Select Page
মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী-বানী-কবিতা।

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী-বানী-কবিতা।

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী-বানী-কবিতা।

নাম ও পিতৃ পরিচয়ঃ 

নাম ও পিতৃ পরিচয়ঃ নাম মুহাম্মদ, উপাধি জালালুদ্দীন, মওলানা রূম বা রূমী ছিল জনপ্রিয় উপাধি। পিতার দিক দিয়ে তার বংশ নবম ঊর্ধ্বতন পুরুষে গিয়ে হযরত আবুবকর সিদ্দীক (রাঃ)এর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। তিনি মায়ের দিক দিয়ে হযরত আলী (রা)-র বংশের সাথে সম্পর্কিত ছিলেন।

মওলানা রূমী (রহঃ)-র পিতা খুরাসানের অন্তর্গত বলখের অধিবাসী ছিলেন। সেখানেই মওলানার জন্ম হয়। মওলানার পিতৃ ও মাতৃকুলে বড় বড় উলামায়ে কিরাম ও শাসকের জন্ম হয়। মওলানার পিতামহ মালেকা-ই-জাহান ছিলেন খাওয়ারিম শাহী বংশােদ্ভূতা। মওলানার পিতার নামও ছিল মুহাম্মদ; উপাধি ছিল বাহাউদ্দীন ওয়ালাদ। তাঁর জন্ম সম্ভবত ৫৪৩ হিজরীতে। হযরত বাহাউদ্দীন ওয়ালাদ জীবনের নব প্রভাতেই সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শিতা অর্জন করেন। তার জ্ঞান ও মর্যাদার অবস্থা ছিল এই যে, খুরাসানের দূর-দূরান্তর এলাকা থেকে জটিল ও কঠিন ফতওয়াদি তাঁরই নিকট আসত। তার মজলিস ছিল শাহী মজলিসেরই অনুরূপ। তার উপাধিও ছিল সুলতানুল-উলামা। তিনি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সাধারণ দরূস প্রদান করতেন। জুহরের পর তিনি তার বিশিষ্ট সাথীদের মজলিসে হাকীকত ও মারিফত বর্ণনা করতেন। তিনি সােমবার ও জুমু’আর দিন সাধারণভাবে ওয়াজ করতেন। তাকে সব সময় ভীতিগ্রস্ত ও চিন্তাযুক্ত দেখা যেত।

মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী-বানী-কবিতা।

মওলানার জন্ম ও প্রাথমিক শিক্ষাঃ

বাহাউদ্দীন ওয়ালাদের পুত্র মওলানা জালালুদ্দীন রুমী ৬০৪ হিজরীর ৬ই রবিউল-আওয়াল তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। সুলতানুল-উলামা বাহাউদ্দীন ওয়ালাদের বিশিষ্ট মুরীদদের ভেতর একজন উন্নত স্তরের বুযুর্গ ছিলেন সায়্যিদ বুরহানুদ্দীন মুহাক্কিক তীরমিযী। সুলতানুল-উলামা তাঁকেই মওলানার গৃহশিক্ষক (651) নিযুক্ত করেন। ৪-৫ বছর বয়স পর্যন্ত মওলানা তারই প্রশিক্ষণাধীনে ছিলেন। মওলানা তার বুযুর্গ পিতার ইনতিকালের পর এই গৃহশিক্ষকের অভিভাবকত্বে আধ্যাত্মিক সাধনার স্তরগুলাে অতিক্রম করেন।

মাওলানা জালাল জালালুদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী-বানী-কবিতা।

বলখ থেকে জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর পিতার হিজরতঃ

 

মওলানার পিতা হযরত বাহাউদ্দীন ওয়ালাদের দাওয়াত ও নসীহত সীমাতিরিক্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং তার মুরীদদের সংখ্যাও অস্বাভাবিক হারে বৃদ্বি পায়। ফলে তিনি সমসাময়িক কতক আলিম-উলামা’র ঈর্ষার শিকারে পরিণত হন। হযরত সুলতানুল-উলামা তাঁর ওয়াজে গ্রীক দার্শনিকদের ধর্ম বিষয়ক ধ্যান-ধারণার নিন্দা করতেন। তিনি বলতেন, “কিছু লােক আসমানী গ্রন্থ চিতাতে নিক্ষেপ করেছে এবং দার্শনিকদের অপূর্ণ ও কার্যানুপযােগী বাণীকে জেদের অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত করেছে। এসব লােক কি করে নাজাতের আশা করতে পারে?” এরূপ খােলাখুলি নিন্দা জ্ঞাপনের ফলে বাহ্যিক দৃষ্টি সম্পর্ন কিছু সংখ্যক ‘আলিম তার সম্পর্কে চরম আকারের বিদ্বেষ পােষণ করতে থাকে। খাওয়ারিম শাহ মওলানা ওয়ালাদের খুবই ভক্ত ও অনুরক্ত ছিলেন বিধায় এরা তার নিকট মওলানার পিতা সম্পর্কে অভিযােগ উত্থাপনের সুযােগ পেত।

 

আকস্মিকভাবে একদিন সুলতান মওলানা ওয়ালাদের যিয়ারতে আসেন এবং সেখানে আগন্তকদের সাংঘাতিক ভীড় দেখতে পেয়ে তার সফরসঙ্গী একজন ‘আলিমকে বলেন ? দেখুন, মওলানার দরবারে লােকের কত ভীড়। ঐ আলিম এটাকে একটা মােক্ষম মুহুর্ত জ্ঞান করে বলে ওঠেন। বাদশাহ যদি এর একটা ব্যবস্থা না নেন তাহলে সাম্রাজ্যের ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেবার আশঙ্কা রয়েছে এবং ঐ অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। কথাটা বাদশাহর মনে ধরে। তিনি জিজ্ঞেস করে জানতে চান, এমতাবস্থায় তিনি কোন্ পথ অবলম্বন করবেন? উল্লিখিত ‘আলিম সংগে সংগে পরামর্শ দেন রাজকোষ ও দুর্গের চাবিগুলাে মওলানা বাহাউদ্দীন ওয়ালাদ-এর খিদমতে পাঠিয়ে বলুন, “লােক সমাগম ও প্রয়ােজনীয় প্রভাব-প্রতিপত্তি সব কিছুই তাে আপনার হাতে চলে গেছে। শাসন সংক্রান্ত বিষয়াবলীর মধ্যে আমার নিকট শুধু এই চাবিগুচ্ছই রয়েছে। অতএব, এগুলােও আপনার খিদমতে হাযির করা হল।

এ কথা শােনার পর মওলানা বলেন : সুলতানকে গিয়ে আমার সালাম বলবে। এবং এও বলবে, “ধ্বংসশীল এ পৃথিবীর সমস্ত ধনভাণ্ডার, গুপ্তধন, বিরাট দেশ ও তার বিশাল সেনাবাহিনী বাদশাহর পক্ষেই কেবল শােভা পায়। এ সবের সঙ্গে দরবেশের কি সম্পর্ক? আমি হৃষ্ট চিত্তে এখান থেকে চলে যাচ্ছি। বাদশাহ তাঁর লােকজন ও বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সুখের সঙ্গে রাজত্ব করুন। জুমু’আর দিন নির্ধারিত ওয়া’জ শেষে আমি চলে যাব।”

 

বলখের অধিবাসীদের কানে এ খবর গিয়ে পৌছুতেই সারা শহরে বিরাট আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। এতে খাওয়ারিম শাহ ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি দূত পাঠান। অতঃপর রাত্রিবেলা নিজেই উজীর সমভিব্যাহারে গিয়ে মওলানা বাহাউদ্দীন ওয়ালাদকে তাঁর বহির্গমন থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি তাতে রাজি হননি। শেষাবধি তিনি তাঁকে অনুরােধ জানান, তিনি (মওলানা ওয়ালাদ) যেন এমনভাবে বেরিয়ে যান যাতে কেউ টের না পায়। অন্যথায় বিরাট গােলযােগ দেখা দিতে পারে। মওলানা এ অনুরােধে সম্মত হন। জুমু’আর দিন ওয়াজ করেন এবং শনিবার দিন বলখ থেকে বাগদাদের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েন। এ ওয়াজে তিনি খাওয়ারিযুম শাহকে তাতার সেনাবাহিনীর আগমন সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।

সুলতানুল-উলামা বল্খ থেকে অত্যন্ত শান-শওকতের সাথে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে তিনি যে শহরে গিয়েই উপস্থিত হন সেখানকার নেতৃস্থানীয় অভিজাত ব্যক্তিবর্গ ও ‘আলিম-উলামা শহরের বাইরে গিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানান এবং অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধা সহকারে তাকে নিজ নিজ শহরে (ক্ষণকালের জন্য হলেও) নিয়ে আসেন। এভাবে বাগদাদ, মক্কা মু’আজ্জমা, দামেস্কের বিভিন্ন স্থান ঘুরে অবশেষে তিনি মালাতিয়া গিয়ে পেীছেন। আকশিহর নামক স্থানে তিনি চার বছর অবস্থান করেন, পঠন-পাঠনে মগ্ন হয়ে পড়েন। অতঃপর আকশিহর থেকে লারিন্দা গমন করেন। এটি কাউনিয়ার অন্তর্গত একটি স্থান।

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী-বানী-কবিতা।

মওলানা জালাল উদ্দিন রুমি এবং তার পিতার কাউনিয়ায় উপস্থিতিঃ

 

রূমের সুলতান আলাউদ্দীন কায়কোবাদের আগ্রহ ও অনুরােধে তিনি ৬২৬ হিজরীতে কাউনিয়ায় আগমন করেন। সুলতান নিজেই তাকে অভ্যর্থনা জানান। মওলানা শাহী মহলের নিকট ঘােড়া থেকে অবতরণ করেন এবং সুলতান অত্যন্ত বিনয় সহকারে তাকে গ্রহণ করেন। মওলানা কাউনিয়া মাদরাসায় অবস্থান করেন। সুলতান তার অধিকাংশ সঙ্গী সহ মওলানার মুরীদ হন। হযরত বাহাউদ্দীন ওয়ালাদ দু’বছর কাউনিয়া অবস্থানের পর ৬২৮ হিজরীতে ইনতিকাল করেন।

 

এই গােটা সময়টাতেই মওলানা রূমী তাঁর পিতার সঙ্গী ছিলেন এবং জাহিরী ও বাতিনী ইলম তারই নিকট থেকে হাসিল করতে থাকেন। বাইশ বছর বয়সে তনি কাউনিয়া শহরে আগমন করেন এবং এ শহরই তার আবাসস্থল ও সমাধিস্থল ইসাবে পরিচিতি লাভ করে।

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী-বানী-কবিতা।

সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদ এবং জালাল উদ্দিন রুমির সম্পর্কের গভীরতাঃ

 

সুলতানের গৃহ-শিক্ষক আমীর বদরুদ্দীন গহরতাশ জালালুদ্দিন রুমীর গভীর পাণ্ডিত্য ও খােদাদাদ প্রতিভা লক্ষ্য করে তার জন্য কাউনিয়ায় মাদ্রাসা-ই-খােদাওয়ান্দিগার’ নামক একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করেন।

 

সুলতান আলাউদ্দীন কায়কোবাদ জালালুদ্দিন রুমীকে খুবই সম্মান করতেন এবং তার সঙ্গে শ্রদ্ধাপূর্ণ সম্পর্ক রাখতেন। তিনি কাউনিয়ায় দুর্গ নির্মাণ করলে জালালুদ্দিন রুমীকে সেখানে একদিনের জন্য হলেও বেড়িয়ে যাবার আবেদন জানান।

 

মওলানা জালালুদ্দিন রুমী দুর্গ পরিদর্শন করে মন্তব্য করেন : “প্লাবন রােধ ও শত্রু প্রতিরােধে এ নিঃসন্দেহে একটি উত্তম ব্যবস্থা। কিন্তু মজলুম ও নিপীড়িত মানুষের তীররূপী কাতর ফরিয়াদ, যা হাজারাে নয়, লাখাে বুরূজ থেকে প্রতিদিন নির্গত হচ্ছে এবং বিশ্বকে ভারাক্রান্ত করে তুলছে, তার প্রতিকার সম্পর্কে কি আপনি কোন চিন্তা করেছেন? ‘আদল ও ইনসাফের দুর্গ নির্মাণ করুন। এর ভেতরই বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তা নিহিত।”

সুলতান মওলানা জালালুদ্দিন রুমীর এ উপদেশে অত্যন্ত প্রভাবিত হন।

 

মওলানা বাহাউদ্দীন ওয়ালাদের ইনতিকালের পর তৎকালীন সুলতান, উলামায়ে কিরাম ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের ঐকমত্যে মওলানা জালালুদ্দিন রুমী স্বীয় পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি দস-তাদরীস তথা পঠন-পাঠন, তালকীন (ধর্মোপদেশ) ও ইরশাদের ধারা অব্যাহত রাখেন। তার গৃহশিক্ষক সায়্যিদ বুরহানুদ্দীন মুহাক্কিক তিরমিযী তিরমিয়া চলে গিয়েছিলেন। মওলানা বাহাউদ্দীন ওয়ালাদের ইনতিকালের পর তিনিও কাউনিয়া আগমন করেন। মওলানা রূমী তাঁর মুরীদ হন এবং স্বীয় পিতার অবর্তমানে তারই মাধ্যমে আধ্যাত্মিক সাধনার স্তরগুলাে অতিক্রম করেন। নয় বছর তিনি তাঁর সাহচর্যে কাটান। ৬৩৭ হিজরীতে সায়্যিদ বুরহানুদ্দীন ইনতিকাল করেন।

