ শরীফে এসেছে, “আল্লাহ্ তা’আলা প্রতি শতাব্দীর মাথায় এমন একজন মানুষ পয়দা করেন যিনি এই উম্মতের দীনকে জীবন্ত করে তােলেন।” এই সব আলামত ও কার্যকারণদৃষ্টে আমার মনেও এরূপ আশা জাগরূক হল।

আল্লাহ তা’আলা আমার জন্য নিশাপুরের সফরের আয়ােজন করে দিলেন এবং আমি এই মহান খিদমতের জন্য নিয়ত করে ফেললাম। এটি ৪৯৯ হিজরীর যি’ল-কাদ মাসের ঘটনা। ৪৮৮ হিজরীর যিল-কাদাঃ মাসে বাগদাদ থেকে বহির্গত হয়েছিলাম। এই হিসাবে দেখা যায় আমি ১১ বছর নির্জন বাস করেছি। এসবই তকদীরে ইলাহীর পরিকল্পিত ব্যবস্থামাত্র। বাগদাদ থেকে বহির্গত হওয়া এবং সেখানকার প্রভাব-প্রতিপত্তি ও পদমর্যাদাকে বিদায় সালাম জানানাে আমার কল্পনায় আসত না, কিন্তু আল্লাহর হুকুমে তা সহজে হয়ে গেল। অনুরূপভাবে আমার এই নির্জনতা অবলম্বন কালীন যুগে নিঃসঙ্গ জীবন থেকে জনসমাবেশের মাঝে পুনর্বার ফিরে যাবার ধারণাও মনে উদয় হ’ত না, অথচ সময়ে তার আয়ােজনও সম্পন্ন হয়ে গেল।

মােটকথা, ৪৯৯ হিজরীর যিল-কাদা মাসে ইমাম সাহেব পুনরায় নিশাপুরের দিকে গতি ফেরালেন। তিনি নিজামিয়া মাদরাসায় অধ্যাপনার কাজে যােগ দিলেন। এবং পুনর্বার অধ্যাপনা ও কল্যাণধর্মী কাজে আত্মনিয়ােগ করলেন। কিন্তু ইমাম | গাযালী (র)-এর এবারকার দরস ও তাদরীস তথা পঠন-পাঠন, সংস্কার ও সৎ পথ প্রদর্শন এবং পূর্বেকার পঠন-পাঠন কার্যক্রম, ওয়াজ-নসীহত ও ইরশাদ-এর মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য ছিল। অনন্তর বিষয়টি তিনি নিজেই পরিষ্কার ভাষায় লিখেছেন :

আমি অনুভব করি যে, যদিও ইলম-এর প্রচার ও প্রসারের দিকে পুনরায় আমি ফিরে এলাম, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একে আমার প্রথম অবস্থার দিকে প্রত্যাবর্তন বলা ঠিক হবে না। আমার পূর্বের ও পরের অবস্থার ভেতর আসমান-যমীন ফারাক। প্রথমে আমি সেই “ইলম-এর প্রচার করতাম যা প্রভাব ও পদমর্যাদা বৃদ্ধির মাধ্যম ছিল এবং আমি আমার কথা ও কর্ম দ্বারা তারই দাওয়াত দিতাম এবং এটাই ছিল আমার অভীষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। কিন্তু এখন আমি সেই “ইলম-এর দাওয়াত দিই যার কারণে পদমর্যাদা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির মায়া চিরদিনের তরে কাটাতে হয়। এখন আমি আমার নিজের ও অন্যের সংস্কার ও সংশােধন চাই। আমি জানি না, আমি আমার অভীষ্ট লক্ষ্য পর্যন্ত পৌছুতে পারব কিনা অথবা এর পূর্বেই আমাকে কর্মের জগত থেকে চিরবিদায় নিতে হবে।

কিন্তু নিজস্ব ইয়াকীন ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে আমার ঈমান এই যে, আসল শক্তি আল্লাহুরই শক্তি। তারই কারণে মানুষ গােমরাহী ও মন্দ থেকে বাঁচতে পারে এবং হিদায়াত ও আনুগত্যের শক্তি অর্জন করতে পারে। আসলে আমি নিজের তরফ থেকে সচল ও সক্রিয় হইনি, আল্লাহই আমাকে সচল ও গতিশীল বানিয়েছেন। আমি নিজে থেকে কাজ শুরু করিনি, আল্লাহ পাকই আমাকে কাজে লাগিয়েছেন। আমার দু’আ, আল্লাহ পাক প্রথমে আমাকে সংশােধন করুন, অতঃপর আমা দ্বারা অন্যদের সংস্কার ও সংশােধন হােক; প্রথমে আমাকে পথে আনুন, এরপর আমা দ্বারা অন্যদের পথ প্রদর্শনের কাজ নিন। সত্য যেন আমার সম্মুখে উদ্ভাসিত হয় এবং তার বদৌলতে আমি যেন আনুগত্য করার সৌভাগ্য লাভ করতে পারি; বাতিল যেন আমার চোখে উজ্জ্বলভাবে প্রতিভাত হয় এবং আমি যেন তার অনুসরণ থেকে বাছি।

ইমাম গাযালী (র)-এর সংস্কার ও ইসলামী পুনর্জাগরণমূলক কাজঃ

ইমাম গাযালী (র) এরপর যে সংস্কার ও ইসলামী পুনর্জাগরণমূলক কাজ আঞ্জাম দেন তাকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়ঃ-

১. দর্শন ও বাতেনী মতবাদের বর্ধিত প্লাবনের মুকাবিলা এবং ইসলামের পক্ষ থেকে সে সবের মূল ভিত্তির ওপর আঘাত হানা।

২. সমাজ ও ব্যক্তিগত জীবনের ইসলামী ও নৈতিক পর্যালােচনা এবং সে সবের ওপর সমালােচনা ও সংস্কার।

দর্শনের ওপর কার্যকর অপারেশন

তাঁর প্রথম ও সর্ববৃহৎ কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের বিস্তারিত বিবরণ এই যে, ধর্মদ্রোহী মতবাদ ও বাতেনিয়াদের বিরুদ্ধে তখন পর্যন্ত যা কিছু করা হচ্ছিল তা ছিল আত্মরক্ষামূলক এবং প্রত্যুত্তর দেওয়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। সে সময় পর্যন্ত দর্শন ইসলামের ওপর হামলারত ছিল এবং মুতাকাল্লিমগণ ইসলামের সমর্থনে সাফাই পেশ করছিলেন। দর্শনশাস্ত্র ইসলামের মূল বুনিয়াদের ওপর কুঠারঘাত করত এবং ইলমে কালাম ইসলামের ঢাল হবার কোশেশ করত। সেই সময় পর্যন্ত মুতাকাল্লিমগণ ও উলামায়ে ইসলামের ভেতর কেউই স্বয়ং দর্শনের ভিত্তির ওপর আঘাত হানবার সাহস করেন নি। দর্শন যে সব কাল্পনিক ও মনগড়া বিষয়ের ওপর দাঁড়িয়েছিল কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত সে সবের ওপর আঘাত হানা এবং সে সবের জ্ঞানগর্ভ সমালােচনা করার হিম্মত কারাে হয়নি। ইমাম আবুল হাসান আশ’আরীকে বাদ দিলে (দর্শনের সঙ্গে যার সরাসরি টক্কর লাগে নি) গােটা “ইলমে কালামের কণ্ঠস্বর তথা উচ্চারণ ভঙ্গী ছিল আত্মরক্ষামূলক।

ইমাম গাযালী (র)-ই প্রথম ব্যক্তি যিনি দর্শনকে বিস্তারিত ও সমলােচনার নিরিখে অধ্যয়ন করেন। এরপর দার্শনিকদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য-এই নামে একটি বই লিখেন। এতে তিনি সহজ সরল ভাষায় বিশ্লেষণমূলক পন্থায়। যুক্তিবিদ্যা, অধিবিদ্যা তথা Metaphysics ও প্রকৃতিবিদ্যার খােলাসা বা সারসংক্ষেপ পেশ করেন এবং পরিপূর্ণ নিরপেক্ষতার সঙ্গে দার্শনিকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও আলােচনা লিপিবদ্ধ করেন। গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি খােলাখুলিভাবে বলেছেন যে, গণিতশাস্ত্রে আলােচনা কিংবা তর্ক-বিতর্কের সুযােগ নেই এবং ধর্মের সঙ্গে এর ‘হা” বা ‘না’-এর কোনরূপ সম্পর্ক নেই। কিন্তু ধর্মের আসল সংঘর্ষ অধিবিদ্যার সঙ্গে। যুক্তিবিদ্যায়ও খুব অল্পই ভুল আছে। যদি কিছু মতভেদ থাকে তা পরিভাষার ক্ষেত্রে। প্রকৃতিবিদ্যায় অবশ্যই সত্য-মিথ্যার তথা হক ও বাতিলের মিশ্রণ আছে। এজন্য তার আলােচ্য বিষয় প্রকৃতপক্ষে অধিবিদ্যা এবং কিছুটা পরিমাণ প্রকৃতিবিদ্যা। আর যুক্তিবিদ্যা কেবল ভূমিকাস্বরূপ ও পরিভাষার জন্য।

এই গ্রন্থ শেষ করে, যা ইলমে কালামের শিবিরে খুবই দরকার ছিল, তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘তাহাফতুল-ফালাসিফা’ (দার্শনিকদের ভ্রান্তি ও অসঙ্গতি) লেখেন যার জন্যই তিনি মাক “সি ‘দু’ল-ফালাসিফা’ লিখেছিলেন। এতে তিনি দর্শন, অধিবিদ্যা ও প্রকৃতিবিদ্যার ওপর ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচনা করেন। এবং তার জ্ঞানগত দুর্বলতা, তার যুক্তি-প্রমাণের অসারতা এবং দার্শনিকদের পারস্পরিক বৈপরীত্য ও মতভেদকে পরিপূর্ণ শক্তি ও সাহসিকতার সঙ্গে প্রকাশ করেন। উক্ত গ্রন্থে তাঁর কণ্ঠস্বর ও উচ্চারণভঙ্গী আবপূর্ণ, তাঁর ভাষা শক্তিশালী ও প্রস্ফুটিত, কোথাও কোথাও তা বিদ্রুপাত্মক ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভঙ্গি অনুসরণ করে, যা কিনা দর্শনশাস্ত্রের ভয়ে ভীত ও অভিভূত মহলের জন্য দরকার ছিল। তা পাঠ করলে অনুভূত হয় যে, গ্রন্থের গ্রন্থকার দার্শনিকদের মুকাবিলায় হীনমন্যতাবােধের সামান্যতম মিশ্রণ থেকেও মুক্ত ও পবিত্র, আস্থা ও দৃঢ় বিশ্বাসে তিনি ভরপুর এবং দর্শনশাস্ত্র সম্পর্কে তিনি এতটুকু আতংকিত কিংবা অভিভূত নন।

তিনি গ্রীক দার্শনিকদেরকে তারই কাতারের মানুষ মনে করেন এবং তাঁদের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে ও প্রতিদ্বন্দিতার ভাষায় কথা বলেন। সে সময় এমন একজন লােকেরই দরকার ছিল, যিনি দর্শনশাস্ত্রের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেন এবং আত্মরক্ষামূলক ও জবাবদিহির ভূমিকার পরিবর্তে দর্শনশাস্ত্রের ওপর পূর্ণ শক্তিতে আর্ঘাত হানতে পারেন। ইমাম গাযালী (র) তাহাফতুল-ফালাসিফা’ নামক গ্রন্থে এই খেদমতই আঞ্জাম দিয়েছেন। গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেছেনঃ

আমাদের যুগে এমন কিছু লােক জন্মেছে যাদের ধারণা এই যে, তাদের দিল ও দিমাগ তথা মন ও মস্তিষ্ক সাধারণ লােকের তুলনায় বিশিষ্ট। এ সমস্ত লােক ধর্মীয় বিধি-বিধান ও বাধ্যবাধকতাকে অবজ্ঞার চোখে দেখে। এর কারণ একমাত্র এই যে, তারা সক্রেটিস, হিপােক্রেট (Hippocrate-খৃ. পূ. ৪৬০৩৭৭), প্লেটো ও এরিস্টটলের ভীতিপূর্ণ নাম শুনেছে এবং তাদের শানে তাদের অনুরাগী ভক্তবৃন্দের বিরাট স্তুতিপূর্ণ গলগল্প ও লম্বা-চওড়া ফিরিস্তি শুনেছে। তারা জানতে পেরেছে যে, অংকশাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা ও অধিবিদ্যার ক্ষেত্রে তারা (সক্রেটিস প্রমুখ দার্শনিক) বিরাট সূক্ষ্ম দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন এবং তাদের বুদ্ধি ও মেধার সমকক্ষ কেউ ছিলেন না। তাঁরা তাঁদের উন্নত মস্তিষ্ক ও মেধার সঙ্গে ধর্ম ও তার আনুষঙ্গিক বিষয়ের অস্তিত্ব অস্বীকার করত।

তাদের নিকট তাদের ধর্মের মূলনীতি ও নিয়মবিধি ছিল মনগড়া ও কৃত্রিম। ব্যস, আর কথা নেই, তারাও তাদের গুরুদের অন্ধ আনুগত্যে বাদরামি অনুকরণ করতে গিয়ে ধর্ম অস্বীকার করাকে নিজেদের জন্য একটা ফ্যাশন বানিয়ে নিল। তারা। শিক্ষিত ও প্রগতিশীল নামে অভিহিত হবার খাহেশ মেটাতে ধর্মকে অস্বীকার করতে থাকল যাতে করে তাদের মর্যাদা সাধারণের তুলনায় উন্নত মনে করা হয় এবং তারা যাতে জ্ঞানী-গুণী ও বুদ্ধিজীবীদের কাতারে শামিল হতে পারে। এরই ভিত্তিতে আমি ইচ্ছা করলাম যে, ঐসব জ্ঞানী দার্শনিকরা ঐশী বিদ্যা (অধিবিদ্যা)-র ওপর যা কিছু লিখেছেন সে সবের ভ্রান্তি আমি দেখিয়ে দিই এবং প্রমাণ করে দিই যে, তাদের সংকট, সমস্যাবলী ও মূলনীতিগুলাে। ছেলেমিপূর্ণ এবং তাদের অনেক উক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গি সীমাহীন রকমের হাস্যকর।

এই গ্রন্থের সম্মুখে গিয়ে তার বর্ণনাশক্তি ও বিদ্রুপাত্মক লেখনী পদ্ধতি আরও শাণিত ও উদ্ধত হয়ে যায় এবং আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে দার্শনিকদের অত্যাশ্চর্য বিষয়সমূহ, বুদ্ধিবৃত্তি ও আকাশমার্গের পুরাে বংশতালিকা লেখেন যা দার্শনিকরা লিখেছেনঃ Imam Ghazzali

ثلنا ماذكرتموه تحكمات وهي على التحقيق ظلمات فرق للمات لو حكاه الانسان عن منام راه لاستدل على سوء مزاجه

তােমাদের এই যে বিস্তৃত বিবরণ, তা কেবল গালভরা দাবি ও স্বেচ্ছাচারিতা ছাড়া আর কিছু নয়, বরং প্রকৃতপক্ষে তা অন্ধকারের ওপর অন্ধকারের প্রলেপ মাত্র। যদি কোন ব্যক্তি তার নিজের দেখা এমন স্বপ্নও বর্ণনা করে তাহলেও তার মস্তিষ্ক বিকৃতির প্রমাণ হবে। সামনে এগিয়ে তিনি লিখেনঃ

الست أدري كيف يقنع المجنون من نفسه بمثل هذه الأوضاع فضلا عن العقلاء الذين يشقون الشعر بزعم في العقولات.

আমার বিস্ময় জাগে যে, পাগলেও কিভাবে এ ধরনের স্বনির্মিত ও স্বকপােলকল্পিত কথার ওপর তুষ্ট হতে পারে। সেখানে জ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবীদের কথা তাে ভাবাই যায় না, যারা তাদের নিজস্ব ধারণা মাফিক বােধগম্য বস্তুনিচয় ও সম্ভাবনার ভেতরও চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ছাড়েন। অন্যত্র লিখেন ?

انتهى بهم التعمق في التعظيم الي أن أبطلوا كل مايفهم من العظمة وقربوا حاله الميت الذي لاخبر له بما يجري في العالم الا انه فارق الميت في شعوره بنفسه نقط – وهكذا يفعل الله بالزانغين من سبيله والناكبین من طريق الهدى المنکرین لقوله تعالى ما أشهدهم خلق السموات والأرض ولا خلق أنفسهم الظانين بالله ظن السوء المعتقدين أن الأمور الربوبية نستعلی کنهها القوى البشرية المغرورين بعقولهم زاعمين أن فيها مندوحة عن تقليد الرسل واتباعهم فلا جرم اضطروا الى الاعتراف بان لباب معقولاتهم رجع الى مالوحكي في المنام لتعجب منه

প্রথম স্বয়ম্বর সম্মানে উচ্ছাস ও সীমাতিরিক্ততা প্রকাশ করতে গিয়ে তাঁকে (স্বয়ষ্ণু বা প্রথম স্রষ্টাকে) এমন সীমায় পৌঁছে দিয়েছে যে, তারা মর্যাদার সব শর্ত ও আবশ্যকীয় বিষয়াবলীকেও বাতিল আখ্যায়িত করেছে এবং আল্লাহ তা’আলাকে (নিজেদের দর্শনে) সেই মুর্দা লাশের ন্যায় বানিয়ে দিয়েছে যে জানেই না যে, বহির্জগতে কি হচ্ছে কিংবা ঘটছে। অবশ্য এই দিক দিয়ে তিনি (স্রষ্টা, স্বয়ং) মুর্দা অপেক্ষা ভাগ্যবান যে, তার উপলব্ধি ও অনুভূতি শক্তি লােপ পায়নি, বরং তা আছে (আর মৃত লাশের উপলব্ধি, চেতনা কিংবা অনুভূতি থাকে না)। আল্লাহ পাক এ ধরনের লােকদেরকে এমন পরিণতির সম্মুখীন করেন যে, তারা আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরে যায়, সৎ ও সত্য পরিত্যাগ করে এবং নিম্নোক্ত আয়াতকে অস্বীকার করে :

ما أشهدهم خلق السموت والأرض ولا خلق أنفسهم

“আর আমি সেই সব কাফির ও মুশরিকদেরকে আসমান ও যমীন সৃষ্টি করবার সময় সাক্ষী বানাই নি, এমন কি তাদের পয়দা করবার মুহূর্তেও না”, যারা আল্লাহর প্রতি কুধারণা পােষণ করে এবং খারাপ আকীদা রাখে, যাদের ধারণা যে, আল্লাহর রবুবিয়তের (পালনবাদ-এর) হাকীকতের ওপর মানবীয় শক্তি প্রভাব বিস্তার করতে পারে, যারা তাদের নিজেদের জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার ব্যাপারে গর্বিত এবং মনে করে যে, তাদের উপস্থিতি ও বর্তমান থাকা অবস্থায় পয়গম্বরদের অনুকরণ ও আনুগত্যের প্রয়ােজন নেই। নিশ্চিতরূপেই এর পরিণতি এই হয়েছে যে, তাদের মুখ দিয়ে (যুক্তিবুদ্ধির নামে) এমন সব হাস্যকর কথাবার্তার বেরােয়, যদি কেউ এ ধরনের স্বপ্নের বর্ণনাও দেয় তাহলে লােকে বিস্মিত হবে। তাহাফতুল-ফালাসিফার প্রভাব দর্শনশাস্ত্রের ওপর এই সাহসিকতাপূর্ণ সমালােচনা এবং নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত তার প্রতি অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য প্রদর্শন ইলম-ই-কালামের ইতিহাসে এমন একটি নতুন যুগের সৃষ্টি করে যার সার্বিক কৃতিত্ব ইমাম গাযালীর প্রাপ্য।

পরে শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবুন তায়মিয়া (র) এর পূর্ণতা দান করেন এবং দর্শনশাস্ত্র ও যুক্তিবিদ্যার মৃতদেহের “পােস্ট মর্টেম”-এর দায়িত্ব পালন করেন। দর্শনশাস্ত্রের অপারেশনের এই ধারার সূচনাও ইমাম গাযালী (র)-এর রচিত গ্রন্থাদি থেকেই। ‘তাহাফতুল-ফালাসিফা’ দর্শনশাস্ত্রের কাল্পনিক ভােজবাজির ওপর কার্যকর আঘাত হানে এবং তার শ্রেষ্ঠত্ব, মর্যাদা ও মেধাগত পবিত্রতাকে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই গ্রন্থের রচনা দর্শনশাস্ত্রের জগতে একটি অস্থিরতা, চাঞ্চল্য ও ক্রোধের জন্ম দেয়। কিন্তু শত বছর পর্যন্ত এর প্রত্যুত্তরে কোন উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ প্রণীত হয়নি, এমন কি হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষে দর্শনশাস্ত্রের প্রখ্যাত উৎসাহী প্রবক্তা ও এরিস্টটলের অনুসারী ইব্‌ন রুশদ (মৃত্যু ৫৯৫ হিজরী) “তাহাফতু’ততাহাফুত নামের একটি বইয়ের মাধ্যমে এর জবাব লেখেন। পাশ্চাত্যের বিদ্বানমণ্ডলী বলেন, যে দর্শনশাস্ত্র গাযালী (র)-এর আক্রমণে প্রায় মরণদশায় পৌছে গিয়েছিল, ইব্‌ন রুশদের সমর্থন তাকে এক শ’ বছরের জন্য পুনরায় জীবন দান করে। ১. তাহাফতুল-ফালাসিফা, ৩১ পৃ.। ২. প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে ইসলামী দর্শনের ইতিহাস-মুহাম্মদ সুফী জুম’আ, পৃ. ৭২।

বাতেনী মতবাদের ওপর হামলা | দর্শনশাস্ত্র ছাড়াও ইমাম গাযালী (র) বাতেনী মতবাদের ফেতনার দিকেও মনােযােগ দেন। তিনি বাগদাদের নিজামিয়া মাদরাসায় অধ্যাপনাকালে বাতেনীদের প্রত্যাখ্যানে ততকালীন খলীফার ইঙ্গিতে ‘আল-মুস্তাজহির’ নামক গ্রন্থ প্রণয়ন করেছিলেন, যার উল্লেখ তিনি তাঁর আত্মজীবনীমূলক ‘আল-মুনকি ‘য’ মিনাদ্দ লাল নামক গ্রন্থে করেছেন। এই গ্রন্থ ছাড়াও এই বিষয়ের ওপর তার আরও তিনটি গ্রন্থ রয়েছে যা সম্বত তার ভ্রমণকালীন সময়ের রচনাঃ হুজ্জাতুল-হক, মুফাসসালু’ল-খিলাফ ও কাসামুল-বাতেনিয়া’। তাঁর গ্রন্থের তালিকায় এই বিষয়ের ওপর Laura ও bluly নামক আরও দুটি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। বাতেনিয়া মতবাদের প্রত্যাখ্যানের জন্য প্রকৃতপক্ষে আহলে সুন্নাত ওয়াল-জামা’আত মহলে তার চেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি মেলা মুশকিল ছিল। তিনি দর্শনশাস্ত্র, তাসাওউফ, জাহিরী ইলম ও হাকীকত ও মা’রিফতের উভয় দিককার গলি-ঘুপচি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ছিলেন এবং তিনি বাতেনী মতবাদের রহস্য ভেদ ও তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ষড়যন্ত্রের পর্দা সহজেই উন্মােচন করতে পারতেন।

বাতেনী মতবাদের বড় অত্র ছিল দর্শনশাস্ত্র ও তার পরিভাষাসমূহ। শুধু ইমাম গাযালী (র)-এর মতই কোন পরিপক্ক ব্যক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির পর্যালােচক সে সবের প্রত্যাখানের কাজটি করতে পারতেন। বাস্তবেও তিনি তাই করেন। তিনি জ্ঞানগত দিক দিয়ে দর্শনশাস্ত্রকে এক নিষ্প্রভ ও গুরুত্বহীন বস্তুতে পরিণত করেন।