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী-বানী-কবিতা।

মওলানা জালালুদ্দিন রুমীর শিক্ষা সফর ও কর্মব্যস্ততাঃ

 

৬৩০ হিজরীতে মওলানা অধিকতর শিক্ষা লাভ ও আধ্যাত্মিক ফয়েয হাসিলের জন্য সিরিয়া (শাম) সফর করেন এবং হলব (আলেপ্পো)-এ অবতরণ করেন। সুলতান সালাহুদ্দীন তনয় আল-মালিকুজ-জাহির সে যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলিম কাশী বাহাউদ্দীন ইবনে শাদ্দাদের আন্দোলনের ফলে ৫৯১ হিজরীতে অনেকগুলাে বড় মাদ্রাসা তৈরী করেছিলেন। এর ফলে হলবও দামেস্কের মত জ্ঞান চর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।

 

হলব-এ এসে মওলানা জালালুদ্দিন রুমী মাদ্রাসা-ই-হালাবিয়ায় অবস্থান নেন এবং কামালুদ্দীন ইবনুল-আদীম থেকে উপকৃত হন। মওলানা জালালুদ্দিন রুমী যদিও এখানে বিদ্যার্জনে ব্যাপৃত ছিলেন, তবু সিপাহসালারের ভাষায় যে সব জটিল সমস্যার সমাধান কেউ করতে পারত না, তার সমাধান তিনিই করে দিতেন এবং সে সবের এমন সব যুক্তি পেশ করতেন যা কোন কিতাবে লিপিবদ্ধ ছিল না। হলব থেকে মওলানা জালালুদ্দিন রুমী দামেস্কে গমন করেন। সেখানে তিনি মাদ্রাসা-ইমুকাদ্দাসিয়ায় অবস্থান করেন। দামেস্কে সে সময় ‘আলিম-উলামার ভীড় লেগেই থাকত। সিপাহসালার লিখেছেন যে, দামেস্কে শায়খ মুহয়িউদ্দীন ইবনে ‘আরাবী, শায়খ সাদুদ্দীন হামুবী, শায়খ উছমান রুমী, শায়খ আওহানুদ্দীন কিরমানী ও শায়খ সদরুদ্দীন কাওনবীর সাহচর্যে মওলানা জালালুদ্দিন রুমী তার সময় অতিবাহিত করতেন।

এখানে হাকীকত ও মা’রিফত বিষয়ে তাদের পরস্পরের মধ্যে আলাপ-আলােচনা হত। ৬৩৪ কিংবা ৬৩৫ হিজরীতে মওলানা জালালুদ্দিন রুমী দামেস্ক থেকে ফিরে এসে কাউনিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সায়্যিদ বুরহানুদ্দীনের ইনতিকালের (৬৩৭ হি.)পর পাঁচ বছর পর্যন্ত তিনি বাহ্যত ‘আলিম-উলামার বেশ ধারণ করে সার্বক্ষণিকভাবে জ্ঞান চর্চা ও শিক্ষা দান কর্মে ব্যাপৃত থাকেন। ৬৩৮ হিঃ তে শায়খ মুহয়িউদ্দীন ইবনে আরাবী ইনতিকাল করেন। তার চারপাশে জ্ঞান জগতের যে সব উজ্জ্বল নক্ষত্রের সমাবেশ ঘটেছিল তাঁদের অধিকাংশই কাউনিয়ায় এসে সমবেত হয়েছিল। এঁদের মধ্যে শায়খ সদরুদ্দীনও অন্যতম।

 

প্রাচ্য ভূখণ্ডের দিক থেকে যে সৰ আলিম-উলামা ও বুযুর্গ সেখানকার ধ্বংসযজ্ঞের কারণে পেরেশান হয়ে রূমের দিকে রওয়ানা হতেন তাদের বেশির ভাগই পথিমধ্যে কাউনিয়াকেই তাদের আবাস ও আশ্রয়স্থল হিসাবে গ্রহণ করতেন। এভাবে কাউনিয়া সে যুগে মদীনাতুল-উলামা’য় (জ্ঞানীদের শহর) পরিণত হয়। এসব আলিম-উলামার মধ্যে মওলানা জালালুদ্দিন রুমীর স্থান ছিল সবার ঊর্ধ্বে। সে যুগে মওলানা ঐ সব কাজই করতেন যা সাধারণত আলিম-উলামা করে থাকেন অর্থাৎ পঠন-পাঠন, ওয়াজ-নসীহত, ফতওয়া প্রদান ইত্যাদি। মওলানা জালালুদ্দিন রুমী বেশির ভাগ সময় শিক্ষা দান কার্যে ব্যাপৃত থাকতেন। তাঁর নিজের মাদরাসায়ই চার শ’র বেশি ছাত্র ছিল।

পঠন-পাঠন ছাড়াও মওলানা জালালুদ্দিন রুমীর দ্বিতীয় যে কাজটি করতেন তা হ’ল ওয়াজ বা বক্তৃতা দান। ফতওয়া দান ছিল তার স্থায়ী কর্মের অন্তর্গত। বায়তু’ল-মাল থেকে মওলানার জন্য এক দীনার নির্ধারিত ছিল। একে তিনি সেই ফতওয়া প্রদানের পারিশ্রমিক হিসাবেই গণ্য করতেন। এ ব্যাপারে তিনি এতটা কঠোর ছিলেন যে, যখন তিনি চরম অভাব-অনটনে পতিত হতেন এবং ইলমের মজলিসে গভীরভাবে ডুবে থাকতেন তখনও তাঁর নির্দেশ ছিল, যে মুহূর্তেই কোন ফতওয়া আসবে তাৎক্ষণিকভাবে যেন তাঁকে খবর দেয়া হয়। দোয়াত-কলম সব সময় তাঁর সাথেই থাকত।

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী-বানী-কবিতা।

অবস্থার বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনঃ

 

৬৪২ হিজরী অবধি তার ঐ একই অবস্থা ছিল। অতঃপর এমন সব ঘটনার সূত্রপাত হয় যার ফলে তাঁর জীবনে এক বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন আসে এবং তিনি মওলবী জালালুদ্দীন কাওনবী থেকে ‘মওলানা-ই-রূমী’তে রূপান্তরিত হন। শাম্স-ই-তাব্রিজী-এর সাথে মােলাকাত এবং তাঁর সত্তার সঙ্গে আসক্তি ও বিলুপ্তির ফলে মওলানার এই অবস্তা ঘটেছিল। তিনি স্বয়ং বলেছেন :

 

مولوی هرگزنه شد مولائے روم + تاغلام شمس تبریزی نه شد

 

(রুমী) মওলভী ততক্ষণ পর্যন্ত মওলানা রূম হতে পারেনি যতক্ষণ পর্যন্ত না সে শাম্স তাবরীযীর গােলামী কবুল করেছে।

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী-বানী-কবিতা।

শামস তাবরীযঃ

 

শামস তাবরীয (মুহাম্মাদ ইব্‌ন আলী ইব্‌ন মালিকদাদ)-এর দেশ ও বংশ পরিচয় কি? তাঁর বিরুদ্ধবাদীরা অনেক অপবাদই তাঁর প্রতি আরােপ করেছিল। তন্মধ্যে একটি অপবাদ হ’ল তার (শাম্স তাবরীযের) বংশ-পরিচয় অজ্ঞাত।

 

نے در و اصل ونے نسب پیداست می نه دانیم هم که اوز کجاست

 

প্রকৃত ব্যাপার এই যে, শৈশব থেকেই তিনি উন্নততর যােগ্যতা, প্রেমের আবেগ ও মুহব্বতের অধিকারী ছিলেন। মানাকি ‘বু’ল-আরিফীন’ নামক গ্রন্থে স্বয়ং তাঁর মুখেই বর্ণিত আছে যে, তিনি যখন সাবালকে উপনীত হননি, তখন থেকেই তিনি মহানবী (সা)-এর ‘ইশক-এ এমন মত্ত হয়ে থাকতেন যে, তিরিশ চল্লিশ দিন পর্যন্ত তাঁর আহার গ্রহণের ইচ্ছেটুকুও হত না।

 

জাহিরী বিদ্যা অর্জন সমাপ্তির পর তিনি শায়খ আবু বকর সিল্লাবাফের নিকট মুরীদ হন। কতক বর্ণনায় জানা যায় যে, তিনি শায়খ ‘ইযুদ্দীন সনজাসীর মুরীদ ছিলেন। কতক বর্ণনায় অন্য নামের উল্লেখ আছে। হতে পারে যে, তিনি এঁদের সবার কাছ থেকেই ফয়েয লাভে ধন্য হয়েছিলেন।

এতসব সত্ত্বেও যখন তিনি তৃপ্ত হলেন না, তখন আল্লাহওয়ালা মানুষের সন্ধানে চতুর্দিকে ঘুরতে শুরু করলেন। তিনি এরূপ সাধারণ বেশে সফর করতেন যে, স্বয়ং তাঁর বিলায়েত ও কামালিয়ত সম্পর্কে কেউ কিছু জানতেই পারত না। তিনি কালাে পশমী কম্বল পরিধান করতেন এবং যেখানেই যেতেন সাধারণ সরাইখানায় অবস্থান করতেন এবং দরােজায় দামী তালা ঝুলিয়ে দিতেন, যাতে লােকে তাকে ধনী ব্যবসায়ী মনে করে। ঘরের ভেতর চাটাইয়ের বিছানা ছাড়া আর কিছুই থাকত না।

 

সফরের আধিক্যের কারণে লােকে তাকে ‘শামুস পক্ষী” বলে ডাকতে শুরু করেছিল। তিনি তাবরী, বাগদাদ, জর্দান, রূম, কায়সারিয়া ও দামেস্কে সফর করেন। তিনি পায়জামার ফিতা বুনে বিক্রি করতেন এবং এটাই ছিল তাঁর জীবিকা অর্জনের মাধ্যম। খাদ্য গ্রহণের অবস্থা এ রকম ছিল যে, দামেস্কে তিনি যে এক বছর অবস্থান করেন তখন সপ্তাহে এক পেয়ালা যবাইকৃত পশুর মাথার তৈরি শুরুয়া- তাও কোনরূপ তেল ছাড়া পান করতেন। তার সাহচর্যের বােঝা বহন করতে পারে এমন কাউকে তিনি পেতেন না। অধিকাংশ সময় তিনি দু’আ করতেন : প্রভু হে! আমাকে এমন কোন সঙ্গী জুটিয়ে দাও যে আমার সাহচর্যের ভার বইতে পারে।

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী-বানী-কবিতা।

শামস তাবরীষীর সঙ্গে জালালুদ্দিন রুমীর সাক্ষাৎ ও বিরাট পরিবর্তনঃ

 

মওলানা শামস তাবরীষীর শায়খ তাকে রূম যাবার নির্দেশ দেন এবং বলেনঃ সেখানে একটি দগ্ধ অন্তরের সাক্ষাৎ পাবে; তাঁকে আলােকিত করে এস। ৬৪২ হিজরীর ২৬শে জুমাদা আল-উখরার সােমবার তারিখে তিনি কাউনিয়া পৌছেন। এবং সেখানে চিনি বিক্রেতাদের মহল্লায় অবস্থান করেন। একদিন দেখতে পেলেন, মওলানা পশুপৃষ্ঠে সওয়ার হয়ে আসছেন আর তার চারপাশের লােকেরা তার জ্ঞান-ভাণ্ডার থেকে উপকৃত হয়ে চলেছে। শাম্স অগ্রসর হয়ে জিজ্ঞেস করলেন? রিয়াযত ও জ্ঞানের উদ্দেশ্য কি?