জীবন ও সমাজের ইসলামী পর্যালােচনা

ইমাম গাযালী (র)-এর অপর সংস্কারমূলক কাজ ছিল জীবন ও সমাজের ইসলামী পর্যালােচনা এবং তার সংস্কার ও পুনর্জাগরণের প্রচেষ্টা। তার এই প্রচেষ্টার একটি সফল পরিণতি তাঁর জীবন্ত ও চিরন্তন গ্রন্থ “এহইয়াউ উলুমিদ্দীন”। ইসলামের ইতিহাসে যে কতিপয় গ্রন্থ মুসলমানদের দিল ও দিমাগ তথা মন ও মস্তিষ্ক এবং তাদের জীবনের ওপর সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার করেছে তার ভেতর “এহইয়াউ উলুমিদ্দীন”-এর নাম সবিশেষ উল্লেখযােগ্য।

‘আলফিয়াহ’ নামক গ্রন্থের লেখক হাফিজ যয়নুদ্দীন আল-ইরাকী (মৃত্যু ৮০৬ হি.), যিনি ইহাতে উল্লিখিত হাদীছগুলাে খুঁজে বের করেছেন, বলেছেনঃ ইমাম গাযালী (র)-এর “এহইয়া উলুমুদ্দীন ইসলামের সর্বোত্তম গ্রন্থের একটি। ইমাম গাযালী (র)-এর সমসাময়িক ও ইমামুল-হারামায়ন-এর শাগরিদ আবদুল গাফির ফারসী বলেন : এহইয়া উলুমুদ্দীন-এর পূর্বে এ ধরনের কোন কিতাব রচিত হয়নি। শায়খ মুহাম্মদ গারুনীর দাবি ছিল, “যদি দুনিয়ার সমস্ত জ্ঞান-ভাণ্ডার নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়। তাহলে আমি “এহইয়া উলুমুদ্দীন”-এর দ্বারা পুনরায় তা জীবিত করে দেব।” হাফিজ ইবন জওহী কতিপয় বিষয়ে মতভেদ সত্ত্বেও এই গ্রন্থের প্রভাব ও ব্যাপক জনপ্রিয়তার স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং “মিনহাজুল-ক সে দীন” নামে এর সংক্ষিপ্তসার লিখেছেনঃ

এই গ্রন্থটি বিশেষ অবস্থা, মনােভঙ্গি ও বিশেষ প্রেরণা ও উৎসাহ নিয়ে লেখা হয়েছে। বাগদাদ থেকে সত্যের অন্বেষায় এবং সুদৃঢ় প্রত্যয় ও বিশ্বাসের সন্ধানে যে সফর ইমাম গাযালী (র) শুরু করেছিলেন যা সুদীর্ঘ দশটি বছরের কঠোরকঠিন সাধনা, মুজাহাদা ও নির্জনবাসের পর সফলতা লাভের মাধ্যমে শেষ হয়েছিল- “ইহ’য়াউ’ল-উলুম ছিল সেই সফরেরই বিশিষ্ট সওগাত, যা তিনি (গাযালী) স্বীয় দেশবাসীর জন্য বহন করে এনেছিলেন। এটি ছিল তার হৃদয়ের অভিব্যক্তি ও প্রতিক্রিয়া, জ্ঞানগত অভিজ্ঞতা, সংস্কারমূলক ধ্যান-ধারণা এবং হৃদয়ের স্বতঃউৎসারিত আবেগ ও মত্ততাবস্থারই দর্পণ।

মওলানা শিবলী নু’মানী তাঁর “আল-গাযালী (র) নামক গ্রন্থে লিখেছেন :

তার মধ্যে সত্য অনুধাবনের প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়। দুনিয়ার বুকে প্রচলিত সকল ধর্ম-বিশ্বাসই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তিনি দেখেন। কিন্তু কোনটিই তাকে পূর্ণ তৃপ্তি দিতে পারেনি, আশ্বস্ত করতে পারেনি। শেষাবধি তিনি তাসাওউফের দিকে ঝুঁকে পড়েন। কিন্তু তা মুখে বলে বােঝাবার বস্তু ছিল না, বরং আপাদমস্তক অনুভব করবার বিষয় ছিল। অনুশীলনের মাধ্যমে উপলব্ধি করবার বস্তু ছিল । আর তার পয়লা সৌন্দর্য (3) অভ্যন্তরীণ সংস্কার তথা ইসলাহে বাতেন ও তাযকিয়ায়ে নফস তথা আত্মার পরিশুদ্ধি। ইমাম সাহেবের কর্মব্যস্ততা ও পেশা ছিল এ পথের প্রতিবন্ধক। একদিকে জনপ্রিয়তা, নাম, খ্যাতি, পদমর্যাদা, সম্মান, প্রতিপত্তি, আলােচনা-বিতর্ক, আর অন্যদিকে আত্মার পরিশুদ্ধি। উভয়ের মাঝে সহস্র যােজনের ব্যবধান। শেষ পর্যন্ত তিনি সব কিছু ছেড়ে ছুঁড়ে একটি কম্বলমাত্র পরিধান করে বাগদাদ থেকে বেরিয়ে পড়েন। তখন থেকেই তাঁর প্রান্তর-জীবনের শুরু।

অতঃপর কঠোর রিয়াযত ও মুজাহাদার পর তিনি তাসাওউফের রহস্য উদ্যানে প্রবেশাধিকার লাভ করেন। এখানে পৌঁছার পর স্বীয় অবস্থায় মত্ত হয়ে গােটা জীবন ও জগত থেকে তাঁর বেখবর হয়ে পড়ার আশংকা ছিল। কিন্তু এই অবস্থায়ও সাধারণের কল্যাণের দিকে ছিল তাঁর কড়া নজর। তিনি দেখতে পেলেন, ব্যাপক জনগণের অবস্থা বিগড়ে গেছে। ধনী-দরিদ্র, বিশিষ্ট-অবিশিষ্ট, জ্ঞানী-মূর্খ, চরিত্রবান-দুশ্চরিত্র সকলেরই নৈতিক চরিত্র হয় ধ্বংস হয়ে গেছে, নয়ত হতে যাচ্ছে। উলামা সম্প্রদায়, যারা সত্য পথের দলীলস্বরূপ হতে পারতেন, তারাই জাকজমক ও পদমর্যাদার কাঙাল। এসব দৃশ্য তাকে ব্যথিত করে তােলে। আর তারই প্রতিক্রিয়াস্বরূপ তিনি এই গ্রন্থ রচনা করেন।

ভূমিকায় তিনি নিজেই লিখেছেন, “আমি দেখতে পেলাম, রােগব্যাধি গােটা জগতটাকে ছেয়ে ফেলেছে এবং পারলৌকিক সৌভাগ্যর রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। উলামা, যারা ছিলেন সত্য পথের দলীলস্বরূপ, ক্রমেই তাদের অস্তিত্ব লােপ পাচ্ছে। আলিম নামধারী যারা এখনাে আছেন, তারা নামকাওয়াস্তে ‘আলিম, ব্যক্তিগত স্বার্থ ও উদ্দেশ্য তাদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। তাদের মতে, “ইলম স্রেফ তিনটি জিনিসের নাম, যথা : মুনাজারাহ বা পারস্পরিক বিতর্ক অনুষ্ঠান (যা গর্ব, অহমিকা ও যশ লাভের মাধ্যম); ওয়াজ বা বক্তৃতা (যার ভেতর জনসাধারণের মনােরঞ্জনের জন্য রঙীন ও ছন্দোবদ্ধ ছড়া, কবিতা ও শ্লোক আবৃত্তি করা হয়) এবং ফতওয়া প্রদান (যা বিভিন্ন মামলা-মােকদ্দমার ফয়সালার মাধ্যম)। বাকী রইল আখিরাতের ইলম। এটা মূল লক্ষণীয় বিষয় হলেও অধিকাংশ আলিমই তা ভুলে গিয়েছে। এতদৃষ্টে আমি আর ধৈর্য ধারণ করতে পারলাম না। আমার নিস্তব্ধতা ভেঙে চুরে খান খান হয়ে গেল।”

পর্যালােচনা ও হিসাব-নিকাশ

ইমাম গাযালী (র)-এর গ্রন্থ প্রণয়নের উদ্দেশ্য ছিল ইসলাহ ও তরবিয়ত তথা সংস্কার-সংশােধন ও প্রশিক্ষণ। আর এজন্য জরুরী ছিল সে সব দুর্বলতা ও খারাপ দিকগুলাে চিহ্নিত করা যা শিক্ষা ও ধর্মীয় কেন্দ্রগুলােতে এবং সাধারণভাবে মুসলিম জনসমাজে বিদ্যমান ছিল। অধিকন্তু প্রয়ােজন ছিল, নফস ও শয়তান কিভাবে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষকে ধোকা দিয়ে রেখেছে, হাকীকতসমূহ কিভাবে বদলে গেছে, মানুষ কিভাবে হাকীকত থেকে সরে গিয়ে বাহ্যিক আবরণ, চাকচিক্য ও রসম-রেওয়াজের মধ্যে নিজেদের বন্দী করে ফেলেছে অর্থাৎ জীবনের মূল লক্ষ্য তথা পারলৌকিক সৌভাগ্য, রি-ই-ইলাহী ও আল্লাহর সন্তুষ্টি থেকে কিভাবে তারা গাফিল হয়ে পড়েছে, তা জনসাধারণের গােচরীভূত করা। এজন্য তিনি স্বীয় যুগের জীবন-যাত্রা ও সমসাময়িক সমাজের কার্যকলাপের পূর্ণ পর্যালােচনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন এবং প্রতিটি শ্রেণীর রােগ-ব্যাধি ও ত্রুটি-বিচ্যুতি তথা ভুল-ভ্রান্তিগুলাে পরিষ্কার ভাষায় বর্ণনা করেন, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও উপায়উপকরণাদির ভেতর পার্থক্য নির্ণয় করেন, “ইলম-এর মধ্যে ধর্মীয় “ইম ও পার্থিব “ইলম, অতঃপর প্রশংসিত ‘ইলম ও নিন্দনীয় ইলম, অতঃপর ফরয-ই-আইন, ফরয-ই-কিফায়া ইত্যাদির শ্রেণী বিন্যাস করেন।

তিনি সময়ের দাবি অপরিহার্য দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং মূল কর্মের দিকেও সকলের মনােযােগ আকর্ষণ করেন। ধনিক ও বিত্তশালীদের দায়িত্বহীনতা, গাফিলতি ও তাদের বিশেষ ও যথার্থ রােগ-ব্যাধিগুলাে খােলাখুলি বর্ণনা করেন। সুলতান ও শাসন কর্তৃত্বে সমাসীন ব্যক্তিবর্গের নির্ভীক সমালােচনা করেন এবং তাদের জোর-জুলুম ও নির্যাতন, শরীয়তবিরুদ্ধ কার্যকলাপ ও আইন-কানুনের নিন্দা করেন। এতদ্ভিন্ন তিনি জনসাধারণের ব্যাধিসমূহ, বিভিন্ন শ্রেণীর ও স্থানের গহিত আচরণসমূহ, নিন্দনীয় অভ্যাস এবং ইসলাম বিরােধী ধর্মীয় প্রথা-পদ্ধতি ও বিদ’আতমূলক কর্মের বিস্তারিত বিবরণ দেন।

মােট কথা, এই গ্রন্থটি ইসলামের প্রথম বিস্তারিত ও যুক্তি-প্রমাণভিত্তিক গ্রন্থ যার মধ্যে গােটা জীবনের ও বিগড়ে যাওয়া ইসলামী সমাজব্যবস্থার পরিপূর্ণ খতিয়ান রয়েছে এবং নৈতিক চরিত্রের ব্যাধিগুলাের উৎস ও তার কারণ এবং এর চিকিৎসা-পদ্ধতির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।

উলামা ও ধার্মিক ব্যক্তিবর্গ

ইমাম গাযালী (র)-এর মতে, বিশ্বব্যাপী অশান্তি, বিপর্যয় ও ধর্মীয় ও চারিত্রিক অবনতির সর্বাপেক্ষা বড় যিম্মাদার উলামায়ে কিরাম যারা মুসলিম উম্মার জীবনে লবণস্বরূপ। যদি লৰণই নষ্ট হয়ে যায় তাহলে এমন কোন বস্তু আছে যা তাকে ভাল করতে পারে? কবির ভাষায় ঃ

با معشر القراء يا ملح البلد + ما يصلح الملح اذ الملح فسد

ওহে উলামা সম্প্রদায়! তােমরা যারা শহরের লবণসদৃশ, আমাকে বলে দাও, যদি লবণই নষ্ট হয়ে যায় তাহলে আর কি দিয়ে তা ভাল করা যায়? অন্তরের ব্যাধির আধিক্য ও সাধারণ মানুষের গাফিলতির কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে এক স্থানে তিনি লিখেছেনঃ

الثالثة وهو الداء العضال فقد الطبيب فان الاطباء هم العلماء وقد مرضوا في هذه الاعصار مرضا شديدة وعجزوا من علاجه

তৃতীয় কারণ এবং সেটাই এমন ব্যাধি যার চিকিৎসা নেই আর তা এই যে, রােগী বর্তমান, কিন্তু চিকিৎসক লাপাত্তা। উলামায়ে কিরাম সমাজের চিকিৎসক আর তারাই এ যুগে ব্যাধিতে সাংঘাতিকভাবে আক্রান্ত। সুতরাং চিকিৎসা করতে তারা অক্ষম।

তাঁর মতে, সুলতান ও শাসকবর্গের খারাপ হবার কারণ ‘উলামায়ে কিরামের কমযােরী এবং স্বীয় দায়িত্ব পালনে তাঁদের গাফিলতি। এক স্থানে তিনি লিখেছেন:

وبالجملة انما فسدت الرعية بفساد الملوك وفساد الملوك بفساد العلماء فلولا القناة السوء والعلماء السوء لقل خوفا من انگار هم

সংক্ষিপ্তসার এই যে, প্রজাবর্গের খারাপ হবার কারণ রাজা-বাদশাহর তথা শাসন কর্তৃত্বে সমাসীন ব্যক্তিবর্গের খারাবী এবং উলামায়ে কিরামের খারাপ হওয়া বাদশাহ তথা শাসকবর্গের খারাপ হবার কারণ। যদি আল্লাহভীতিহীন কাযী ও উলামায়ে (‘সূনীতি, আদর্শ ও চরিত্রহীন স্বার্থসর্বস্ব দুনিয়াদার ‘আলিম) না থাকত তাহলে শাসককুল এভাবে বিগড়ে যেত না, বরং তারা ‘আলিমদের সমালােচনাকে ভয় করেই চলত।

সে যুগের ‘আলিমদের সম্পর্কে ইমাম গাযালী (র)-এর অভিযােগ যে, তারা পূর্ব যুগের আলিম-উলামার ন্যায় আমর বিল-মা’রূফ ওয়া নাহী আনিল মুনকার তথা সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ এবং অত্যাচারী শাসকের সম্মুখে হক-কথা বলার দায়িত্ব পালন করছেন না। তার মতে, এর কারণ এই যে, ‘আলিম-উলামা দুনিয়াদার হয়ে গেছেন এবং পদমর্যাদার পেছনে ঘুরছেন। তিনি সে যুগের সুলতান ও শাসনকর্তৃত্বে সমাসীন ব্যক্তিবর্গের সম্মুখে সত্যপন্থী উলামায়ে কিরামের সাহসিকতা, নির্ভীকতা ও হিসাব গ্রহণ ও অস্বীকৃতি জ্ঞাপনের প্রভাবমণ্ডিত ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করবার পর বলেনঃ Imam Gazzali

এই ছিল আলিমদের কর্মপদ্ধতি এবং আমর বিল-মা’রূফ ও নাহী আনিলমুনকার’-এর অবস্থা। রাজা-বাদশাহর শান-শওকতের এতটুকু পরওয়া তাদের ছিল না। তারা আল্লাহর অনুগ্রহের ওপর আস্থাশীল ছিলেন এবং নিশ্চিন্ত ও আশ্বস্ত ছিলেন যে, আল্লাহতা’আলা তাদেরকে হেফাজত করবেন। তাঁরা আল্লাহ তা’আলার সেই ফয়সালার ওপরও রাজী ছিলেন যে, তাদের ভাগ্যে শাহাদত লাভ ঘটুক। যেহেতু তাঁদের নিয়ত ছিল ভালো, সেহেতু তাঁদের কথায় পাথরও মােমের মত গলে যেত এবং বিরাট থেকে বিরাটতর পাষাণ হৃদয়ও প্রভাবিত হত।

এখন তাে অবস্থা এই যে, দুনিয়ার লােভ ‘আলিমদের বােবা বানিয়ে দিয়েছে এবং তারা একেবারে নিশ্চুপ। আর যদি কখনও তারা মুখ খােলে তাহলে দেখা যায় তাদের কথা ও কাজের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য নেই। ফলে তাদের কথায়ও কোন আছর হয় না। যদি আজও তারা নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে কাজ করেন এবং ইলম-এর হক আদায় করার চেষ্টা করেন তাহলে অবশ্যই তারা কামিয়াব হবেন। কেননা প্রজাবৃন্দের খারাপ আচরণ শাসকবর্গের খারাপ আচরণের পরিণতিমাত্র। আর শাসকবর্গের আচরণের খারাপ দিকগুলাে আলিম-উলামার খারাপ আচরণের পরিণতি ছাড়া কিছু নয়। আলিমদের মন্দ হওয়ার কারণ পার্থিব সম্পদ ও উচ্চ পদমর্যাদা প্রীতি। কেননা যার ওপর দুনিয়ার ভালবাসা চেপে বসে সে উচ্চ পর্যায়ের লােক কিংবা রাজা-বাদশাহদের সমালােচনা করাতাে দূরের কথা, নিম্নশ্রেণীর একটি লােকেরও হিসাব গ্রহণের এবং তার ভুল-ত্রুটিগুলাে ধরিয়ে দেবার সাহস রাখে না।

ইমাম গাযালী (র)-এর যুগে একজন আলিমের জগত ফিকাহের ছােটখাটো ও খুঁটিনাটি ইখতিলাফী মসলা-মাসাইলের ভেতরই সীমাবদ্ধ ছিল। আলােচনাসমালােচনা ও তর্ক-বিতর্কের মজলিস বসত ঘরে ঘরে, দেশের-আনাচে-কানাচে। বাদশাহদের দরবারগুলাের রওনকও ছিল এই সব মাযহাবী ও ফিকহ বাহাছ-মুবাহাছা ও বিতর্কমূলক অনুষ্ঠান। এ ব্যাপারে উলামা ও ছাত্রদের মগ্নতা ও বাড়াবাড়ি এতটা বেড়ে গিয়েছিল যে, অন্যান্য সব জ্ঞান-বিজ্ঞান, পেশা ও দীনী খেদমতের বিভিন্ন বিভাগ উপেক্ষিত হতে চলেছিল। এর সীমা এত দূর বিস্তৃত হয়েছিল যে, আত্মার সংস্কার, চারিত্রিক শালীনতা ও পারলৌকিক সৌভাগ্য যেই ইলম ও প্রয়াসের ওপর নির্ভরশীল তা থেকে সবার মনােযােগ সরে গিয়েছিল। ইমাম গাযালী (র) এই অবস্থা সম্পর্কে সমালােচনা করতে গিয়ে লিখেছেন :

“যদি কোন ফকীহকে সে সব বিষয়ের (সবর, শােকর, আশা ও ভয় অথবা হিংসা, বিদ্বেষ, ঈর্ষা, অকৃতজ্ঞতা, প্রতারণা, ধোকা ইত্যাদির) কোন একটি সম্পর্কে অথবা ইখলাস, তাওয়াক্কুল ও রিয়া থেকে বেঁচে থাকবার পন্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয় যা জানা তার জন্য ফরযে আইন এবং এর প্রতি এতটুকু গাফিলতি প্রদর্শনের ভেতর আখিরাত বরবাদ হবার বিপদাশংকা বিদ্যমান, তাহলে তিনি জবাব দিতে পারবেন না। আর যদি (ক) লি’আন, (খ) জিহার সবক ও (গ) রমী সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় তাহলে তিনি এর জবাবে এমন সব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ও খুঁটিনাটি বিষয়ের অবতারণা করবেন, বহুকাল ধরে যার কোন আবশ্যকতা দেখা দেয় নি এবং কখনাে যদি দেখাও দেয় তাহলে শহরে এ সম্পর্কে ফতওয়া দেবার মত লােকের কোন অভাব নেই। অথচ দেখা যাচ্ছে, এই সব ‘আলিম দিনরাত শুধু এই জাতীয় খুঁটিনাটি বিষয় নিয়েই মাথা ঘামাচ্ছেন এবং মুখস্থ করে এগুলােরই পাঠ দানে ব্যাপৃত রয়েছেন। অপরদিকে তারা সেই সব বিষয় থেকে পরাঙ্মুখ রয়েছেন যা ধর্মীয় দিক দিয়ে তাদের জন্য জরুরী। যদি কখনাে তাদেরকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় তাহলে তারা বলেন ; আমরা এই ইলম-এর ভেতর মশগুল রয়েছি এজন্য যে, এটা ধর্মীয় ‘ইলম ও ফরযে কিফায়া।

তারা তাদের শিক্ষা দান ও শিক্ষা গ্রহণ সম্পর্কে নিজেদেরকেও ভুল পথে পরিচালিত করেন এবং অন্যদেরকেও বিভ্রান্ত করেন। অথচ বুদ্ধিমান ও সমঝদার মানুষ বেশ ভালভাবেই জানেন যে, যদি তাদের উদ্দেশ্য হয় ফরযে কিফায়ার হক আদায় করা এবং স্বীয় যিম্মাদারীর হাত থেকে মুক্ত হওয়া, তাহলে তারা সেই ফরযে কিফায়ার ওপর এই ফরযে ‘আইনকে অগ্রাধিকার দিতেন। তাছাড়া আরাে কিছু কিছু ফরযে কিফায়া আছে যেগুলাের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া উচিত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বহু শহর এমন রয়েছে যেখানে কেবল অমুসলিম চিকিৎসক রয়েছেন যাদের সাক্ষ্য ফিকহী বিধানে কবুল করা যায় না। অথচ আমরা দেখতে পাই না যে, কোন ‘আলিম (এই কমতি ও যরুত অনুভব করে) চিকিৎসাশাস্ত্রের দিকে মনােযােগ দিয়েছেন, বরং দেখা যায় এর মুকাবিলায় ছাত্ররা ইলমে ফিক্হ, বিশেষ করে বিরােধিতা ও বিতর্কমূলক বিষয়ের ওপরই ঝাপিয়ে পড়ছে। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের ‘আলিম দ্বারা শহর ভতি যাদের একমাত্র কাজ ফতওয়া প্রদান ও মসলা-মাসায়েল বাৎলে দেওয়া। আমার উপলব্ধিতে আসে না, উলামায়ে দীন শুধু এ ধরনের ফরযে কিফায়ার ভেতর মশগুল হওয়াকে কিভাবে সঠিক মনে করেন এবং এমন ফরযকে কিভাবে তারা পেছনে ফেলে রাখেন যার প্রতি এখনই মনােযােগ দেওয়া জরুরী। এর কারণ কি এই যে, চিকিৎসাশাস্ত্রের মাধ্যমে ওয়াক্ফ সম্পত্তির মুতাওয়াল্লী, য়াতীমের ধন-সম্পদের তত্ত্বাবধায়ক

এবং কাযী বা মুফতী হওয়া যায় না কিংবা সমবয়সীদের ওপর প্রাধান্য অর্জন

এবং দুশমন ও প্রতিপক্ষের ওপর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব লাভ করা যায় না। অন্য এক স্থানে লিখেছেন ?