 

মওলানা জালাল উদ্দিন রুমি বললেনঃ আদব ও শরীয়ত সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া। শাম্স তাবরীযী বললেন : না, আসল লক্ষ্যে না পৌছা পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়া। এরপর তিনি হাকীম সানাঈ-এর নিম্নোক্ত কবিতাটি আবৃত্তি করেন :

 

علم كزنو ترانه بستاند + جهل ازاں علم به بود بسیار

 

যে জ্ঞান তােমার অহংবােধকে তােমা থেকে ছিনিয়ে নিতে পারে না, সে জ্ঞানের চেয়ে মূর্খই উত্তম।

মওলানা জালাল উদ্দিন রুমি এতে বিস্মিত হন। অপরদিকে শাম্স এর তীর লক্ষ্যভেদে সক্ষম হয়। মওলানা জালাল উদ্দিন রুমি তাকে সংগে করে নিজের ঘরে নিয়ে আসেন এবং আফলাকীর ভাষায় চল্লিশ দিন পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে এক কামরায় থাকেন। ঐ সময় উক্ত কামরায় কারাে প্রবেশাধিকার ছিল না। সিপাহসালার বলেনঃ ছয় মাস পর্যন্ত সালাহউদ্দীন যরকুবের কামরায় এ দু’জন বুযুর্গ একান্তে অতিবাহিত করেন। শায়খ সালাহউদ্দীন ব্যতিরেকে আর কারােরই উক্ত কামরায় প্রবেশাধিকার ছিল না।

 

শাম্স তাবরীযী-এর সাক্ষাৎ মওলানা জালাল উদ্দিন রুমিকে এক নতুন জীবন, নতুন চেতনা ও নতুন জগত দান করে। মওলানা জালাল উদ্দিন রুমি নিজেই বলেন :

 

شمس تبریزی بما راه حقیقت بنمود +ماز فيض قدم اوست که ایمان داریم

 

শামস তাবরীয আমাদেরকে হাকীকতের রাস্তা দেখিয়েছেন। এটা তারই পদযুগলের ফয়েয যে, আমরাও আজ ঈমানের অধিকারী।

এতদিন পর্যন্ত মওলানা ছিলেন সে যুগের উস্তাদ ও শ্রেষ্ঠতম বুযুর্গের আসনে আসীন। ছাত্র-শিক্ষক, জ্ঞানী-গুণী, সূফী-দরবেশ সবাই ছিল তাঁর অনুগ্রহপ্রাথী, তার থেকে উপকৃত হতে আগ্রহী। কিন্তু আজ তিনি নিজেই অনুগ্রহপ্রার্থী আর শামস তাবরীয তাঁকে ইরশাদ ও ফয়েয প্রদানের মালিক। মওলানার সাহেবজাদা সুলতান ওয়ালাদ বলেন :

 

شیخ استاذ گشت نو آموز + درس خواندی بخدمتش هر روز گرچه در علم فقر کامل بود + علم نو بود کو بو به نمود

 

‘আলিমদের শায়খ ও উস্তাদ নতুন করে শিক্ষার্থী সাজলেন; শাম্স-ই তাবরীযীর খেদমতে তিনি দৈনিক পাঠ গ্রহণ করতেন। দরবেশীর ইলমে তিনি কামিল থাকা সত্ত্বেও তাঁকে একটি নতুনতর ইলম প্রত্যক্ষ করান।

 

খােদ মওলানা (র) তার নিজের মুখেই এ সম্পর্কে বলেন :

 

زاهد بودم ترئه گویم کردی * سرفتنه بزم و باده جویم کردی سجاده نشين بار قاره بودم + بازیچه کو دکاں گویم کردی

 

আমি ছিলাম দরবেশ, (তিনি) আমাকে গায়ক বানিয়ে দিলেন, বানিয়ে দিলেন মদ্যপায়ীদের সর্দার ও মদখাের মাতাল। আমি ছিলাম মর্যাদাবান গদ্দীনশীন পীর; তিনি আমাকে অলি-গলিতে ক্রীড়ারত শিশুদের খেলনায় পরিণত করলেন।

ফল দাঁড়াল এই যে, শামস-ই-তাবরীযীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হবার পর থেকে মওলানা শিক্ষা দান, ওয়াজ-নসীহত সব কিছুই ছেড়ে দিলেন। তিনি বলেছেন :

عطار دوار دفتر پاره بودم + زدشت او زمانی می نشستم چو دیدم نوح پیشانی ساقی + شدم مست و قلم هارا شکستم

আমি বুধ গ্রহের মত প্রতিটি মজলিসের আলােচ্য বিষয় ছিলাম। এবার অনেক কাল যাবত তার ময়দান থেকে বসে পড়েছি। নূহ (আ)-এর মত ললাটধারী পানীয় পরিবেশনকারী (সাকী)-কে যখন দেখতে পেলাম তখন পাগল হয়ে গেলাম এবং কলমগুলাে ভেঙে ফেললাম।

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী-বানী-কবিতা।

ব্যাপক আলােড়ন সৃষ্টিঃ

 

মওলানা যখন এভাবে অন্যান্য সব সম্পর্ক ছিন্ন করে প্রতিটি কথায় শামস তাবরীযীকে অনুসরণ ও অনুকরণ করতে লাগলেন, তখন বিষয়টি মওলানার শাগরিদ ও মুরীদদের নিকট ভীষণ পীড়াদায়ক ঠেকল। অতঃপর এ নিয়ে চারদিকেই আলােড়ন ও গুঞ্জরণের সৃষ্টি হল।  ( মারেফত কি এবং মারেফত কাকে বলে )

 

শাম্স-এর অবস্থা সম্পর্কে জনসাধারণ তেমন ওয়াকিফহাল ছিল না। মুরীদদের ধারণা, “আমরা বছরের পর বছর ধরে মওলানার খেদমতে কাটিয়ে দিলাম, মওলানার কারামত দেখলাম, তার খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। অথচ আজ কোথা থেকে নাম-গােত্রহীন এক লােক এসে তাকে আমাদের মাঝ থেকে এমনভাবে ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিয়ে গেল যে, তার চেহারা দেখার সুযােগ থেকেও আমরা বঞ্চিত হয়ে গেলাম। তার লেখাপড়া, শিক্ষা দান, ওয়াজ-নসীহত সবই বন্ধ হয়ে গেল। এ লােক নিঃসন্দেহে কোন যাদুকর হবে, নয়ত প্রতারক। অন্যথায় তার কী সাধ্য যে, পর্বতসম এই ব্যক্তিত্বকে খড়কুটোর মত ভাসিয়ে নিয়ে যায়।”

 

মােট কথা, সবাই শামস তাবরীযীর দুশমনে পরিণত হল। তারা মাওলানার সামনে কিছু বলতে পারত না বটে, তবে তিনি একটু এদিক-সেদিক গেলেই তারা শামসকে ভাল-মন্দ বলত এবং রাত-দিন এই ধান্ধায় ফিরত কখন ও কিভাবে হযরত শামস তাবরীযীকে সেখান থেকে বিতাড়িত করা যায় যাতে করে তারা পূর্বের মত মওলানার সাহচর্য লাভ করে ধন্য হতে পারে।

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী-বানী-কবিতা।

শাম্স-এর অন্তর্ধান

 

হযরত শামসুদ্দীন এসব লােকের গােস্তাখী নীরবে সইতে থাকেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, মওলানার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধার কারণেই এসব লােক এভাবে মনঃক্ষুন্ন। কিন্তু তাদের আচরণ যখন সীমা লঙ্ন করল এবং তিনি বুঝতে পারলেন যে, এবার গােলযােগ সৃষ্টির সমূহ আশংকা রয়েছে, তখন তিনি একদিন নীরবে নিঃশব্দে কাউনিয়া পরিত্যাগ করলেন। আফলাকী তাঁর এই প্রথম অন্তর্ধানের তারিখ ৬৪৩ হিজরীর ১লা শাওয়াল রােজ বৃহস্পতিবার বলে উল্লেখ করেছেন। সে হিসাবে প্রথমবার তিনি সােয়া বছরের মত কাউনিয়ায় অবস্থান করেন।

 

শাম্স-এর বিচ্ছেদ ছিল মওলানা জালাল উদ্দিন রুমীর কাছে অত্যন্ত কষ্টকর ও পীড়াদায়ক। মুরীদেরা যা ভেবেছিল– ঘটল তার উল্টোটি। শাম্স চলে যাবার পর মওলানা জালাল উদ্দিন রুমী তাদের প্রতি কী মনােযােগ দেবেন, আগে যেটুকু দিতেন এখন তাও ছেড়ে দেবার উপক্রম হল। কিছু সংখ্যক নাদানের কারণে সৎ ও বিশ্বস্ত লােকেরাও মওলানার সাহচর্য থেকে এভাবে বঞ্চিত হতে হল।

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী-বানী-কবিতা।

মওলানা জালাল উদ্দিন রুমীর অস্থিরতা এবং শাম্স তাবরীযী-এর প্রত্যাবর্তনঃ

 

সিপাহসালারের বর্ণনা মুতাবেক দামেস্কও থেকে মওলানার নামে শামসুদ্দীনের পত্র না আসা অবধি এই বিচ্ছেদ ও বিচ্ছিন্নতা বজায় ছিল। পত্র প্রাপ্তির পর মওলানার অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটে এবং শাম্স-এর প্রতি আগ্রহ ও প্রেম তাকে ‘সামা’র প্রতি আকৃষ্ট করে তােলে। তিনি সে সব লােকের প্রতি আগের মতই নেক নজর অব্যাহত রাখেন যারা শামস-এর বিরুদ্ধে কোনরূপ অসদাচরণ করেনি। ঐ সময় মওলানার জালাল উদ্দিন রুমী হযরত শাম্স-এর খেদমতে পত্রাকারে চার লাইন কবিতা লিখে পাঠান। এতে তিনি নিজের অস্থিরতা এবং তাঁর প্রতি অপরিসীম আগ্রহের কথা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন :

 

ایها النور في الفواد تعال + غابة الوجد والمراد تعال ايها السابق الذي سبقت + منك مصدوقة الوداد تعال چوں بیانی زهی کشاد و مراد + چوں نیانی زهے کسا نعال

انت كالشمس اذ دشت ونات + با قريبا على البعد تعال

 

ওহে আলাে! আমার হৃদয়ে এস; হে আমার প্রেম ও লক্ষ্যের শেষ গন্তব্যস্থল! এস। এস, ওহে অগ্রগামী! তােমার দিক থেকে সত্যিকার প্রেম তাে আগেই প্রকাশ পেয়েছে; অতএব আর দেরী নয়, এস। যখন তুমি আসবে তখন তা হবে বিরাট বিজয় ও সাফল্য। যদি তুমি না আস, তাহলে সেটা হবে বিরাট ক্ষতি; অতএব তুমি এস। তুমি তাে সূর্যের মত দীপ্তিময়। চাই কাছে থাক আর দূরেই থাক। হে দূরবর্তী থেকেও নিকটবর্তী, এস।

ইতিমধ্যে গােলমাল কিছুটা স্তিমিত হয়ে যায়। অবকাশ ও প্রসন্নতা লাভের পর লোকেরা শাম্স-এর বিরােধিতা পরিত্যাগ করে। মওলানা শামসকে ফিরিয়ে আনবার উপায় খুঁজে বের করেন। পুত্র সুলতান ওয়ালাদকে ডেকে বলেনঃ তুমি আমার পক্ষ থেকে শাহ-ই-মকবুলের দিকে ছুটে যাও এবং এটা নিয়ে গিয়ে তার পায়ের ওপর উৎসর্গ কর-আর আমার হয়ে বল, যে মুরীদেরা গােস্তাখী করেছিল তারা সকলেই তওবা করেছে এবং আশা করছে, যেসব অন্যায় ও ত্রুটি হয়ে গেছে তা যেন মাফ করে দেওয়া হয়। এবার দয়া করে তিনি যেন এদিকে পা ফেলেন। তিনি তার হাত দিয়ে যে চিঠি লিখেছিলেন তা ছিল নিম্নরূপ :

 

که از آن دم که تو سفر کردی + از حلاوت جدا شدیم چو موم همه شب چو شمع می سوزیم + ز آتشش جفت و زا أنگبين محروم در فراق جمال تو مارا + جسم و پران و جان از و چون پوم های منان وابدیں طرف پرتاب + زفت کن پیل عیش را خرطوم به حضورت سماع نیست حلال + همچو شیطان طرب شده مرجوم

و يك غزل ہے تو هیچ گفته نشد + نارسیداں مشرفه مفهوم پس بذوق سماع نامه نو + غزل پنج و شش بشد منظوم شام از تو چو صبح روشن باد + اے بنو فخر شام و ارمن وروم

 

যে মুহূর্তে তুমি এখান থেকে চলে গেছ, আমি মােমের মত গলে গেছি, বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি জীবনের সকল স্বাদ ও আহলাদ থেকে। সারা রাত আমি মােমবাতির মত জ্বলতে থাকি; আগুনের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটলেও মধুর স্বাদ থেকে বঞ্চিত আমি।। তােমার সৌন্দর্য সুখ থেকে বঞ্চিত হবার কারণে আমার দেহ-মন পেঁচকের মত বিরান হয়ে গেছে। একটু এদিকে তােমার অশ্বের গতি ফেরাও; আমার জীবনের হস্তীশুণ্ডকে একট ম্যৰূত কর। তােমার উপস্থিতি ব্যতিরেকে সামা’র মজলিস বৈধ নয়; আমার জীবন মালঞ্চের ওপর শয়তানসদৃশ বােঝা চেপে বসেছে। তােমা ব্যতিরেকে কোন গীতি গীত হয়নি, এমতাবস্থায় মুবারক লিপি এসে পেীছল। তােমার পবিত্র লিপি শােনার আনন্দে পাঁচ-ছ’টি কাব্য লিখে ফেলেছি। তােমার সন্দর্শনে আমার সন্ধ্যাও যেন ভােরের ন্যায় আলােকিত হয়ে ওঠে। ওহে। যার সত্তার জন্য শাম, আরমান ও রােম গর্বিত।