এমন অনেক ফরযে কিফায়া আছে যেগুলাের দিকে দৃষ্টি দেবার কেউ নেই। ‘আলিম-উলামাদেরও সে দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। বেশি দূর যাবার দরকার নেই। চিকিৎসাশাস্ত্রের কথাই ধরুন। অধিকাংশ মুসলিম শহরে কোন মুসলিম চিকিৎসক নেই, অথচ একমাত্র তাদের সাক্ষ্যই শর’ঈ বিষয়াবলীতে নির্ভরযােগ্য। উলামায়ে কিরামের এই পেশার প্রতি এতটুকুও আকর্ষণ নেই। অনুরূপভাবে আমর বিল-মা’রূফ ও নাহী আনিল-মুনকারও ফরযে কিফায়া (কিন্তু এটিও পরিত্যক্ত হচ্ছে)।

তিনি এক স্থানে মূর্খতা, অলসতা ও দীন-ধর্ম সম্পর্কে ব্যাপক অজ্ঞতার এবং তাবলীগ ও সাধারণ তা’লীমের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেনঃ যে ব্যক্তির নিজের দীন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা ও উদ্বেগ আছে সে তাবলীগ ও তালীম ছেড়ে এমন সব বিষয় নিয়ে, যা কদাচিৎ ঘটে, কখনাে ব্যস্ত থাকতে পারে না। | কেন ইখতিলাফী মসলা-মাসাইল বিগত যুগগুলােতে অত্যধিক গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছেঃ “উলামায়ে কিরাম কেন একে নিজেদের মেধা ও পরিশ্রমের ক্ষেত্র বানিয়ে নিয়েছেন? ইমাম গাযালী (র)-এর মতে এর কিছু ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে এবং সে সবের ফলে এমনটি হওয়া বিলকুল স্বাভাবিক ছিল। তিনি লিখেছেন।

মহানবী (সা)-এর পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হযরত খুলাফায়ে রাশেদীন (রা) নিজেরা স্বয়ং বড় ‘আলিম, ফকীহ ও ফতওয়া দানের অধিকারী ছিলেন। তাই তাদের কদাচিৎ কোন বিশেষ অবস্থায় অন্য কোন জ্ঞানী ও বিজ্ঞ সাহাবা (রা)-এর দ্বারস্থ হবার প্রয়ােজন হ’ত। ফলে ‘আলিম সাহাবীরা পারলৌকিক “ইলম-এর মধ্যেই ডুবে ছিলেন। যদি কখনও কোন ফতওয়া এসে উপস্থিত হত তাহলে তাঁরা এ ব্যাপারে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বনের জন্য নিজেদের মধ্যে যােগ্যতর ব্যক্তিকেই অগ্রাধিকার দিতেন এবং নিজেরা সার্বক্ষণিকভাবে আল্লাহর ধ্যানে নিবিষ্ট থাকতেন। যখন সে সব লােকের পালা আসল যারা খিলাফতের হকদার বা যােগ্য ছিলেন না এবং যাদের ভেতর কোন বিষয়

মনসুর হাল্লাজ এর জীবনী-বানী-কারামত ও কালাম-হযরত-মানসুর আল–হাল্লাজ

মনসুর হাল্লাজ এর জীবনী-বানী-কারামত ও কালাম-হযরত-মানসুর আল–হাল্লাজ

হযরত হুসাইন মনসুর হাল্লাজ (রহ:)আধ্যাত্বিক জগতের আলোড়ণ সৃষ্টিকারী এক বিস্ময়কর মহাপুরুষ ছিলেন। তাঁর পাণ্ডিত্য ও বাগ্মিতা ছিল যেমন অসাধারণ, তার আধ্যাত্বিক চেতনাও তেমনি ছিল অপরিসীম। তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন । কিন্তু বক্তব্য বিষয়ের গুঢ়ার্থ ছিল দুর্বোধ্য। এবাদতে তাে কথাই নেই। তাঁর আল্লাহ্ প্রেমেরও কোন তুলনা ছিল না। আল্লাহ প্রেমে তিনি ছিলেন নিয়ত অস্থির। আল্লাহর বিরহানলে তিনি দগ্ধ হয়েছেন দিন রাত। আর এজন্য জীবনে কষ্টও পেয়েছেন প্রচুর। শেষ পর্যন্ত নিজের অমূল্য প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। আল্লাহর ওয়াস্তে মানুষের হাতে।

মনসুর হাল্লাজ

মানুষ তার কাজকর্মে বিরক্ত হতেন। তার বহু কাজে আপত্তি ছিল সুফী দরবেশগণেরও। তারা সে সবের প্রতিবাদ করতেন। তার চলাফেরা, কথাবার্তার মর্ম উপলদ্ধি করতে না পেরে তারা বলতেন, তাসাওউফে তাঁর কোন দখল নেই। অবশ্য হযরত আবদুল্লাহ খাফীফ রহমাতুল্লাহ, হযরত শিবলী রহমাতুল্লাহ, হযরত আবুল কাসেম নসরাবাদী রহমাতুল্লাহ, ইবনে আতা রহমাতুল্লাহ প্রমুখ প্রখ্যাত তাপসগণ তাকে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন দরবেশ বলে মনে করতেন। আবার অনেকে তাঁকে কাফের বলেছেন। তাঁর ওপর অত্যাচার করেছেন। অনেকে বলেন, তিনি ছিলেন ইত্তেহাদী। সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে কোন পার্থক্য দেখতে পেতেন না। মূলত এই গঢ়তত্ত্ব সাধারণ মানুষের বােধগম্য নয়। বাগদাদের কিছু লােক হাল্লাজী বা তাঁর অনুসারী বলে দাবী করতেন আর নানা অপকর্মে লিপ্ত হতেন।

‘আনাল হক’

তিনি একবার বলেছিলেন ‘আনাল হক’। অর্থাৎ আমিই আল্লাহ। তার ওপর যে অকথ্য জুলুম হয়, তার কারণই হল এ উক্তি। কিন্তু বর্তমান গ্রন্থকার হযরত ফরীদ উদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ বলেন, আমি এটাকেই অত্যন্ত আশ্চর্য মনে করি যে, হযরত মূসা (আঃ) যখন তুর পর্বতে আল্লাহর জ্যোতি দর্শন করেন, তখন গাছ থেকে ইন্নী আনাল্লাহ’ নিশ্চয় আমি আল্লাহ এই শব্দ শােনা গিয়েছিল। বলা হয়, এ আওয়াজ ছিল স্বয়ং আল্লাহর, গাছের নয় । তা হলে হযরত মানসুর হাল্লাজের রহমাতুল্লাহ মুখ থেকে যখন ‘আনাল হক’ কথাটি বের হয়, তখন কেন বলা হবে না তার মুখের বাণীটি আসলে আল্লাহর বাণী। হযরত হুসাইন মানসুর হাল্লাজের রহমাতুল্লাহ মুখের কথা নয়। হযরত ফরীদ উদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ আরও বলেন, তাঁর বেলায়ও তাে বলা যেতে পারে যে, তার জবানে খােদ আল্লাহই ‘আনাল হক” কথাটি উচ্চারণ করেছেন। এটি হযরত হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ-এর কথা নয়। তিনি নিজে আল্লাহ হওয়ার দাবীও করেননি।

হযরত শায়খ ফরীদ উদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ বলেন, বাগদাদ শহরে হুসাইন মনসুর নামে এক জাদুকর ছিল, কেউ কেউ তার সঙ্গে তাপসকে গুলিয়ে ফেলেছেন। আসল ঘটনা কিন্তু অন্য রকম। জাদুকরের জন্ম ওয়াসেত শহরে আর মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ বাস করতেন বাগদাদে । যাই হােক, হযরত আবদুল্লাহ খফীফ বলেন, হুসাইন মনসুর রহমাতুল্লাহ আল্লাহর মারেফাতে জ্ঞানী ছিলেন। হযরত শিবলী রহমাতুল্লাহ বলেন, হযরত মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ ও আমি- আমরা দুজন একই অবস্থার লােক। পার্থক্যটুকু এই যে, আল্লাহর দাবীদার মনে করে মানুষ তাকে ধ্বংস করেছে, আর আমাকে পাগল মনে করে দূর করে দিয়েছে। | হযরত মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ-এর সঠিক জন্মস্থান জানা যায় না। তবে তার বাল্য ও কৈশাের অতিবাহিত হয় বাগদাদে। আঠারাে বছর বয়সে তিনি ততরে চলে যান। সেখানে হযরত আবদুল্লাহ তশতরী রহমাতুল্লাহ-এর সংস্পর্শে দু’বছর কাটান। তারপর বসরা। বসরা থেকে দাওহারকা। সেখানে হযরত আমর ইবনে ওসমান মক্কী রহমাতুল্লাহ-এর সাহচার্যে আসেন। আর এখানেই তিনি বিবাহ করেন। হযরত ইয়াকুব আতা রহমাতুল্লাহ-এর কন্যাকে। অতঃপর হযরত ইয়াকুব রহমাতুল্লাহ-এর সঙ্গে মনােমালিন্য হওয়ায় তিনি বাগদাদে হযরত জুনায়েদ রহমাতুল্লাহ-এর দরবারে চলে আসেন। এখানে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে তিনি চলে যান মক্কায়। সেখানে এক বছর কাটান। তারপর একদল সুফী সাধকের সঙ্গে তিনি আবার বাগদাদে আসেন। এই সময় তিনি হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহমাতুল্লাহ-এর কাছে একটি জটিল মাসআলার উত্তর জানতে চান। কিন্তু হযরত জুনায়েদ রহমাতুল্লাহ তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন, তুমি কুব শীঘ্রই ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলবে। হযরত মানসুর রহমাতুল্লাহ বলেন, আমি যেদিন ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলব, সেদিন আপনার অঙ্গেও এ সুফী পােশাকের পরিবর্তে মামুলী পােশাক দেখা যাবে।

দু’জনের ভবিষ্যদ্বাণীই সফল হয়। পরবর্তীকালে, তাঁর আপাতঃ শরীয় বিরােধী কার্যকলাপের জন্য দেশের সমগ্র আলেম সমাজ যখন তাঁকে হত্যা করার ফতোয়া দেন, তখন কেবল হযরত জুনায়েদ রহমাতুল্লাহ-ই ফতােয়ায় সই করেননি। কেননা, তখন পর্যন্ত তিনি প্রকৃত সুফীই ছিলেন। সুতরাং তার পক্ষে হযরত মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ-এর হত্যার সিদ্ধান্তে সম্মতি পােষণ করা সম্ভব ছিল না। দেশের খলীফা বললেন, মানসুর রহমাতুল্লাহ-এর বিরুদ্ধে এ ফতােয়াকে যদি শুদ্ধ প্রমাণ করতে হয়, তবে হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহমাতুল্লাহ-এর স্বাক্ষর একান্ত জরুরী। উপায়ান্তর না দেখে হযরত জুনায়েদ রহমাতুল্লাহ সুফীর পােশাক পরিত্যাগ করে খানকা থেকে মাদ্রাসায় চলে গেলেন। আর সেখানে প্রকাশ্য আলেমের পােশাক পরে ফতােয়ায় সই করলেন। তাতে তিনি মন্তব্যে লেখেন, প্রকাশ্য কাজকর্মের দিক থেকে মনসুর প্রাণদন্ডের উপযুক্ত। আর ফতােওয়া প্রদান করা হয় সাধারণতঃ বিচার বা ব্যবস্থা অনুসারেই। গুপ্ত অবস্থা মানুষের জন্য দেখা সব নয়। তার লি’র ব্যবস্থা আল্লাহই করে থাকেন।

হযরত জুনায়েদ রহমাতুল্লাহ-এর কাছে মাসআলার উত্তর না পেয়ে হযরত মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ মনে এত বেশী দুঃখ পান যে, তাকে কিছু না বলেই সস্ত্রীক তশতরে চলে যান। তশতরবাসী তাকে সাদরে গ্রহণ করেন এবং তিনি এক বছরেরও ওপর সেখানে সসম্মানে বাস করেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে মতানৈক্য হতে খুব বেশী দেরী হল না। কারও মন যুগিয়ে চলা ছিল তার স্বভাব বিরুদ্ধ। বিশেষ করে আলেম সমাজকে তিনি তেমন আমল দিতেন না। তার ওপর ছিল হযরতের আমর ইবনে ওসমান মক্কী রহমাতুল্লাহ-এর প্ররোচনা। তিনি তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। তিনি মক্কা থেকে তার বিরুদ্ধে খােরাসানবাসীদের উত্তেজিত করে তােলেন। ফলে মর্মাহত মানসুর রহমাতুল্লাহ দরবেশী পােশাক ছেড়ে সাধারণ বেশে সমাজের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গেলেন। এ যেন এক অজ্ঞাতবাস। আর এভাবে কাটল পাঁচ বছর। তিনি কখনও খোরাসানে, কখনও মাওরান্নহরে, কখনও বা নীমরােজে, সিন্তানে, কেরমানে- ইত্যাদি নানা স্থানে ঘুরে বেড়ান। শেষে গেলেন পারস্যে। আর এখানে রচনা করলেন বহু মূল্যবান গ্রন্থ। তাছাড়া আহওয়াজবাসীদের উপদেশ দিয়ে তাদের অনুকূল্য লাভ করলেন। তাঁর বক্তৃতা, উপদেশ সব কিছুই ছিল গূঢ় রহস্যপূর্ণ। এ জন্য স্থানীয় জনগণ তার নাম দেন হাল্লাজুল আসরার। হাল্লাজ আরবী শব্দ যার অর্থ হল ধুনকার, ধানুকী, যে তুলা ধুনে। শােনা যায়, একবার তুলার স্তুপের দিকে ইশারা করামাত্র সেগুলি খুব সুন্দরভাবে ধুনা হয়ে যায়। আর তখন থেকেই তিনি হাল্লাজ নামে অভিহিত হন।

পাঁচ বছর আত্মগােপনের পর তিনি বসরায় ফিরে আসেন। আর আবারও সুফী পােশাক পরিধান করেন। সেখানে কিছুদিন থাকার পর তিনি যান মক্কায় । কিন্তু সেখানে উপস্থিত হওয়া মাত্রই হযরত ইয়াকুব নাহারজুরী রহমাতুল্লাহ তাকে জাদুকর বলে আখ্যা দেন। বাধ্য হয়ে তিনি আবার ফিরে এলেন বসরায়। ওখানে এক বছর কাটিয়ে আহওয়াজ হয়ে তিনি চলে আসেন হিন্দুস্থানে। হিন্দুস্থান থেকে খােরাসান, মাওরাউন্নহর প্রভৃতি দেশ ঘুরে ঘুরে চলে যান চীনে। তারপর আবার মক্কা শরীফে। এবার সেখানে দু’বছর কাটান। তারপর মক্কা থেকে বিদায় নেবার সময় তার মধ্যে দারুণ পরিবর্তন আসে। তখন তাঁর কথাবার্তা সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে। কাজেই এরপর তিনি যখনই যে দেশে গেছেন তখনই মানুষের কাছে লাঞ্ছিত ও বিতাড়িত হয়েছেন। এক এক সময় তিনি এত বেশী দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণা ও উৎপীড়ন সহ্য করেন যে, আর কোন সাধক-দরবেশকে তা কখনও সহ্য করতে হয়নি। শােনা যায়, তার পূঢ় রহস্যপূর্ণ, দুর্বোধ্য কথা ও আচরণের কারণে তিনি অন্তত পঞ্চাশটি দেশ থেকে বিতাড়িত হন। অথচ ইনিই যখন আগের দফায় বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করেন, তখন তার জ্ঞান মুগ্ধ মানুষ তাকে নানা সম্মানে ও উপাধিতে ভূষিত করেছেন। ভারতবাসী তাকে বলতেন আবুল মুগীস, চীনারা বলতেন, আবুল মুঈন, খােরাসানীরা বলতেন, আবুল মনীর, পারস্যবাসীরা বলতেন, আবু আবদুল্লাহ যাহিদ, খুজিস্তানবাসীরা বলতেন, হাল্লাজুল আসরার, বাগদাদ ও বসরার মানুষ তাঁকে মুগবের নামে সম্মানিত করেন।

শােনা যায়, তিনি দিনে-রাতে চারশ রাকয়াত নফল নামায পড়তেন। কিন্তু নিজের জন্য ঐ নফলকে তিনি ফরজ করে নেন। সবাই বলতেন, তিনি যে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী তাতে এত কষ্ট করার কি দরকার? তিনি তার উত্তরে বলতেন, কষ্ট-ক্লেশ আল্লাহ-প্রেমীদের মনে ঠাই পায় না। কেননা, প্রকৃতপক্ষে তারা মৃত মানুষের মতাে হয়ে যান।

দীর্ঘ বিশ বছর ধরে তিনি একই পােশাকে উপাসনা করতেন। একবার লােকে জোর করে তা খুলে নেয়। তখন দেখা যায়, তার ভেতরে জমে আছে অসংখ্য উকুন । তার কোন কোনটির ওজন নাকি ছিল প্রায় তিন রতি। একজন একটি বিছে দেখতে পেয়ে মারতে যায়। তিনি নিষেধ করেন। বলেন, ওটি তার সঙ্গে রয়েছে প্রায় বারাে বছর।

তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা সম্বন্ধে বর্ণনা দিয়েছেন হযরত রুশী খেরাদ সমরকন্দী। একবার হযরত মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ-এর চারশ সঙ্গী নিয়ে এক বিশাল প্রান্তর অতিক্রম করছিলেন। সঙ্গীরা ক্ষুধায় কাতর হয়ে তাঁকে বললেন, এখন যদি ভুনা মাথা (ছাগলের) ও রুটি খেতে পেতাম তাতে বড় তৃপ্তি হত। তিনি তাদের সারিবদ্ধ অবস্থায় বসিয়ে দিয়ে নিজের পেছনে হাত নিয়ে গিয়ে একটি মাথা ও রুটি এনে একজনকে দিলেন। আর এই ভঙ্গিতে চারশ জনকেই মাথা ও রুটি খাওয়ালেন। কিছুক্ষণ পরে সঙ্গীরা খেজুর খেতে চাইলে তিনি দাড়িয়ে সঙ্গীদের বললেন, তােমরা আমাকে ধরে নাড়া দাও। তারা নাড়া দিতেই প্রচুর পাকা খেজুর পড়তে লাগল। তারা বেশ মজা করে খেজুর খেলেন।

একবার তিনি চলেছেন এক বন্য পথে। সঙ্গে অনেক সঙ্গী। তারা আঙুর খেতে চাইলেন। তিনি তার ডান হাতখানা যেমনি ওপরে ওঠালেন অমনি হাত ভর্তি আঙুর এল। আর এভাবে বেশ কয়েকবার শুন্যে হাত তুলে তিনি পেট ভরে তাদের আঙুর খাওয়ালেন। কিছুক্ষণ পরে তাঁদের হালুয়া খাবার ইচ্ছা হলাে। আর অলৌকিক শক্তি বলে তিনি তাদের সে ইচ্ছাও পূরণ করলেন। একজন বলল, হালুয়ার স্বাদ হুবহু বাগদাদের হালুয়ার মতাে। তিনি বললেন, আল্লাহর রহমতে আমার জন্য বাগদাদের বাজার আর বন-জঙ্গল দুইই সমান। | ঐদিন বাগদাদের বাবে এনতাকিয়া বাজারের এক হালুয়ার দোকান থেকে হালুয়া ভর্তি একটি কড়াই হঠাৎ উধাও হয়। তিনি যখন সদলবলে বাগদাদে পৌছলেন, তখন এক মুরীদের কাছে কড়াইটি দেখতে পেয়ে দোকানদার তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এটি আপনি কোথায় পেলেন? মুরীদ ঘটনাটি বললেন। আর হলুয়া বিক্রেতা অবাক হয়ে হযরত মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ-এর কাছে দীক্ষা নিলেন।

একবার হজ্জ যাত্রায় তাঁর সঙ্গে ছিলেন চার হাজার হজ্জযাত্রী। তাঁদের নিয়ে তিনি মক্কায় পেীছে কাবা ঘরের সামনে ঐ যে দাঁড়ালেন, পুরাে একবছর আর নড়লেন না। এভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। সূর্যের তাপে তার দেহ গলে গিয়ে চর্বি বেরােতে লাগল। গায়ের চামড়া গেল ফেটে। কিন্তু তিনি এক চুলও নড়লেন না। এ অবস্থায় এক লােক প্রতিদিন তাকে একটি রুটি এক কুঁজো পানি দিয়ে আসত। তার থেকে মাত্র ঢোক পানি আর এক টুকরাে রুটি খেয়ে বাকী সব রেখে দিতেন। | হযরত মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ আরাফাতের মাঠে গিয়ে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেন, প্রভু গাে আপনি পথ ভ্রষ্ট মানুষের পথপ্রদর্শক। আমি যদি সত্যিই কাফের হয়ে থাকি, তবে আমার কুফরীই বাড়িয়ে দিন। যখন লােকজন তার চারপাশ থেকে চলে যেত, তখন তিনি আবার দোয়া করতেন, প্রভু! আমি আপনার একত্ব স্বীকার ও বিশ্বাস করেই আপনি ছাড়া আর কারও এবাদত করি না। আর আপনার দেয়া দানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে অক্ষম বলে তা প্রকাশ করতে পারি না। অতএব, আমার অনুরোধ, আমার বদলে আপনিই আপনার নেয়ামতসমূহের শােকর আদায় করুন। কেননা, আপনার প্রদত্ত নেয়ামতসমূহের সম্পূর্ণ শােকর আদায় আপনার কোন বান্দার দ্বারা সম্ভব নয়। সেটি কেবল আপনার দ্বারাই হতে পারে। | হযরত মানসুর রহমাতুল্লাহ হযরত মূসা (আঃ)-এর একটি ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, হযরত মূসা (আঃ) একবার ইবলীসকে জিজ্ঞেস করেন, সে হযরত আদম (আঃ)-কে সেজদা করেনি কেন? ইবলীস বলল, সে আল্লাহর প্রত্যক্ষদর্শী ও সেজদাকারী ছিল। সুতরাং আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে সেজদা করার তার কাছে সঙ্গত নয় বলে মনে হয়েছিল। আল্লাহর দীদারের মূল্য ও গুরুত্ব কী অপরিসীম, হযরত মূসা (আঃ) তা জানেন। আল্লাহর দীদার লাভের প্রতি তার তীব্র বাসনার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ হযরত মূসা (আঃ)-কে বললেন, পাহাড়টার দিকে তাকান। আর আপনিও প্রবল বাসনা নিয়ে পাহাড়টির দিকে দৃষ্টি দেন।

ধৈর্যের সংজ্ঞা কি? এ প্রশ্নের উত্তরে হযরত মনসুর রহমাতুল্লাহ বলেন, হাত-পা কেটে ফেললেও, শূলে চড়ালেও দুঃখ না করা এবং বিচলিত না হওয়ার নাম ধৈর্য। হযরত ফরীদ উদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ বলেন, আশ্চর্য লাগে, হযরত মানসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ-এর প্রতি শূলার যে ঘটনা ঘটল, তাতে এতটুকু দুঃখ বা আক্ষেপ প্রকাশ করলেন না। | হযরত শিবলী রহমাতুল্লাহ গেছেন হযরত হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ-কে হত্যা করতে। হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ বললেন, আমি এমন এক গুরুতর কাজ করার ইচ্ছা করেছি যার কারণে আমি পাগল প্রায় । আর আমি নিজেই তাে মৃত্যুকে আহবান করেছি। অতএব, আপনি আমাকে হত্যা করবেন না।

আগেই বলা হয়েছে, তার ‘আনাল হক’ মানুষের রােষ বৃদ্ধি করে। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, আপনার আল্লাহত্ত্বের দাবী কি কুফরী নয়? তিনি বললেন, আল্লাহর প্রকৃত পরিচয় হল, সবকিছুই তার । আর আপনাদেরই কথায়, তিনি কখনও বিলুপ্ত হন না। তবে কি হুসাইন মানসুর বিলীন হয়ে গেছে।

হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহমাতুল্লাহ-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, হযরত মনসুর রহমাতুল্লাহ-এর কথার অন্য অর্থ করা যায় কিনা। তিনি বললেন, আর সে চেষ্টা করাে না। কেননা, সময় পার হয়ে গেছে। এখন আলেম সমাজ ও খােদ খলীফা তার প্রতি বিরূপ হয়েছেন। তিনিও একবছর ধরে বন্দী। তাঁর অনুসারীরা তার কাছে যাতায়াত করতেন। তিনি তাদের কথার সন্তোষজনক জবাবও দিতেন। কিন্তু এখন লােকজনের যাতায়াত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কয়েকজন বিদগ্ধ পণ্ডিত তার কাছে দু’জন লােককে এ কথা বলে পাঠান যে আনাল হক উচ্চারণ করে তিনি যে অপরাধ করেছেন তার জন্য তওবা করলে তাঁকে মুক্তি দেয়া হবে। তিনি জবাব দিয়েছিলেন, তিনি তা পারবেন না। হযরত আতা রহমাতুল্লাহও তাঁর কাছে গিয়েছিলেন। তার প্রস্তাবও ছিল ঐরকম। কিন্তু তাকেও তিনি একই জবাব দিয়েছেন।