 

সুলতান ওয়ালাদ হযরত শামসকে অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধার সঙ্গে কাউনিয়া নিয়ে আসেন।

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী-বানী-কবিতা।

শাম্স-এর দ্বিতীয় দফা অন্তর্ধানঃ

 

হযরত শাম্স-এর কাউনিয়া প্রত্যাবর্তনে মওলানার খুশির সীমা ছিল না। যে সমস্ত লােক গােস্তাখী করেছিল তারা সবাই এসে ক্ষমা প্রার্থনা করে। বেশ কিছুকাল উভয়ের এই নির্মল সাহচর্য অব্যাহত থাকে। ইতিমধ্যে হযরত শামস-এর সঙ্গে মওলানার ঐক্য ও ঘনিষ্ঠতা পূর্বের তুলনায় আরাে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ সুখ ও সৌভাগ্য বেশি দিন টিকল না। আবার আবিলতা ও মালিন্যের উপকরণ জমে উঠতে লাগল। মওলানার কামরার নিকটই সুফফা দালানের একদিকে হযরত শীস অবস্থান করতেন। শামস সেখানে তাঁর স্ত্রীসহ বসবাস করতেন। কাউনিয়াতেই তিনি এ বিয়ে করেন। মওলানার মেজোপুত্র (চিল্পী ‘আলাউদ্দীন) যখন মওলানার ঘরে যেতেন তখন এদিক দিয়েই যেতেন। কিন্তু এদিক হয়ে তার এ যাওয়া-আসা মওলানা শামসুদ্দীন তাবরীযী পছন্দ করতেন না। তিনি কয়েকবার তাকে অত্যন্ত স্নেহ-কোমল কণ্ঠে কথাটি বােঝাবার চেষ্টা করেন, কিন্তু তা উল্টো ‘আলাউদ্দীনের মনঃকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। হযরত শামসুদ্দীন সুলতান ওয়ালাদকে বেশি স্নেহ করেন- এটাও ছিল তার মর্মপীড়ার অন্যতম কারণ। আলাউদ্দীন বিষয়টি নিয়ে অন্যদের সঙ্গেও আলােচনা করেন। যে সমস্ত লোক এ ধরনের একটি সুযােগের অপেক্ষা করছিল তারা এর ওপর আরাে একটু রঙ চড়ায়। তারা বলতে থাকে : বেশ তাে লােক! কোথাকার কে, জানা নেই- শােনা নেই,হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। মওলানার ঘর দখল করে তার ছেলেকেই ঘরে আসতে দিচ্ছে না!

হযরত শামসুদ্দীন কেবল বিনয় ও সহিষ্ণুতার কারণে এতদিন এ বিষয়ে মওলানার সঙ্গে কোন আলাপ করেননি। কিন্তু পরিস্থিতি যখন সীমা অতিক্রম করল তখন তিনি সরাসরি সুলতান ওয়ালাদকে বললেন : ঐসব লােকের আচরণে এটা বুঝতে পারছি যে, এবার এমনভাবে অন্তর্ধান করতে হবে যাতে কেউ আর আমার খোজ না পায়। মওলানার কতক গফল থেকে পরিষ্কার প্রতিভাত হয় যে, তিনিও এ ব্যাপারে অবহিত ও আশংকিত ছিলেন এবং কবিতার মাধ্যমে এর থেকে বিরত হবার জন্য শায়খের কাছে অনুনয়-বিনয় করেছিলেন।

 

যা-ই হােক, হযরত শামসুদ্দীন-এর বিরুদ্ধে লােকের মন-মানসিকতা পুনরায় তুঙ্গে ওঠে। তিনি নিজেও অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন। একদিন দেখা গেল যে, তিনি অকস্মাৎ অন্তর্ধান করেছেন।

ناگهان گم شد از میان همه + تار و داز دل اندهان همه

 

অকস্মাৎ তিনি সবার মাঝ থেকে হারিয়ে গেলেন যাতে করে অন্তর-মন থেকে সর্বপ্রকার অস্থিরতা খতম হয়ে যায়।

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী-বানী-কবিতা।

মওলানা জালাল উদ্দিন রুমির অস্থিরতাঃ

 

সকাল বেলা মওলানা জালাল উদ্দিন রুমি যখন মাদরাসায় এসে শাসকে ঘরে পেলেন নাতখনই চিৎকার করে ওঠেন এবং সুলতান ওয়ালাদের ঘরে গিয়ে তাকে ডেকে বলেন :

بہاو الدین چه خفته بر خیز وطلب شیخت کن که باز مشام جان را از فوائح لطف او خالی می بابیم

আরে বাহাউদ্দীন। শুয়ে রয়েছ কেন? ওঠো, স্বীয় শায়খ-এর অনুসন্ধান কর । আমি আমার অন্তরের ঘ্রাণেন্দ্রিয়কে তাঁর মেহেরবানীর সুরভি থেকে বঞ্চিত পাচ্ছি।

দু’তিন দিন যাবত তিনি চতুর্দিকে অনুসন্ধান করতে থাকেন। কিন্তু কোথাও হযরত শাম্স-এর সন্ধান পাওয়া গেল না। এবারে মওলানা শাম্স-এর অন্তর্ধানে মওলানা রূমীর অবস্থা আগের তুলনায় আরাে বেশী পরিবর্তিত হয়ে যায়।

بے سر و پاز مشق او چو ذو النون

شیخ گشت از فراق او مجنون

শায়খ (মওলানা রুমী) তার বিচ্ছেদে ব্যথায় পাগল হয়ে যান এবং তার প্রেমে যুন-নূন মিসরীর মত দিশেহারা হয়ে পড়েন।

যে সমস্ত লােকের কারণে তাঁর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল মওলানা তাদের সবাইকেই তার (মওলানা রুমীর) নিজের সাহচর্য থেকে বের করে দেন। এবার তিনি গযল গাওয়া ও সামা মাহফিলেই সময় ব্যয় করতে শুরু করেন। এ ঘটনা ৬৪৫ হিজরীর।

হযরত শামস (র) গায়েব হয়ে যাবার পর মওলানা দুদিন চতুর্দিকে তার তালাশ করেন। কোনভাবেই যখন তার সন্ধান পাওয়া গেল না তখন তার নিজের অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়। সামা’র তরীকা (পন্থা-পদ্ধতি) তাে তিনি প্রথমেই এখতিয়ার করেছিলেন। এখন তার অবস্থা হ’ল, সামা ভিন্ন তিনি একটি মুহূর্তেও অতিবাহিত করতে পারেন না। মাদ্রাসায় তিনি টহল দিয়ে ফিরতেন এবং প্রকাশ্যে ও গােপনে শােরগােল করতেন, করতেন ফরিয়াদ। এ সময় তিনি হযরত শামস-এর বিচ্ছেদ যন্ত্রণায় অনেকগুলাে মর্মস্পর্শী গজল রচনা করেন। তাঁর বেদনা-বিধুর গজলগুলির অধিকাংশই এ সময়ের রচনা।

 

এসব অস্থিরমনা ও চিত্তচাঞ্চল্য সত্ত্বেও মওলানার মন থেকে এ চিন্তা ও চেতনা কিন্তু একেবারে মুছে যায়নি যে, রােমকদের গৃহযুদ্ধ, মিসরীয়দের তুর্কতাযী এবং তাতারীদের ধ্বংসকর অভিযানের কারণে গােটা দেশই যেখানে তছনছ হয়ে যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে এই অশুভ ক্ষণে না জানি হযরত শাম্স-এর কি হয়েছে।

 

হযরত শামসুদ্দীনের গায়েব হয়ে যাবার পর তাকে পাবার আকাঙ্খায় মওলানার অবস্থা হয়েছিল এরূপ যে, যদি কোন লােক মিছেমিছিও বলত যে, সে হযরত শামুসকে অমুক জায়গায় দেখেছে অমনি মওলানা নিজের পরিহিত পােশাক খুলে তাকে দিয়ে দিতেন এবং শুকরিয়া আদায় করতেন।

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী-বানী-কবিতা।

সিরিয়া সফর ও সান্ত্বনা লাভঃ

সিরিয়া সফর ও সান্ত্বনা লাভঃ এরূপ উৎসাহ-উদ্দীপনার মাঝে মওলানা একদিন সিরিয়া সফরের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েন। তাঁর সঙ্গী-সাথীরাও তাঁর সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে। এভাবেই তিনি দামেস্কে পেীছেন এবং সেখানকার মানুষের অন্তর-মানসে প্রেমের আগুন জ্বালিয়ে দেন। সকল লােকই বিস্ময়াপন্ন হত, এরকম একজন আলিম ও ফাযেল ব্যক্তি কেন এরূপ দেওয়ানাপ্রায় হচ্ছেন? শাম্স তাবরীয আসলে বস্তুটা কী যার পেছনে এরূপ একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি মাথা কুটে মরছেন।

 

দামেস্কে যখন শাম্স-এর কোন পাত্তা পাওয়া গেল না তখন মওলানা বললেন : আমি আর শাম্স দুজন নই। তিনি যদি হন সূর্য তাহলে আমি তার আলােক-বিন্দু; আর তিনি যদি হন সমুদ্র তাহলে আমি তার (পানির) ফোটা। আলােক-বিন্দুর অস্তিত্ব তাে সূর্য থেকেই আর পানির ফোঁটার যে আর্দ্রতা তার উৎসও তাে সমুদ্রই। তাহলে আর পার্থক্যটা রইল কি? কয়েকদিন পর সিরিয়া (শাম) থেকে তিনি রূমের দিকে রওয়ানা হন।

 

অতঃপর কয়েক বছর তিনি কাউনিয়া অবস্থান করেন। এখানে তার প্রেমাবেগ পুনরায় উথলে ওঠে। কিছু লােক সাথে করে তিনি আবার সিরিয়া পানে রওয়ানা হন। এরপর কাউনিয়া প্রত্যাবর্তন করেন। এবারে তিনি এই ধারণা নিয়ে প্রত্যাবর্তন করেন, আমিই শামস তাবরীযী। শাম্স তাবরীযীর অনুসন্ধান আর কিছুই ছিল না, বরং নিজেকেই খুঁজে ফিরছিলাম আমি। এবার তিনি এই ধারণা নিয়ে ফিরে আসেন যে, শাম্স-এর ভেতর যা কিছু ছিল, স্বয়ং আমার মধ্যেও তা বর্তমান।

এবার দামেস্ক থেকে প্রত্যাবর্তনের পর মওলানা হযরত শাম্স-এর সঙ্গে মিলিত হবার ব্যাপারে একেবারে হতাশ হয়ে পড়েন। কিন্তু যে অবস্থা তিনি শামস-এর মাঝে প্রত্যক্ষ করতেন- তা তিনি নিজের মধ্যেই প্রত্যক্ষ করতে থাকেন। শায়খ সালাহউদ্দীন যরকূব বলেন,দামেস্ক থেকে দ্বিতীয় দফা প্রত্যাবর্তনের পর মওলানা কিছুদিন চুপচাপ থাকেন। এরপর তিনি শায়খ সালাউদ্দীনকে তাঁর গুপ্তভেদের সঙ্গী ও খলীফা বানান। ৬৪৭ হিজরীতে তিনি তাকে স্বীয় বিশিষ্ট সহচর নিযুক্ত করেন এবং হযরত শামসুদ্দীনের পরিবর্তে তাকেই স্বীয় সহযােগী ও অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করেন।

 

شه صلاح الدين زبعد شمس دین + گشت اور اندریں درزش معين حال وقالش از وجودش می فزود + سر مائے نادر از وی می شنود

صلاح اور داد و اشيخي و خليفنی – وسر لشکری جنود الله منصوب فرمود دیاران را | باطاعت کے مامور ساخت . ص. ۹۳ (ندوی)

 

শাহ সালাহ উদ্দীনই শামসুদ্দীন তাবরীযীর এ কাজে তার সাহায্যকারী হন। তাঁর হাল-চাল, কাজ-কর্ম ও কথাবার্তায় তার উন্নতি ঘটে; তার থেকে অনেক বিস্ময়কর গুপ্ত কথা তিনি শােনেন।

শায়খ সালাউদ্দীন কাউনিয়ার নিকটবর্তী একটি গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। গরীব পিতামাতার সন্তান ছিলেন। তিনি ছিলেন মৎস্যজীবী। অবশ্য সালাহ উদ্দীন নিজে স্বর্ণকারের পেশা গ্রহণ করেন। প্রথম থেকেই তিনি আমানতদারী, সততা ও বিশ্বস্ততার ক্ষেত্রে মশহুর ছিলেন। সায়্যিদ বুরহানুদ্দীন যখন কাউনিয়ায় আসেন, তখন তিনি তার মুরীদ হন এবং তাঁর দরবারে বিশিষ্ট আসন লাভ করেন। সায়্যিদ বুরহান উদ্দীনের ইনতিকালের পর তিনি মওলানার হাতে নতুন করে বায়’আত হন। মৃত্যুর দশ বছর পূর্বে তিনি মওলানার এরূপ নৈকট্য লাভ করেন যে, এই দশ বছর তিনি তাঁর বিশিষ্ট খলীফা হিসাবেই কাটান। ৬৫৭ হিজরীতে ১লা মুহাররাম তারিখে শায়খ ইনতিকাল করেন।  ( মারেফত কি এবং মারেফত কাকে বলে )