কথিত আছে, প্রথম রাতে তাঁকে বন্দী করা হলে তিনি অদৃশ্য হয়ে যান। দ্বিতীয় রাতে দেখা যায় তিনিও নেই, জেলখানাও নেই। তৃতীয় রাত্রে অবশ্য তাকে এবং জেলখানাকেও দেখা যায়। এ ঘটনার মর্ম জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, প্রথম রাতে আমি আল্লাহর দরবারে চলে গিয়েছিলাম । দ্বিতীয় রাতে খােদ আল্লাহ এখানে উপস্থিত ছিলেন । তৃতীয় রাত্রে জেলখানা ও আমি আবার হাজির হলাম। কেননা, শরীয়তের বিধান রক্ষার জন্য আল্লাহ আবার আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখন তােমরা তােমাদের কর্তব্য পালন কর।

কথিত আছে, তিনি কারাগারে দৈনিক এক হাজার রাকাআত নফল নামায পড়তেন। তাকে প্রশ্ন করা হয়, আপনি যখন নিজেকে আল্লাহ্ বলে ঘোষণা করছেন, তখন এ নামায কার উদ্দেশ্যে? তিনি উত্তর দেন, আমার সম্বন্ধে আমিই ভালাে জানি।।

শােনা যায়, কারাগারে তখন তিনশ কয়েদী ছিল। তিনি তাদের মুক্তি দিতে পারেন বলে ঘােষনা করেন। কিভাবে তা সম্ভব বলে তাঁকে প্রশ্ন করা হল। কেননা তিনি নিজেও একজন বন্দী। পারলে আগে তিনি নিজেকেই মুক্ত করুন না? হযরত মনসুর রহমাতুল্লাহ বলেন, আমি যে আল্লাহর বন্দী। আর শরীয়তেরও অনুসরণ করি। না হলে ইচ্ছা করলে চোখের ইশরায় সব শৃঙ্খল ছিন্ন করতে পারি। এই বলে আঙুলের ইশরায় সত্যিই সব কয়েদীর শেকল ছিড়ে ফেললেন। কয়েদীরা বলল, আমরা এখন বেরােব কেমন করে? জেলের দরজা যে বন্ধ। তিনি তখন ইশরা করতেই দেয়ালে কয়েকটি জানালা তৈরী হয়ে গেল। কয়েদীদের বললেন, যাও, চলে যাও।

তারা বলল: আপনি আসবেন না?

তিনি বললেন, প্রভুর সঙ্গে আমার একটা গােপন ব্যাপার আছে। তার মীমাংসা হবে শূলে চড়ে। পরদিন প্রহরীরা দেখল, জেল শূন্য। একটিও কয়েদী নেই। তারা জিজ্ঞেস করল, কয়েদীরা কোথায়? তিনি বললেন, আমি সবাইকে ছেড়ে দিয়েছি।

তবে আপনি থেকে গেলেন কেন? তিনি বললেন। আমার ওপর মালিকের খেদ রয়েছে। সে জন্য অপেক্ষা করছি।

খলীফার কাছে এ সংবাদ পৌছালে তিনি হুকুম দিলেন, চাবুক মেরে তাকে কতল করা হােক। তা না হলে আরও বিপত্তি ঘটতে পারে। নির্দেশমত তাকে কারাগার থেকে বের করে এনে তিনশ ঘা চাবুক বসানাে হল। কিন্তু তাতেও তার আনাল হক উচ্চারণ বন্ধ হল না। বরং আরও জোরে তিনি তা করতে লাগলেন। যে লােকটি আঘাত করছিল, সে বলল, প্রতিটি আঘাতে শােনা গেছে, মানসুর ভয় পেও না।

এত আঘাত সত্ত্বেও তিনি নির্বিকার, অবিচল। তারপর তাঁকে শূলে চড়াবার জন্য নিয়ে যাওয়া হল। এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখার জন্য প্রায় লক্ষাধিক লােকের সমাবেশ ঘটে। সেই বিশাল জনতার দিকে তাকিয়ে তিনি বলে উঠলেন, হক, হক, আনাল হক। এমন সময় এক দরবেশ তাঁর সামনে এসে বললেন, প্রেম কি বস্তু? তিনি বললেন, আজ নিজের চোখেই তা দেখতে পাবেন। কাল এবং পরশুও দেখতে পাবেন। অর্থাৎ, প্রথম দিন তাঁকে হত্যা করা হবে। দ্বিতীয় দিন তার মরদেহ পুড়িয়ে ছাই করা হবে। তৃতীয় দিন সে ছাই বাতাসে উড়িয়ে দেয়া হবে। এগুলিই হল প্রেমের নিদর্শন।

তাঁকে যখন শূলে চড়ানাে হয়, তখন তাঁর সেবক এসে তাঁর শেষ উপদেশ প্রার্থনা করেন। তিনি বললেন, নিজেকে যেকোন সৎ কাজে নিয়ােজিত রেখাে। না হলে রিপু তােমাকে মন্দ কাজে লাগিয়ে দেবে। তার ছেলে এসে কিছু শুনতে চাইলেন। তিনি বললেন, দুনিয়ার সবাই পুণ্য কর্মের চেষ্টায় আছে। তুমি এমন একটি কাজের চেষ্টা কর, যার একটি কণা সারা বিশ্বের মানুষ ও জ্বিনের আমল হতেও উত্তম হয়। সেটি হল হাকীকতের একটি অণু। অতঃপর তিনি সানন্দে শূলকাঠের দিকে এগিয়ে গেলেন। আপনার এত খুশী কিসের? কেউ তাঁকে শুধাল। তিনি বললেন, কারণ, আমি আমার ডেরায় যাচ্ছি। এর চেয়ে বেশী আনন্দের সময় আর কখন হবে? এবার তিনি বিড়বিড় করে আবৃত্তি করতে লাগলেনঃ আমার বন্ধু আমার প্রতি মােটেই অবিচার করেননি। অতিথিকে যেমন পবিত্র ও উত্তম শরাব পান করানাে হয়, আমার প্রভুও আমাকে তেমনি পান করিয়েছেন। শরাবের পাত্র কয়েকবার পান করার পর কাপ ও তরবারি-সহ এগিয়ে যাবার জন্য বন্ধু আমাকে সাদরে আহ্বান জানালেন। আর এই হল ঐ ব্যক্তির উপযুক্ত আযাব যে গ্রীষ্মকালে অজগরের সঙ্গে বসে পুরাতন শরাব পান করে। তাকে নিয়ে যাওয়া হল শুলের তলায়। তিনি শুল চুম্বন করলেন। তারপর শূলের সিড়িতে পা রেখে বললেন, বীর পুরুষের মেরাজ হল শুলদণ্ড। এবার তিনি কিবলামুখী হয়ে আল্লাহর দরবারে মােনাজাত করলেন, প্রভু গাে! যা চেয়েছিলাম তাই পেলাম । যখন তাকে শূলে চড়ানাে হল, তখন তাঁর শিষ্যগণ বললেন, হুজুর! যারা আপনার ওপর নিষ্ঠুর ব্যবহার করল, আর আমরা যারা আপনার সমর্থক, তাদের প্রতি আপনার ধারণা কি? তিনি বললেন, যারা আমার প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার দেখাল, তারা দ্বিগুণ পুণ্য অর্জন করবে। আর যারা আমাকে সমর্থন করেছে ও আমার প্রতি পবিত্র ধারণা পােষণ করেছে, তারা পাবে মাত্র একটি সওয়াব। কেননা, তােমরা আমার প্রতি কেবল ভালাে ধারণাই পােষণ করেছ। আর তারা একত্ববাদের শক্তি ও শরীয়তের কঠিন বিধান-এ দুইয়ের তাড়নায় তাড়িত। মনে রেখাে, ইসলামে তওহীদই আসল। আর ভালো ধারণা তার শাখা মাত্র।

তিনি নাকি যৌবনে এক তরুণীর প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। সে কথা তার মনে এল। আর বললেন, এতদিন পর আজ তার প্রতিশােধ নেয়া হল। এবার হযরত শিবলী রহমাতুল্লাহ এসে তাঁকে তাসাওউফ বা সাধনা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, আপনি যা দেখেছেন তা তাসাওউফের নিম্ন শ্রেণী। তাহলে উচ্চ কোন্‌টি? শিবলী রহমাতুল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, সেটি আপনার জ্ঞানের বাইরে। এবার তার ওপর পাথর ছোঁড়া শুরু হল। এমন কি হযরত শিবলী রহমাতুল্লাহ ও একটি ঢিল নিক্ষেপ করলেন। আর হযরত হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ আর্তনাদ করে উঠলেন। লােকে তাকে বললেন, এত পাথর ছোঁড়া হচ্ছে, অথচ আপনি নির্বিকার। কিন্তু শিবলী রহমাতুল্লাহ-এর সামান্য ঢিলের আঘাতে আপনি অমন চিৎকার করলেন কেন? তিনি বললেন, যারা পাথর নিক্ষেপ করছে তারা রয়েছে অজ্ঞানতার আঁধারে । কিন্তু হযরত শিবলী রহমাতুল্লাহ-এর মতাে জানাশােনা লােক আমার ওপর ঢিল ছুঁড়ছেন, এ দুঃখ কি সহ্য করা যায়?

শূলে চড়িয়ে প্রথমে তার হাত কেটে দেয়া হয়। তিনি মন্তব্য করলেন, এ লেকটির এই হাত কাটা সহজ বটে, কিন্তু যে অদৃশ্য হাত দিয়ে সে আরশের ওপর থেকে গৌরবের মুকুট টেনে আনছে, তা কে কাটতে পারে? তারপর তাঁর পা কাটা হল । তখনও তার সহাস্য মন্তব্য; এই পায়ের সাহায্যে পৃথিবীতে চলাফেরা করেছি। আর এখন এই পা কেটে ফেলা হল। কিন্তু আমার যে অদৃশ্য পা আছে, জান্নাতে আমি তার সাহায্যেই বিচরণ করব। তােমাদের ক্ষমতা থাকলে সে পা কেটে নাও দেখি! বলে দু’হাতের রক্ত নিয়ে তিনি মুখে মাখতে লাগলেন। এ আপনি কি করছেন? তাকে সবাই বলে। তিনি বললেন, আমার শরীরের রক্ত ঝরছে প্রচুর। তাই মুখখানি সাদা হয়ে গেছে। তােমাদের মনে হতে পারে, বুঝি বা ভয়েই মুখখানি সাদা হয়ে গেছে। তাই মুখে রক্ত মেখে লাল করে নিলাম। | তারপর তিনি হাতে রক্ত মাখতে লাগলেন। বললেন, ওজু বানাচ্ছি। লােকে বলে কি রকম? তিনি বললেন, দু’রাকায়াত এশকের নামায আছে, যা রক্ত দ্বারা ওজু করে আদায় করতে হয়। | এরপর তাঁর চোখ উপড়ে ফেলা হল। আর এ দৃশ্য দেখতে না পেরে জনগণ কান্নায় ভেঙে পড়ল। অবশ্য কেউ কেউ তখনও তার দিকে পাথর ছুঁড়ছিল। এবার তার জিভ কাটতে উদ্যত হলে তিনি একটু থামতে বললেন। তারপর শূন্যে দৃষ্টি ছড়িয়ে বললেন, প্রভু! এরা যে আমাকে এত কষ্ট দিল এজন্য এদের আপনার অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত করবেন না। যদিও তারা আমার হাত পা কেটেছে, তবুও তারা সবাই রয়েছে আপনার পথে। তারা যদি আমার মাথাও কেটে নেয়, তবুও তাদের উদ্দেশ্য শুধু আপনারই দীদার লাভ করা।

এবার তার নাক ও কান কেটে দেয়া হল। তার ওপর প্রস্তর নিক্ষেপ তখনও বন্ধ হয়নি। তার শেষ কথা হলঃ আমি একত্ববাদের প্রেমিক। একত্বের প্রতি প্রেম হল, এককে একই জানা আর অন্য কাউকে সেখানে স্থান না দেয়া। তারপর তিনি এই আয়াতটি পাঠ করলেন; “যারা ঈমান আনে না এবং কিয়ামতকে অবিশ্বাস করে তা থেকে পালিয়ে যায়, অথচ তারা অন্তরে জানে যে, এ অবধারিত সত্য, তারাই সহাস্যে রাসূলে করীম রহমাতুল্লাহ-কে তাড়াতাড়ি কিয়ামত এনে দেখাতে বলে। আর যারা ঈমান আনে (সেই ভয়ঙ্কর দিনে নাম শুনে) ভয়ে ভীত হয় ও কুকর্ম থেকে বিরত থাকে, তারাই কিয়ামতকে সত্য বলে জানে ও মনে প্রাণে বিস্বাস করে।”