 

শায়খ যরকূবের সান্নিধ্যের কারণে পুনরায় গােলযােগ দেখা দেয়। এবার লােকের অভিযােগ ছিল যে, এর চেয়ে শামস তাবরীযীই বরং ছিলেন ভাল। তিনি আর যা-ই হােন, একজন ‘আলিম তাে নিশ্চয়ই ছিলেন। আর এ লােক হচ্ছে এখানকারই অধিবাসী। সবাই তাকে একজন সাধারণ লােক হিসাবে জানে। জীবন গহনার নকশা খােদাই করেছে, আর এখন মওলানার বন্ধু হয়ে বসেছে। আশ্চর্য লাগে যে, মওলানা নিজে এত বড় সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও এমন একজন লােককে ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনে কেন এতটা বাড়াবাড়ি করেন! শায়খ এসব শােনার পর বলেনঃ লােকের মনঃকষ্টের কারণ যে, মওলানা কেন আমাকে সবার মাঝে বৈশিষ্ট্য দান করলেন। কিন্তু তারা আসল কথা বুঝতে পারছে না যে, মওলানা নিজেই নিজের ‘আশিক। আমি তাে একটা বাহানামাত্র।

 

দশ বছর পর্যন্ত মওলানাকে সাহচর্য প্রদানের পর শায়খ হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং পহেলা মুহাররাম পরিপূর্ণ আত্মিক প্রশান্তির সাথে এই নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করেন।

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী-বানী-কবিতা।

চিল্পী হুসামুদ্দীনঃ

 

শায়খ সালাউদ্দীনের ইনতিকালের পর মওলানা চিল্পী হুসামুদ্দীন ইবনে আখী তুর্ককে স্বীয় নায়েব ও খলীফা নিযুক্ত করেন। চিল্পী হুসামুদ্দীন ছিলেন মওলানার বিশিষ্ট মুরীদদের অন্যতম এবং মওলানার ইনতিকালের পর এগার বছর পর্যন্ত তিনি মওলানার খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মূলত তুৰ্ক ও দেশীয় হিসাবে আরামীয় ছিলেন। রূমের মশহুর ও প্রভাবশালী খান্দান “আখী”-র সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন তিনি।

 

হযরত শামসুদ্দীন তাবরীষী ও শায়খ সালাহউদ্দীনেরও তিনি মুরীদ ছিলেন। | তাদের থেকেও তিনি উপকৃত হয়েছিলেন।হযরত হুসামুদ্দীন চিল্পী তার সমস্ত গােলাম ও কর্মচারীকে প্রকাশ্যে বলে রেখেছিলেন, তারা যেন নিজেদের মর্জি মতই কাজ করে। আস্তে আস্তে তিনি তাঁর মালিকানাধীন সমস্ত সম্পত্তি মওলানার খিদমতে ব্যয় করে ফেলেন। শেষে তিনি গােলামদেরকেও আযাদ করে দেন। মওলানাকে তিনি এতটা সম্মান করতেন যে, কোনদিন তিনি মওলানার ওযুখানায় ওযূ করতেন না। তীব্র ঠাণ্ডা ও শীত, গুঁড়ি গুড়ি বরফ পড়ছে, এতদসত্ত্বেও তিনি ঘরে গিয়ে ওযু করে আসতেন। অপর দিকে তাঁর সঙ্গে মওলানার আচরণও ছিল এমনি যে, বহিরাগত কোন দর্শক তা দেখার পর খােদ মওলানাকেই মুরীদ ভেবে বসত।

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী-বানী-কবিতা।

মসনবী প্রণয়নঃ

 

মছনবী শরীফ প্রণয়ন এ যুগের একটি উল্লেখযােগ্য কীর্তি। এতে হযরত হুসামুদ্দীনের ক্রমাগত তাকীদ ও চাপের একটি বিরাট ভূমিকা ছিল। যদি বলা হয় যে, মসনবী শরীফের অস্তিত্ব লাভ ঘটেছিল তাঁরই কারণে তাহলে সম্ভবত বেশী বলা হবে না।

 সাথী নির্বাচনের কারণঃ

মওলানা কোন না কোন সাথী ব্যতিরেকে আরাম পেতেন না। শামসুদ্দীনের পর সালাহুদ্দীন এবং সালাহুদ্দীনের পর হুসামুদ্দীন তাঁর গুপ্ত-রহস্য সঙ্গী ও অন্তরঙ্গ সাথী ছিলেন, বরং এ সিলসিলা যদি আরাে বাড়ানাে যায় তাহলে পরিষ্কার দেখা যাবে যে, সায়্যিদ বাহাউদ্দীন তিরমিযীও এ দলে শামিল যদিও তিনি ভিন্ন অবস্থান থেকে এ দলে এসেছিলেন। সায়্যিদ বাহাউদ্দীন তিরমিযীর ইনতিকাল এবং হযরত শাম্স-এর আগমন মধ্যবর্তী পাঁচ বছর মওলানা এমনভাবে অতিবাহিত করতেন যাতে মনে হত, এ সময় তিনি একটা কিছুর ঘাটতি অনুভব করছেন। এর থেকে যে ফলাফল বেরিয়ে আসে তা হল এই যে, মওলানার ভেতর যে কামালিয়াত প্রচ্ছন্ন ছিল সে সবের প্রকাশের জন্য কোন না কোন আন্দোলক ও উৎসাহদাতার প্রয়ােজন ছিল। তাঁর রচিত “দীওয়ান” ও “মছনবী” এসব প্রচ্ছন্ন আন্দোলনেরই সাক্ষী। কেবল হুসামুদ্দীনের অন্যমনস্কতার কারণে মছনবী শরীফের রচনা দু’বছর বন্ধ থাকে।

 

মওলানা কোন লােককে তাঁর কাশফ ও কারামতের কারণে সাহচর্যের জন্য নির্বাচিত করেননি। এ ক্ষেত্রে তাঁর অভিমত ছিল, মুহব্বতের কারণে সহজাতিত্ব। মওলানা নিজে তাঁর পুত্র সুলতান ওয়ালাদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, “সম্পর্কের দিক দিয়ে এক জাতিত্বের কারণেই তাকে আমি বিশিষ্ট বন্ধু হিসাবে জানি।” তিনি আরও বলেছেন : যে প্রেম ও ভালবাসা সৃষ্টি হয় সম্পর্কের কারণে তার পরিণতিতে লজ্জিত হবার কিছু নেই। প্রকৃত ভালবাসা ও সম্পর্ক সৃষ্টির দ্বারা দুনিয়া ও আখিরাতে কোথাও লজ্জিত হতে হয় না। সেজন্যই কিয়ামতের ময়দানে হিসাব-নিকাশে আটকে পড়া লােকগুলাে অভিলাষ জাহির করবে, “হায় ! আমি যদি অমুককে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ না করতাম।”

সিপাহসালার বলেন, মওলানার ইনতিকালের চল্লিশ দিন পূর্ব থেকেই কাউনিয়ায় ভূমিকম্প হচ্ছিল। আফলাকীর বর্ণনা মুতাবেক মওলানা শয্যাগত থাকাকালে সাতদিন উপর্যুপরি ভূমিকম্প হয়। অত্যধিক ভূমিকম্পের কারণে লােকেরা হাঁপিয়ে ওঠে এবং মওলানার সাহায্যপ্রার্থী হয়। এতে মওলানা বলেন : যমীন ক্ষুধার্ত, সে এখন খাবার চায়। সত্বরই সে তা পাবে আর তােমাদের কষ্টেরও অবসান ঘটবে। সে সময় তিনি নিম্নোক্ত গযল গেয়েছিলেন :

 

با این همه مهر و مهربانی + دل می دهدت که خشم رانی دین جمله شیشه هائے جانرا + درهم شکنی به لن ترانی

 

তােমার সেই করুণা ও কৃপা সত্ত্বেও অন্তর-মন তােমাকে ক্রোধান্বিত হবার অনুমতি দিচ্ছে, আর অনুমতি দিচ্ছে ‘লান তারানী’ (তুমি আমাকে কখনাে দেখতে পারবে না) বলে এই সব প্রাণের দর্পণ চূর্ণ করবার।

 

চিল্পী হুসামুদ্দীন বলেন , একদিন শায়খ সদরুদ্দীন দরবেশ-শ্রেষ্ঠদের সমভিব্যাহারে রুগ্ন মওলানাকে দেখতে আসেন। মওলানার অবস্থাদৃষ্টে তারা ব্যথিত হন এবং আল্লাহর দরবারে তার রােগ মুক্তির জন্য দু’আ করেন। সেই সঙ্গে তারা মওলানার পরিপূর্ণ সুস্থতা ফিরে পাবার ব্যাপারেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এতে মওলানা বলেনঃ এখন আরােগ্য লাভ আপনার জন্যই বরকতময় হােক! প্রেমিক ও প্রেমাস্পদের মাঝে অন্তরায় হিসাবে চুলের ন্যায় সরু ও চিকন এটি।

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী-বানী-কবিতা।
মুত্তাকী প্রেমিকদের গুণাবলী হবে নিম্নরূপঃ

 

الأخلاه يومئذ بعضهم لبعض عدو الأ الثقين.

 বন্ধুজনেরা পরস্পরের দুশমন হবে সেদিন; একমাত্র মুত্তাকীরাই হবে এর ব্যতিক্রম। মওলানা নিজে বলেন :

موجب ایمان نه باشد معجزات + ليك جنسیت بود جذب صفات

মু’জিযা ঈমানের কারণ হয় না, বরং স্বজাতিত্বের মিল গুণাবলী আত্মস্থ করবার মাধ্যম হয় (অর্থাৎ পারস্পরিক সম্পর্ক একের গুণ অন্যের মাঝে সংক্রমিত করে)।

আবরণ রয়ে গেছে। আপনি কি চান না যে, সেটা উঠে যাক এবং নূর নূরের সাথে গিয়ে মিলিত হােক। | রােগাক্রান্ত অবস্থায় তিনি নিম্নোক্ত গযল শুরু করেন। হুসামুদ্দীন চিল্পী তা লিখছিলেন আর কাঁদছিলেন।

رو سر بنه ببالين تنها مرا رها کن …. بادست اشارتم کرد که عزم سوني ماكن

যাও, তুমি তাকিয়ায় গিয়ে মাথা রাখ! আমাকে একাকী ছেড়ে দাও; আমার মত বিপর্যস্ত, বিপন্ন এবং রাতে বিচরণকারী মুসাফিরকে ছেড়ে যাও। আমি আছি আর আছে একরাশ চিন্তার উত্তাল তরঙ্গ; রাতদিন একাই থাকি। যদি চাও আস এবং বখশিশ কর অথবা চলে যাও এবং জুলুম কর। আমার থেকে পালিয়ে যাও যাতে তুমিও বিপদে না পড়। শান্তির পথ ধর, বিপদের রাস্তা পরিত্যাগ কর। আমি আছি আর সঙ্গে আছে চোখের পানি; পেরেশানির মধ্যে আটকে আছি। (এমতাবস্থায়) আমার অশ্রুমালার ওপর দিয়ে স্টীম রােলার চালাও। বিনা কারণে আমাকে মারে এবং পাষাণের ন্যায় নির্মমভাবে টানাহেঁচড়া করে। এ কথা বলে না যে, প্রতিশােধ নেবার পথ বের কর। মা’শূক (প্রেমাস্পদ)-দের সর্দারের ওপর বিশ্বস্ততা প্রদর্শন বাধ্যতামূলক নয়; ওহে হলুদ চেহারার প্রেমিক! তুমিই ধৈর্য ধর এবং বিশ্বস্ততা প্রদর্শন কর। আমি এমন এক আঘাত পেয়েছি মৃত্যু ভিন্ন যার কোন চিকিৎসা নেই; অতএব, আমি কেমন করে বলি যে, এ ব্যথার চিকিৎসা কর। গত রাতে আমি স্বপ্নে এক বৃদ্ধকে দেখলাম। সে আমাকে হাতের ইশারায় বলছে, আমার দিকে চলে আসার সংকল্প কর। ঠিক মৃত্যুর কাছাকাছি সময়ে তিনি বলেন :

 گرمومنی شیرین هم موئست مرگت + در کافری و تلخي هم كالومیست مردن

যদি তুমি মুমিন হও, মিষ্ট হও, তাহলে তােমার মৃত্যুও মু’মিন; আর তুমি যদি কাফির হও, তিক্ত ও বিস্বাদ হও, তাহলে তােমার মৃত্যুও কাফির।

৬৭২ হিজরীর জুমাদা আল-উখরার পাঁচ তারিখে সূর্যাস্তের সময় হাকীকত ও মারিফত বর্ণনারত অবস্থায় তিনি ইনতিকাল করেন। ইনতিকালের সময় মওলানার বয়স ছিল ৬৮ বছর তিন মাস।

মওলানার জানাযা বাইরে আনতেই এক কিয়ামত-দৃশ্যের অবতারণা হয়। সকল ধর্মের ও সকল জাতিগােষ্ঠীর লােকই তাতে শরীক ছিল। সবাই কাঁদছিল। ইয়াহুদী ও খ্রিস্টান তাদের স্ব স্ব ধর্মগ্রন্থ (তওরাত ও ইন্‌জীল) পাঠ করছিল।

মুসলমানেরা তাদেরকে বাধা দিচ্ছিল, কিন্তু তারা বিরত হচ্ছিল না। শেষাবধি গােলযোগের আশঙ্কা দেখা দেয়। যখন এ সংবাদ কাউনিয়ার শাসনকর্তা মুঈনুদ্দীন পরওয়ানার নিকট পেীছল তখন তিনি খ্রিস্টান ধর্মযাজক ও পাদরীদের জিজ্ঞেস করেন : (মওলানার জানাযায় শরীক হবার সঙ্গে) তােমাদের কী সম্পর্ক? তারা বলল : আমরা পূর্ববর্তী নবীদের হাকীকত এঁরই বর্ণনার মাধ্যমে বুঝতে পেরেছি এবং কামিল দরবেশদের চলনভঙ্গী তাঁর চলনভঙ্গী থেকেই জেনেছি। যা হােক, ঐ সব লােক জানাযার অনুগমন করে। লােকের ভীড় এত বেশি হয়েছিল যে, মুর্দার খাটিয়া খুব ভােরে মাদরাসা থেকে রওয়ানা হয়েছিল এবং সন্ধ্যার সময় কবরস্থানে গিয়ে পৌছেছিল। রাতের বেলা তাসাওউফ ও ফকীরির এই সুমহান সূর্য লােকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়।

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী-বানী-কবিতা।

চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য

 

মওলানা শিবলী মরহুম “সওয়ানেহ’-ই-মওলানা রূম” নামক গ্রন্থে বলেন : মওলানা যতদিন পর্যন্ত তাসাওউফের বেস্টনীর মাঝে আসেন নি ততদিন পর্যন্ত তাঁর জীবন ছিল জ্ঞানীসুলভ আঁকজমকের এক আশ্চর্য প্রতিমূর্তি। তার সওয়ারী যখন রাস্তায় বের হত তখন ‘আলিম-উলামা কিংবা ছাত্রই শুধু নয়, আমীর-উমারার একটি দলও তাঁর অনুসরণ করত। আমীর-উমারা ও সুলতানদের দরবারের সঙ্গেও তার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সক (আধ্যাত্মিকতার পথ)-এ প্রবেশ করবার সঙ্গে সঙ্গে তার এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। পঠন-পাঠন (দৱস ও ভাদরীস), ফতওয়া প্রদান ও জনকল্যাণমূলক কাজের সাথে তাঁর কিছু যােগ ছিল বটে, তবে তা ছিল অতীত জীবনের প্রতীকস্বরূপ। অন্যথায় তিনি সব সময়ই আল্লাহ প্রেম ও তার মা’রিফতের নেশায় ডুবে থাকতেন। রয়াযত ও মুজাহাদা তাঁর রিয়াযত ও মুজাহাদা ছিল সীমাতিরিক্ত। সিপাহসালার তাঁর সাহচর্যে গটিয়েছেন বছরের পর বছর। তিনি বলেনঃ আমি কখনােই তাঁকে রাত্রিকালীন পাশাকে দেখিনি। বিছানা কিংবা তাকিয়া (বালিশ) একেবারেই থাকত না। ইচ্ছে করেই তিনি শয়ন করতেন না। ঘুম আসলে বসে বসেই একটু ঝিমিয়ে নিতেন। তিনি বলতেন এমন লােক কি করে আরাম করতে পারে- তা সে যে পাশ ফিরেই শয়ন করুক না কেন-যার বিছানা কাটাভরা।

সামা মাহফিলে তাঁর মুরীদদের যখন ঘুম পেত তখন তিনি তাদের খাতিরে দেওয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে জানুর ওপর মাথা রাখতেন যাতে তার দেখাদেখি অন্যেরা নির্দ্বিধায় কিছুটা শুয়ে নেয়। তারা ঘুমিয়ে পড়তেই তিনি উঠে যেতেন এবং যিকর-আযকার ও তাসবীহ-তাহলীলে মত্ত হয়ে পড়তেন। একটি গলে এরই প্রতি তিনি ইঙ্গিত করেছেন :

همه خفتند و من دل شده را خواب نپرد

همه شب ديده من بر فلك أستاره شمرد خوابم از دیده چنان رفت که هرگز ناید

خواب من زهر فراق تو بنوشید و بمرد

সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু আমি হত হৃদয়ের ঘুম আসেনি। আমার আঁখিযুগল কেবল আসমানের তারকা গুণেই রাত কাটিয়েছে। ঘুম আমার চোখ থেকে এমনভাবেই উধাও হয়েছে যে, আর কখনাে ফিরে আসবে না। কেননা আমার চোখ তােমার বিচ্ছেদ বিষ পান করে মারা গেছে ( আর মৃত তাে পুনরায় ফিরে আসতে পারে না )। অধিকাংশ সময় তিনি সিয়াম পালন করতেন এবং উপর্যুপরি কয়েক দিন পর্যন্ত কিছুই খেতেন না।

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী-বানী-কবিতা।

সালাতের অবস্থা

 

সালাতের ওয়াক্ত হতেই তিনি কিবলামুখী দাঁড়িয়ে যেতেন। এ সময় তার চেহারার রং বদলে যেত। সালাতের মধ্যে তিনি নিজেকে হারিয়ে ফেলতেন। সিপাহসালার বলেন : নিজের চোখেই আমি বহুবার দেখেছি যে, এশার আওয়াল ওয়াক্তে তিনি নিয়ত বেঁধেছেন এবং দু’ রাকআত পড়তেই সুবেহ (তাের) হয়ে গেছে। মওলানা তার একটি গলে স্বীয় সালাতের অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন :

چو نماز شام هر کس نهد چراغ و خوانے

منم و خیال بارے غم و نوحه وفنانے چو وضو ز اشك سازم بود أنشب نمازم

در مسجدم بسوزد چو در در سد اذانے عجبا نماز مستان توبگو درست هست آن

که نداند او زمانی نه ششائد او مکانے عجبة دو رکعت ست ایں عجبا چهارم است این

عجبا چه سوره خواندم. چونداشتم زمانے

در حق چگونه کوبم که نه دست ماندوئے دل

دل دوست چوں توبردی بده لے خدا أمانے بخدا خبر نه دارم چو نمازی گزارم

که تمام شد رکوعی که امام شد فلانی

সবাই সন্ধ্যায় সালাত আদায় করেই দস্তরখানা বিছায় এবং প্রদীপ জ্বালায়; কিন্তু আমি তখন অন্য এক বন্ধুর কল্পনায় থাকি, থাকি পেরেশান। তারই বিরহ গাঁথা গাই এবং তারই কাছে ফরিয়াদ জানাই। চোখের পানিতে যখন ওযূ করি তখন আমার সালাতও আগুনে পরিণত হয়; মসজিদেই আমাকে পুড়িয়ে ফেলে যখন সেখানে আযানের আওয়াজ পেীছে। আরো পাগলদের সালাতই অদ্ভুত ধরনের। তােমরাই বল,এটা কি জায়েয? (এমতাবস্থায় যে,) না তারা (সালাতের) ওয়াক্তের খবর রাখে আর না রাখে স্থানের। বিস্ময়ের ব্যাপার, তারা জানে না এ সালাত দু’ রাক’আতের, না চার রাক’আতের? আরাে বিস্ময় এই যে, সালাতের সময় জ্ঞান যখন আমার নেই তখন কি করে বলি, আমি সালাতে কোন্ সূরা পড়েছি। আল্লাহ্র দরজার কিভাবে কড়া নাড়ি, যখন আমার হাতও নেই, হৃদয়ও নেই। হে খােদা! তুমি যখন হৃদয়, হাত সব কিছুই নিয়ে গেছ- তখন আমাকে (অন্তত) নিরাপত্তা দাও। আল্লাহর কসম! আমি যখন সালাত আদায় করি তখন কোন কিছুরই খবর রাখি না। কোন রুকূ’ পুরা হল কিনা, কে ইমামতি করল তাও জানি না। ( খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) এর সম্পূর্ণ জীবনী )

একবার শীতের দিনে মওলানা সালাতে দাঁড়িয়ে এত বেশি কাঁদেন যে, তাঁর সমস্ত চেহারা ও দাড়ি চোখের পানিতে ভেসে যায় এবং শীতের তীব্রতায় সে পানি জমে বরফে পরিণত হয়। অবশ্য তিনি সেভাবেই সালাতে মশগুল থাকেন। মেযাজের দিক দিয়ে তিনি সর্বোচ্চ মাত্রায় যুহদ-এ অভ্যস্ত এবং অল্পে তুষ্ট ছিলেন। সকল সুলতান ও আমীর-উমারাই নগদ অর্থ-কড়িসহ সর্বপ্রকার উপহার-উপঢৌকন তার কাছে পাঠাতেন। কিন্তু তিনি সে সবের কিছুই নিজের কাছে রাখতেন না। যা কিছু আসত এবং যেভাবে আসত তিনি তা সালাহুদ্দীন যরকুব অথবা চিল্পী হুসামুদ্দীনের নিকট পাঠিয়ে দিতেন। কখনাে এমনও দেখা গেছে যে, ঘরে এক মুঠো খাবারও নেই, এমতাবস্থায় মওলানার সাহেবযাদা সুলতান ওয়ালাদের পীড়াপীড়িতে ঐ সমস্ত জিনিস থেকে কিছুটা ঘরে রেখে দিতেন। যেদিন ঘরে খাবার কিছুই থাকত না-সেদিন মওলানা অত্যন্ত খুশি হয়ে বলতেন, “আজ আমাদের ঘরে দরবেশির গন্ধ অনুভূত হচ্ছে।”

বদান্যতা ও কুরবানী

দানশীলতা ও বদান্যতার অবস্থা ছিল এই যে, সায়েল (প্রার্থী)-কে কিছু দিতে পারলে দেহে আবা, কুর্তা যা-ই থাকুক না কেন, তাই খুলে দিয়ে দিতেন। পাছে খুলে দিতে দেরী হয় সেজন্য আবার মত কুর্তার সম্মুখ ভাগও সব সময় খােলা রাখতেন।

 

জালাল উদ্দিন রুমির জীবনী

পরার্থপরতা ও অহংশূন্যতা

 

একবার মুরীদদের সঙ্গে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে সংকীর্ণ একটি গলিপথের ওপর একটি কুকুর শুয়েছিল। ফলে রাস্তা গিয়েছিল আটকে। মওলানা থেমে গেলেন এবং অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন। বিপরীত দিক দিয়ে এক ব্যক্তি হেঁটে আসছিল। লােকটি কুকুরটাকে রাস্তা থেকে হটিয়ে দেয়। মওলানা এতে মনঃক্ষুন্ন হন এবং বলেন : তুমি ওকে না-হক কষ্ট দিলে।

একবার দু’জন লােক রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে ঝগড়া করছিল এবং একে অপরকে গালি দিচ্ছিল। তাদের ভেতর একজন অপরজনকে বলছিল? অভিশপ্ত। তুমি আমাকে একটা বললে বিনিময়ে আমি দশটা শুনিয়ে দেব। আকস্মিকভাবে মওলানা এদিক হয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। তিনি ঐ লােকটিকে ডেকে বললেন : ভাই ! তােমার যা কিছু বলার তা ওকে নয়, বরং আমাকে বল। কেননা তুমি আমাকে হাযারটা বললেও আমি প্রত্যুত্তরে একটিও বলব না। এ কথা শুনে লােক দুটি মওলানার পায়ে পড়ে ক্ষমা চেয়ে নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সন্ধি করে।

হালাল উপার্জন

আওক “ফি বিভাগ থেকে মাসিক ১৫ দীনার ভাতা নির্ধারিত ছিল। এর দ্বারাই মওলানা জীবিকা নির্বাহ কতেন। বিনা শ্রমে প্রাপ্ত অর্থে জীবিকা নির্বাহ করা তিনি অত্যন্ত অপছন্দ করতেন। সেজন্য তিনি এর বিনিময়ে ফতওয়া লিখতেন। মুরীদদেরকে তাকীদ দিয়ে রেখেছিলেন, “যখনই কেউ ফতওয়া নিয়ে আসে, তখন যে অবস্থায়ই থাকি না কেন, আমাকে অবশ্যই সংবাদ দেবে যাতে এর মাধ্যমে আমি হালাল উপার্জন করতে পারি।”

একবার কেউ বলেছিল, “শায়খ সদরুদ্দীন মাসে হাযার রূপিয়া ভাতা পান, আর আপনি পান কেবল পনের দীনার মাসিক।’ মওলানা জওয়াবে বলেছিলেন : শায়খ-এর খরচের পরিমাণও খুব বেশি। আসলে আমি যে পনের দীনার পাই সেটাও তারই পাওয়া উচিত।

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী-উক্তি-কবিতা।

দুনিয়াদারদের সংশ্রব বর্জন।

মওলানার অবস্থা থেকে বােঝা যায়, তিনি স্বভাবতই উৎসাহী ও আবেগপ্রবণ ছিলেন। ইশক তথা প্রেম তার প্রকৃতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছিল। জাহির “ইলম ও বুদ্ধিবৃত্তির অনুক্ষণ ধ্যান তাঁর ও প্রেমের এই আগুনকে দাবিয়ে রেখেছিল। শামস তাবরীযের অগ্নিবৎ ধ্যান তাঁর এ প্রেমের এই আগুনকে দাবিয়ে রেখেছিল। শামস তাবরীযের অগ্নিবৎ সাহচর্য তাঁর প্রকৃতিকে উস্কে দিয়েছিল এবং প্রশিক্ষণ ও পরিবেশ তাঁর ওপর যে আবরণ ফেলেছিল অত্যন্ত আকস্মিকভাবেই তা বিলীন হয়ে যায়। ফলে তিনি আপাদমস্তক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হন।

شعلها أخر زهر مويم دميد + ازرگ اندیشه ام أنش چکبد

১। আমার লােমকূপের গােড়া থেকে শেষাবধি অগ্নি-শিখা নির্গত হচ্ছে; আমার চিন্তার শিরা-উপশিরা থেকে আগুন ঝরে পড়ছে। ২। এই মকামে পৌঁছার পর ‘আরিফের প্রতিটি লােমকূপ থেকে আওয়াজ ধবনিত

در جهاں یارب ندیم من کجاست + نخل سينام كليم من كجاست

হে প্রভু-প্রতিপালক! দুনিয়াতে আমার সাথী (বন্ধু) কোথায়? আমি সিনাই পর্বতের খােরমা বৃক্ষ; আমার কলীম (হযরত মূসা) কোথায়?