এটুকু বলার পরই তার জিভ কেটে নেয়া হল । তখন দিনের আলাে ফুরিয়ে এল । এল সন্ধ্যা। এবার খলীফার নির্দেশ দেহ থেকে তার মাথা বিচ্ছিন্ন করা হােক। এ আদেশ পালনে ঘাতকেরা প্রস্তুত। হঠাৎ মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ স-শব্দে হেসে উঠলেন কিন্তু জনতার মধ্যে জেগে উঠল কান্নার রােল। আর সেই হাসি কান্নার মধ্যেই তার শিরচ্ছেদ করা হল । আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রতিটি অঙ্গ উচ্চারণ করতে শুরু করল আনাল হক, আনাল হক। তখন সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে টুকরাে টুকরাে করা হল। বাকী রইল শুধু গলা আর পিঠ। কিন্তু তাঁর খণ্ডিত অঙ্গ থেকেও নিনাদিত হল আনাল হক আনাল হক। শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দু মাটিতে পড়ে আনাল হক বলতে শুরু করল। আর এমনিভাবে রাত কেটে গেল। দ্বিতীয় দিন সবাই স-বিস্ময়ে দেখল, আগে শুধু এক মুখে আনাল হক উচ্চারিত হচ্ছিল। এখন তা শতমুখে উচ্চারিত হচ্ছে। খলীফার লােকজন এবাৱ হতবুদ্ধি হয়ে গেল। তারা তার খণ্ডিত দেহাংশগুলি আগুনে পুড়ে ছাই করে ফেলল। কিন্তু তাতে বিপদ বেড়ে গেল সহস্র গুণ । প্রতিটি ভস্মকণা থেকে শব্দ উঠতে থাকল আনাল হক, আনাল হক।

বেগতিক বুঝে খলীফা নির্দেশ দিলেন, তার দেহ-ভস্ম দজলা নদীতে ফেলে দেয়া হােক। কিংকর্তব্যবিমূঢ় প্রশাসন কর্মীরা তাই করল। কিন্তু তার ফল হল আরও মারাত্মক। হঠাৎ দজলা নদী ফুঁসে উঠল বিপুল জলােচ্ছাসে । আর উৎক্ষিপ্ত তরঙ্গ আনাল হক আনাল হক বলতে বলতে প্রচণ্ড বেগে আছড়ে পড়ল নদী-তটে। জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হল। হয়ত ক্রুদ্ধ নদী বাগদাদ মহানগরী গ্রাস করে ফেলবে। সবাই তখন দিশেহারা।

হযরত মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ ঐ ক্ষমতাবলে ভবিষ্যতের কথা জেনে নিয়েছিলেন। তাই তিনি তাঁর এক শিষ্যকে বলে যান, তার দেহ ভস্ম দজলা বক্ষে নিপতিত হলে তা ভীষণ আকার ধারণ করবে। তখন তিনি যেন তার খিরকাটি নদীকে দেখিয়ে দেন। তা হলে সে শান্ত হয়ে যাবে। হঠাৎ কথাটি মনে পড়ল ঐ শিষ্যের। তিনি তাড়াতাড়ি তার খিরকাটি নিয়ে নদীর সামনে ধরলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে নদী শান্ত হয়ে গেল। নিক্ষিপ্ত ভস্ম এসে জমা হল নদী-তীরে। আর তা তুলে নিয়ে লােকেরা কবর খুঁড়ে তাতে দাফন করল । ভয়ংকর এক বিপর্যয় থেকে দেশ ও জাতি রক্ষা পেল। অন্য কোন তাপসের মৃত্যুর পর মানুষ এমন বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করেনি। একজন বিখ্যাত জ্ঞানী বলেন, যখনই হষরত মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ-এর প্রতি অমানবিক আচরণের মর্মান্তিক দৃশ্যটি মানস পটে ভেসে ওঠে, তখন আপনা থেকে আমার মনে একটি প্রশ্নের উদয় হয় যে, তার সাথে এরূপ ব্যবহার করা হল কেন? আর এ প্রশ্নও মনের মধ্যে নিয়ত ঘুরপাক খায়, যারা তাঁর প্রতি এ ধরনের নিষ্ঠুর আচরণ করল, রােজ কিয়ামতে তাদের অবস্থা কী দাঁড়াবে? হযরত আব্বাস তুসী রহমাতুল্লাহ বলেন, রােজ কিয়ামতে হাশরের মাঠে তাঁকে বেঁধে রাখা হবে, না হলে তার দ্বারা এক তুমুল কান্ড সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

কোন এক দরবেশ বলেন, যে রাতে হযরত মনসুর রহমাতুল্লাহ-কে শূলে দেয়া হয়, সে রাতে ভাের পর্যন্ত তিনি শূল কাঠের নিচে মােরাকাবায় কাটিয়ে দেন। ভােরের দিকে তিনি এক অদৃশ্য বাণী শুনতে পান। তাতে বলা হয়, আমি আমার গােপন রহস্যাবলীর একমাত্র রহস্য মানসুরের কাছে উন্মোচন করেছিলাম যা সে জনসমক্ষে প্রকাশ করে দিল। যার ফলে তাকে এরূপ কঠোর পরিণতির শিকার হতে হল। কোন শাহী রহস্য ফাঁস করে দিলে তার পরিণতি এরূপই হয়ে থাকে।

হযরত শিবলী রহমাতুল্লাহ বলেন, তার দেহ ভস্ম দাফন করার পর তিনি সেখানেই সারা রাত উপাসনায় কাটিয়ে দেন। ভােরবেলায় আল্লাহর দরবারে মােনাজাত করেন। হে প্রভু, মানসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ একজন মুমিন বান্দা ছিলেন। তিনি তত্ত্বজ্ঞানী, প্রেমিক, তওহীদবাদী। তা সত্ত্বেও আপনি তাঁকে এমন কঠিন অবস্থায় ফেলে দিলেন? তাঁর প্রার্থনা তখনও শেষ হয়নি। হঠাৎ তার ঘুম নামে দু’চোখে আর তিনি স্বপ্ন দেখেন, রােজ কিয়ামত উপস্থিত। আল্লাহ পাক ঘােষণা করছেন, আমি তার সঙ্গে এরূপ ব্যবহার এজন্য করেছি যে, সে আমার গােপন রহস্য মানুষের কাছে ফাস করে দিত। যে গােপন রহস্য দজলা নদীর ওপর প্রকাশ করা উচিত ছিল সে তা মানুষের কাছে প্রকাশ করে দিয়েছিল। হযরত শিবলী রহমাতুল্লাহ দ্বিতীয় রাতে পুনরায় তাঁকে স্বপ্নযােগে দেখেন। আর তার অবস্থা জানতে চান। তিনি উত্তর দেন, আল্লাহ তাকে অনুপম জান্নাতে জায়গা দিয়েছেন। তিনি আরও জানতে চান, তাঁর সমর্থক ও বিরােধী এই দু’দলের সঙ্গে আল্লাহ কিরূপ ব্যবহার করবেন। তিনি বললেন, দু’দলের ওপরই আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষিত হবে। একদল আমাকে বিশেষভাবে জানত ও আমার সম্বন্ধে ভালাে ধারণা করত। অন্য দল জানত না, কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যই আমার বিরােধিতা করত । তাই উভয় দলই আল্লাহর প্রিয় ও করুণার পাত্র বলে বিবেচিত।

কোন এক দরবেশ স্বপ্ন দেখেন, হাশরের মাঠে হযরত মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ শরাবের পেয়ালা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু তার দেহের সঙ্গে মাথা যুক্ত নয়। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, পৃথিবীতে যাদের শিরচ্ছেদ হয়েছে, তারাই হাশরের মাঠে শরাবের পেয়ালার অধিকারী হবে।

হযরত শিবলী রহমাতুল্লাহ বলেন, হযরত মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ-কে যখন শূলে তােলা হয়, তখন ইবলীস তাঁর সামনে এসে বলে, আপনি যা বলেছেন আমিও তাই বলেছিলাম। আপনি আনাল হক বলছেন, আমি বলতাম আনা খাইরুন (আমি সর্বোত্তম)। তবে কেন আপনার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ আর আমার প্রতি অভিশাপ অবতীর্ণ হল? হযরত মনসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ জবাব দেন, তুমি তা বলেছিলে অহমিকা-প্রসূত হয়ে স্বেচ্চায়। আর আমি আনাল হক বলেছিলাম আমার আমিত্ব সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে আল্লাহরই ইচ্ছায় । এই হল অনুগ্রহ ও অভিশাপের কারণ। জেনে রেখাে, অহঙ্কার আল্লাহর দরবারে অত্যন্ত দৃণিত, নিকৃষ্ট। পক্ষান্তরে আমিত্ব বিসর্জন দেয়া হল আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয় ও পছন্দনীয় কাজ। | হযরত মূসা (আঃ) সম্পর্কে তাঁর অভিমত জানতে চাওয়া হলে হযরত মানসুর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহ বলেন, তিনি ছিলেন সর্বাবস্থায় সত্য ও ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ফেরাউন সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যঃ সে-ও খাঁটি ছিল। কেননা, আল্লাহ ‘খাস’ ও ‘আম” (বিশেষ ও সাধারণ) দুই শ্রেণীর মানুষ সৃষ্টি করেছেন। উভয় শ্রেণীই নিজ নিজ পথে চলে। আর উভয় শ্রেণীর পথ-প্রদর্শক হলেন আল্লাহ। তিনি বলেনঃ

১, আল্লাহর স্মরণে লিপ্ত হয়ে যারা ইহলােক-পরলােক সবকিছু ভুলে যায়, তারাই আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে।

২. সুফী ব্যক্তি বড় একা এই কারণে যে, আল্লাহ ছাড়া তিনি কোন কিছুর খবর রাখেননা । অন্যরাও তার সম্বন্ধে কোন কিছু জানতে পারে না।

৩. ঈমানের আলােয় আল্লাহর অনুসন্ধান কর।

৪. হেকমত তীর সদৃশ। আল্লাহ তীরন্দাজ। আর তার নিশানা সৃষ্টিজগত।

৫. মুমিন তিনিই যিনি ধন-সম্পদকে দুষণীয় মনে করে স্বপ্নের রাজ্যে সন্তোষ অবলম্বন করেন।

৬. বিপর্যয়ে ধৈর্যধারণ করা ও আল্লাহকে ভালােভাবে জেনে নেয়াই হল সর্বোৎকৃষ্ট চরিত্র।

৭. আমলকে অসততা থেকে পবিত্র রাখাই হল আখলাক।

৮. সাধারণ মানুষের জ্ঞান, তত্ত্বজ্ঞানীর আধ্যাত্ম-চিন্তা, বিদ্বানগণের জ্যোতি এবং পূর্ববর্তী মুক্তিপ্রাপ্তদের পথই হল প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একই আল্লাহর পথে সম্পৃক্ত ও জড়িত।

৯. বাদশাহ যেমন ভােগবিলাস, রাজ্য দখল প্রভৃতি কাজে ব্যস্ত, অনুরূপভাবে আমরাও সদা-সর্বদা বিপদ-আপদ আসায় ব্যস্ত থাকি।

১০. উপাসনার মঞ্জিল পার হবার পর মানুষ স্বাধীনতা লাভ করে।

১১. বেশী লম্বা হাত কী দোয়ার না এবাদতের? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কোন হাতই লক্ষ্যস্থলে পৌছাতে পারে না। কেননা, প্রার্থনার হাত পৌছাতে পারে স্বীকৃতির সীমা পর্যন্ত। আর এবাদতের হাত পৌছায় শরীয়তের দামান পর্যন্ত। খাটি দাসগণের কাছে এরা কোনটিই পছন্দনীয় নয়।

১২. আল্লাহর হাকীকত যার জন্য খুলে যায়, সামান্য কাজের মাধ্যমেই তা হয়ে যায়। পক্ষান্তরে যার প্রতি তা উন্মুক্ত হবার নয়, বহু সৎ কাজের বিনিময়েও তা কখনই হয় না।

১৩. যতক্ষণ পর্যন্ত বিপদ-আপদে ধৈর্য ধারণ করা না যাবে, আল্লাহর এনায়েত সে পর্যন্ত হাসিল করা সম্ভব হবে না।

সূত্রঃ-তাযকেরাতুল আউলিয়া

মনসুর হাল্লাজ এর জীবনী পড়তে এখানে ক্লিক করুন।