মওলানা প্রকৃতিগতভাবেই আমীর-উমারা, সুলতান ও শাসকদের ঘৃণা করতেন এবং তাদের সংস্রব এড়িয়ে চলতেন। কেবল সদাচরণের খাতিরেই তিনি তাঁদের সঙ্গে কখনাে কখনাে মিলিত হতেন। একবার এক আমীর মওলানার নিকট এই মর্মে সংবাদ পাঠান, “অত্যধিক কাজের চাপে ফুরসৎ পাই না। তাই হযরতের দরবারে হাযির হবার মওকা জোটে খুবই কম। মেহেরবানী করে আমাকে ক্ষমা করবেন।” মওলানা তাকে বলে পাঠান :

“ক্ষমা প্রার্থনার প্রয়ােজন নেই। আসার চেয়ে না আসলেই বরং আমি বেশি কৃতজ্ঞ থাকি।”

।মসনবী ও তার জ্ঞানগত ও সংস্কারমূলক অবস্থান ও পয়গাম মছনবী

আর এটাই একমাত্র কারণ যে, অন্তরঙ্গ বন্ধু ও রহস্য-সঙ্গী ব্যতিরেকে তার পক্ষে জীবন ধারণ করা ছিল অসম্ভব। শামস তাবরীযের পর যতদিন পর্যন্ত না তিনি সালাহুদ্দীন যরকূব এবং সালাহুদ্দীন যরকূবের পর যতদিন পর্যন্ত হুসামুদ্দীন চিল্পীকে পেয়েছেন তাঁর অশান্ত ও অস্থির চিত্ত শান্ত হয়নি। “মােমের পক্ষে একাকী ছটফট করা সহজ নয়।”  এই জ্বলন্ত অগ্নিই তাঁকে ক্রমান্বয়ে সামা’র দিকে টেনে নিয়ে যেত এবং তিনি এ থেকে শক্তি ও খােরাক সগ্রহ করতেন। অনন্তর তিনি বলেন :

پس غذایی عاشقان أمد سماع + که از وباشد خیال اجتماع قونی گیرد خیالات ضمير + بلکه صورت گردد از بانک صفير آتش عشق از نواها گرد نیز به آنچنانکه آتش أن جون ریز

 

‘আশিকের খাদ্যই হচ্ছে সামা’র মাহফিল; কেননা এর দ্বারাই একাগ্রতা ও মানসিক প্রশান্তি আসে। অন্তরের কল্পনা একটা উল্লেখযােগ্য পরিমাণ শক্তি লাভ করে, বরং বাঁশীর আওয়াজে তার একটা ব্যবস্থা কিংবা সুরাহা হয়ে যায়। প্রেমের আগুন শব্দ দ্বারা আরাে বেগবান হয়েছে, যেরূপ এই অগ্নিকুণ্ডে কয়লা নিক্ষেপকারীর আগুনের অবস্থা।

এই তাপ ও জ্বালাই তাকে আরাে উস্কে দিয়েছে এবং চুপচাপ থাকাকে তার পক্ষে অসম্ভব করে তুলেছে। তাঁর ভাষায় :

جوش نطق از دل نشاں دو ستیست + بستگی نطق از پے الفتی است دل که دلبر دید کے ماند ترش + بلبل گل دیده کے ماند خمش

হৃদয় থেকে উৎসারিত শব্দের বন্যা উছলে পড়া মুহব্বতের আলামত; আর শব্দ আটকে যাওয়া সম্পর্কহীনতা ও প্রেমশূন্যতার কারণ। যে হৃদয় প্রেমাস্পদকে দেখতে পেয়েছে সে কি করে নিষ্প্রাণ ও স্বাদহীন থাকতে পারে; আর যে বুলবুল ফুল দেখেছে সে কি করে না গেয়ে থাকতে পারে।

 

এই বাদ্যযন্ত্র থেকে যে গীত নির্গত হল তার সংকলনই হ’ল মসনবী। এ তার ধ্যান-ধারণা ও অবস্থা, ঘটনা ও প্রতিক্রিয়া,পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার দর্পণ। এটা গায়বের ব্যথা ও জ্বালা,জোশ ও মত্ততা এবং ঈমান ও ইয়াকীন দ্বারা পূর্ণ। মসনবীর বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা ও নজীরবিহীন প্রভাব সৃষ্টির এটাই আসল কারণ।

هے رگ ساز میں رواصاحب ساز کا لہو

 

বাদ্যযন্ত্রের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় এর নির্মাতার রক্ত প্রবাহিত। বুদ্ধিবৃত্তি ও জাহির পরস্তীর সমালােচনা

 

মওলানার শিক্ষা ও এর বিকাশ ঘটেছিল সর্বাংশেই আশ’আরীদের জ্ঞানগত পরিবেশ ও পরিমণ্ডলে। তিনি নিজেও একজন সফল শিক্ষক ও যুক্তিবাগীশ ‘আলিম ছিলেন। আল্লাহর অনুগ্রহ যখন তাকে মা’রিফত (পরিচিতি) ও অবহিতির স্তর পর্যন্ত পৌছাল এবং বাণী থেকে অবস্থা, খবর থেকে নজর, শব্দ থেকে অর্থ এবং পরিভাষা ও সংজ্ঞার শাব্দিক ইন্দ্রজাল থেকে হয়ে যখন তিনি মূল সত্যে গিয়ে উপনীত হলেন, তখনই তিনি দর্শন ও ইলমে কালামের দুর্বলতা ও যুক্তি-প্রমাণ ও আনুমানিক সিদ্ধান্তের ভ্রান্তি পরিমাপ করতে সক্ষম হলেন। দার্শনিক, মুতাকাল্লিম ও যুক্তি-বাগীশদের অসহায়ত্ব ও মূল সত্য সম্পর্কে অজ্ঞতার হাকীকত তার সম্মুখে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। যেহেতু এ সবের প্রতিটি অলি-গলি সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন সেজন্য তিনি যা বলতেন তা তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতেই হ’ত এবং এর বাস্তবতাও কেউ অস্বীকার করতে পারত না।

এ যুগে দর্শন ও বুদ্ধিবৃত্তির উৎস হিসাবে সর্বাধিক জোর দেওয়া হত বাহ্য ইন্দ্রিয়ের উপর। বাহ্য-ইন্দ্রিয়কেই জ্ঞান লাভ ও নিশ্চিত বিশ্বাস উৎপাদনের সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও নির্ভরযােগ্য মাধ্যম বলে মনে করা হত। আর যে সব বস্তু এর আওতায় আসত না অর্থাৎ বুদ্ধির অগম্য ও ইন্দ্রিয়াতীত বিষয়বস্তুকে অস্বীকার করবার প্রবণতা বেড়ে চলেছিল। মু’তাযিলাগণ এই ইন্দ্রিয়ানুভূতি পূজার সবচেয়ে বড় প্রবক্তা ছিল। এই ইন্দ্রিয়ানুভূতি পূজা ঈমান বি’ল-গায়ৰ তথা অদৃশ্যে বিশ্বাস স্থাপনকে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল এবং ইসলামী শরীয়ত ও আল্লাহ কর্তৃক অবতীর্ণ ওয়াহীর পেশকৃত হাকীকতের প্রতি এক ধরনের অনাস্থার ভাব সৃষ্টি করে দিয়েছিল। মওলানা এই পঞ্চেন্দ্রিয় পূজা এবং এর তুখােড় প্রবক্তাদের সমালােচনা করতে গিয়ে বলেন :

چشم حس راهست مذهب اعتزال + دیده عقل است سنی در وصال

سخره حس اند اهل اعتزال + خویش راستی نمایند از ضلال هرکه در حس ماندا ومعتزلی است + گرچه گوید سنیم از خامی است هرکه بیرون شد زحسن ستی ویست + اهل بينش اهل عقل خویش بیست

জ্ঞান-বুদ্ধির চক্ষু সুন্নত ওয়াল-জামা’আতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মু’তাযিলীগণ ইন্দ্রিয়পূজার খেলনামাত্র; বিভ্রান্তি ও গােমরাহীর কারণে তারা নিজেদের সুন্নী হিসেবে দেখিয়ে থাকে। যে কেউই ইন্দ্রিয়-পূজায় অতিবাহিত করল, সে মু’তাযিলী অর্থাৎ সত্যানুসারীদের দলবহির্ভূত; যদি সে সুন্নী হবার দাবি করে, তবে এ তার দুর্বলতা। যে ইন্দ্রিয় পূজা থেকে বেরিয়ে এল সে সুন্নী ; জ্ঞানী ব্যক্তিরা কেবল তাদের বুদ্ধির ওপরই দাঁড়িয়ে থাকে।

তিনি স্থানে স্থানে এটা প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন যে, ঐসব বাহেন্দ্রিয় ছাড়াও মানুষকে কিছু প্রচ্ছন্ন ইন্দ্রিয় দান করা হয়েছে। আর এই প্রচ্ছন্ন ইন্দ্রিয় বাহেন্দ্রিয়ের তুলনায় অনেক বেশী বিস্তৃত ও গভীর। মওলানা বলেন :

پنج حسب هست جز ایں بنج حس + آن چوزر سرخ رایں حسها چومس اندر ان بازار کا هل محشر اند + حس مس را چوں حس زرکے خرند حس ابداں قوت ظلمت می خورد + حس جان از آفتابی می چرد

ঐ পাঁচটি ইন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক) ছাড়াও আরও পাঁচটি ইন্দ্রিয় রয়েছে, যেগুলাে স্বর্ণের ন্যায় লাল আর এই বাহেন্দ্রিয় আমার মতই (মূল্যহীন)। জনসমাবেশে পরিপূর্ণ এই বাজারে তামার ন্যায় মূল্যহীন ইন্দ্রিয়কে স্বর্ণের ন্যায় মূল্যবান ইন্দ্রিয়ের বিনিময়ে ক্রয় করবে? শরীরের ইন্দ্রিয়াতৃতির খােরাক হ’ল অন্ধকার; আর হৃদয়ের মাঝে যে অনুভূতি বিরাজমান তার খােরাক সূর্য-কিরণ।

তাঁর মতে কোন বস্তু অস্বীকার কিংবা প্রত্যাখ্যানের জন্য এতটুকু প্রমাণ যথেষ্ট নয় যে, তা দেখা যায় না কিংবা তা ইন্দ্রিয় অনুভূতি অথবা উপলব্ধিতে ধরা পড়ে না। তার মতে বাতেন (প্রচ্ছন্ন বস্তু কিংবা বিষয়) জাহির (বাহ্যিক কিংৰা দৃশ্যমান বস্তু বা বিষয়)-এর পেছনে লুক্কায়িত এবং ঠিক সেইভাবে যেভাবে ঔষধের অন্তরালে উপকারিতা ও কল্যাণ লুকিয়ে থাকে। যারা এই অদেখা বা প্রচ্ছন্ন বস্তু অস্বীকার করে তাদের সম্পর্কে তিনি বলেন :

حجت منکر همی آمد که من به غیر ازیں ظاهر نمی بینم وطن هیچ نندیشد که هر جا ظاهر است + آن زحکمت هائے پنہاں فجرست

خود باطنیت + همچو نفع اندر دواها مضمریست فانده هر ظاهر

(অদৃশ্য বস্তুর) অস্বীকারকারীদের যুক্তি হ’ল“আমি এই দৃশ্যমান বস্তুজগত ছাড়া আর কোন জগতই দেখছি না।” তারা এটা চিন্তা করে দেখে না যে, প্রতিটি দৃশ্যমান বস্তু একটি প্রচ্ছন্ন মৌলিক সত্যের হিকমত থেকেই প্রকাশ পেয়েছে। প্রতিটি দৃশ্যমান বস্তুর কল্যাণ ও উপকারিতা তাে একটি প্রচ্ছন্ন বিষয়; যেমন ঔষধ দৃশ্যমান বস্তু, কিন্তু তার অন্তর্বর্তী উপকারিতা প্রচ্ছন্ন।

 

তার বক্তব্য এই যে, অস্বীকারকারীরা নিজেদের এই বাহ্যদর্শিতা ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীজনিত অভ্যাসের কারণে ঐসব বাতেনী হাকীকতের দর্শন থেকে বঞ্চিত এবং আসল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হতে মাহরাম।

چونکه ظاهر هاگر فتند احمقان + آي دقائق شد ازیشان پس نهان لاجرم محجوب گشتند از غرض + که دقیقه فوت شد در مفترض

বেওকুফেরা যখন কেবল প্রকাশ্য ও দৃশ্যমান বস্তুকে গ্রহণ করল তখন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়বস্তুর হাকীকত তাদের দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেল। এজন্যেই অসহায় এসব লােক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যভ্রষ্ট হ’ল; একটি কাল্পনিক ও কৃত্রিম বন্ধুর জন্য তাদের হাকীকত তথা মূল সত্যই হারিয়ে গেল।

পঞ্চেন্দ্রিয় থেকে অগ্রসর হয়ে তিনি যুক্তি ও জ্ঞান-বুদ্ধির ওপর সমালােচনার ছুরি চালিয়েছেন এই বলে যে, ‘আলম-ই-গায়ব বা অদৃশ্য জগতের হাকীকত ও আম্বিয়া ‘আলায়হিমু’স-সালামের ইলম ও মা’রিফতের ব্যাপারে যুক্তি ও জ্ঞান-বুদ্ধি সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ। তার নিকট অনুমানের কোন ভিত্তি নেই, এ জগতের কোন অভিজ্ঞতাও তার নেই। যে সমুদ্রের লবণাক্ত পানির অধিবাসী সে সুপেয় মিষ্টি পানির স্বাদ কি করে বুঝবে?

اسے که اندر چشمه شور است جات تو چه دانی شط وجيحون وفرات

ওহে। লবণাক্ত ঝর্ণার মাঝে তােমার অধিবাস, জীহুন ও ফোরাতের মত সুপেয় নদীর পানির স্বাদ তুমি কী করে বুঝবে।

তিনি সেই যুক্তি ও জ্ঞান-বুদ্ধিকে যা পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সূচনাপর্বের অধীন, আংশিক জ্ঞান নামে স্মরণ করে থাকেন। তাঁর মতে জল্পনা-কল্পনা ও সংশয় তার পরিণাম এবং অন্ধকার জগত তার স্বদেশভূমি। এই আংশিক জ্ঞানের চেয়ে পাগলামিও ভাল।

عقل جزوی آفتش وهم ست وظن … دست در دیوانگی باید زدن

আংশিক জ্ঞানের বিপদ হ’ল অনুমান ও ধারণা ; কেননা অন্ধকারের মাঝেই তার অধিবাস। আংশিক বুদ্ধি বুদ্ধিকেই দুর্নামের ভাগী করেছে ; দুনিয়ার মতলব মানুষকে ব্যর্থতার শিকারে পরিণত করেছে। এই জ্ঞান ও বুদ্ধি থেকে অমনোেযােগী হওয়াই ভাল । এর চেয়ে বরং পাগলামি আরও ভাল-অর্থাৎ এরূপ জ্ঞান-বুদ্ধি অপেক্ষা অজ্ঞানতার মাঝে বাস করাও ভাল।

 

তিনি বলেনঃ আমি স্বয়ং এই দূরদর্শী জ্ঞান-বুদ্ধির অভিজ্ঞতা লাভ করেছি, অতঃপর আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি।

از مردم عقل دور اندیش را بعد ازیں دیوانه سازم خویش را

এই দূরদর্শী বিদ্যা-বুদ্ধিকে আমি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছি এবং এই অভিজ্ঞতা লাভের পরই আমি নিজেকে পাগল বানিয়েছি।

 

অতঃপর মওলানা সােজা, সরল ও সহজবােধ্য ভাষায় বলেন, যদি ‘আকল (জ্ঞান ও যুক্তি-বুদ্ধি) দীনের হাকীকত ও মারিফত বুঝবার জন্য যথেষ্ট হত তাহলে তার্কিক, দার্শনিক, পণ্ডিত ও মুতাকাল্লিমগণই সবচেয়ে বেশী আল্লাহওয়ালা (আরিফ) এবং ধর্মের সূক্ষ্ম রহস্য সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হতেন।

اندریں بحث از خردره بین بدی فخر رازی راز دار دین بدے

মারেফতের জ্ঞান কিভাবে অর্জন করতে হয় বা আধ্যাত্বিকতা জাগরনের পদ্বতি।

মারেফতের জ্ঞান কিভাবে অর্জন করতে হয় বা আধ্যাত্বিকতা জাগরনের পদ্বতি।

মারেফতের জ্ঞান কিভাবে অর্জন করতে হয়ঃ সৃষ্টিগত ভাবে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে মারেফত বা আধ্যাত্বিকতা লুকায়িত রয়েছে। কারন আমাদের প্রত্যেকের উৎপত্তি পরমাত্মা থেকে। আর আধ্যাত্বিকতার মুল হচ্ছে পরমাত্মা। কিন্তু মারেফত বা আধ্যাত্বিকতা সকলের মধ্যে প্রকাশ পায়না। যাদের মন যতটুকু পরিমান পরমাত্মার নিকটে অবস্থান করে ততটুকু পরিমান আধ্যাত্বিকতাই তাদের মধ্যে জাগরিত হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে পৃথিবিতে খুব অল্প সংখ্যক লোকের মনের ভাব পরমাত্বার ভাবের কাছাকাছি রয়েছে। আর যাদেরই বা কাছাকাছি রয়েছে তাও খুব অল্প ভাব। কারন মানুষের ভাবনা পরমাত্মার দিকে যেতে চায় না। মানুষ পরমাত্মার ভাবনা ভাবতে চায় না। মনুষ ভাবতে চায় না তার মূল কোথায়? সে কোথা থেকে এসেছে? তাই মানুষ তার মূল পরমাত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ফলে তাদের মনে আধ্যাত্বিকতাও জাগ্রত হয় না।

মোটকথা যে যতটূকু পরমাত্মার সাথে বা সৃষ্টির মুলের সাথে সংযুক্ত রয়েছে তার ততটুকু আধ্যাত্বিকতা রয়েছে। আর আমাদের সাথে পরমাত্মার বা সৃষ্টির মূলের সম্পৃক্ততা নেই বলে আমাদের আধ্যাত্বিক জাগরনও হয় না।

মারেফত

আর কারো খুব অল্প আকারে মারেফতের জ্ঞান বা আধ্যাত্বিকতা জাগরিত হয়। আবার কারো একটু বেশি জাগ্রত হয়। তবে চুরান্ত পর্যায়ে জাগ্রত হয় কেবল মহাপুরুষদের মাঝে। আর এই পৃতিবীতে মহাপুরুষ বড়ই দুর্লভ। তবে যার মধ্যে যতটুকু মারেফতের জ্ঞান বা আধ্যাত্বিকতা জাগরিত হয় ততটুকুকে লালন করে আস্তে আস্তে আধ্যাত্বিকতা বাড়াতে হয়। কারন আধ্যাত্বিকতা জাগরন কোন সাধারন বিষয় নয়। এটা সৃষ্টিগত ভাবে মনের মধ্যে থাকতে হয়। আর সৃষ্টিগত ভাবে মনের মধ্যে না থাকলে এটা জাগানো সম্ভব নয়।

উপরে উল্লেখিত কথাগুলি সকলের জন্য প্রযোজ্য নয়। এটা শুধু উচু স্তরের সাধকদের বেলায় প্রযোজ্য। কারন আধ্যাত্বিকতার চুরান্ত পর্যায়ে পৌছার অনুভুতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এটা বর্ণনা দেওয়াও সম্ভব নয়। যে ঐ স্তরে পৌছেছে কেবল সেই তা বুঝতে পারবে। এই জন্য আধ্যাত্বিক মহাপুরুষ জালাল উদ্দিন রুমি (রহ) বলেছেন, যদি সূর্য পৃ্থিবীর কাছে চলে আসে পৃথিবী তা সহ্য করতে পারবে না। পৃথিবী জ্বলে পুরে ছারকার হয়ে যাবে। সেই রুপ ভাবে মানুষের হৃদয়ে যদি হঠাৎ উচু স্তরের আধ্যাত্বিকতা প্রকাশ পায় তাহলে মানুষ সহ্য করতে পারবেনা। মানুষের হৃদয় জ্বলে পুরে ছারকার হয়ে যাবে।

উপরের কথাগুলি এইজন্য বললাম যে, আমরা আধ্যাত্বিকতার অল্প অনুভুতি পেয়েই মনে করি যে, এটাই বুঝি আধ্যাত্বিকতার পরিপক্কতা। না এটা মোটেই না। এটা আধ্যাত্বিকতার ছুয়া মাত্র। আমি আগেই বলেছি পূর্ণ আধ্যাত্বিকতা কোন সাধারন বিষয় নয়। পবিত্র মহাগ্রন্থ গীতাতে বলা হয়েছে, সাধুকুলে জন্ম লাভ করা দুর্লভ জনম। অর্থাৎ একজন আধ্যাত্বিক মহাপুরুষের সংস্পর্শে থাকাই দুর্লভ বা পরম সৌভাগ্যের বিষয়। তাহলে পুর্ন আধ্যাত্বিকতা লাভ করা যে কত বড় দুর্লভ বিষয় তা একটু ভেবে দেখুন।

তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমাদের হৃদয়ে আধ্যাত্বিকতা যদি জাগরিত নাও হয় তবুও বার বার শ্রেষ্টা করা উচিত। কারন জাগ্রত করার শ্রেষ্টা করাও পরম সৌভাগ্যের বিষয়। পৃথিবীতে কয়জনই বা এর শ্রেষ্টা করে।

মারেফতের জ্ঞান বা আধ্যাত্বিকতা জাগরনের পদ্ধতি এবং মারেফত কিভাবে অর্জন করতে হয়।

১। পজেটিভ চিন্তা চেতনাঃ

মানুষ কর্মমুখী। কর্ম করেই মানুষকে বাঁচতে হয়। কিন্তু কর্মের মূলে রয়েছে চিন্তা চেতনা বা মনের ভাব। মানুষের প্রত্যেকটি কর্মের মূলে যেন

পজেটিভ চিন্তা থাকে। মানুষ যেন সব সময় সৎ চিন্তা করে। মানুষ যেন সবসময় নিজের সার্থের কথা চিন্তা না করে পরার্থে নিজেকে বিলিয়ে দেয়। মানুষের কোন কর্ম বা চিন্তাই যেন তার নিজের স্বার্থের জন্য না হয়। মানুষ যেন অসৎ চিন্তা থেকে দূরে থাকে। কারন মানুষের মনের প্রিত্যেকটি চিন্তাই মনের মধ্যে স্তরে স্তরে জমা হতে থাকে। আর স্তরে স্তরে জমাকৃত পজিটিভ চিন্তার সমষ্টি যদি অধিক পরিমান হয় তবেই মানুষের মনের মধ্যে আস্তে আস্তে আধ্যাত্বিকতা জাগরিত হতে শুরু করে।

২। ধ্যানঃ

আধ্যাত্বিক জাগরনের জন্য ধ্যান হচ্ছে অন্যতম শক্তিশালী পদ্ধতি। সৃষ্টির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যত মহাপুরুষ পৃথিবীতে এসেছেন তাদের জীবনী থেকে জানা

ধ্যানযায় যে তারা প্রত্যেকেই জীবনের কোন না কোন সময়ে ধ্যান সাধনা করেছেন। যেমন ইসলাম ধর্মের প্রচারক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) একটানা ১৫ বছর হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যান সাধনা করেছেন। বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারক গৌতম বুদ্ধ সারাজীবন ধ্যান সাধনা করেছেন। হিন্দু ধর্মের গীতাতে ধ্যান সাধনার উপরেই সবছেয়ে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মোট কথা আধ্যাত্বিকতা জাগরনের সবছেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হচ্ছে ধ্যান। ধ্যানের দ্বারাই মানুষ তার নিজের মধ্যে আধ্যাত্বিক জাগরন ঘটাতে পারে।

৩। নিজেকে প্রকৃতিতে বিলিন করে রাখাঃ

এমন ভাবে জীবন যাপন করা যেন জীবনে নিজের কোন ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা না থাকে। সবই যেন প্রকৃতির ইচ্ছা।প্রকৃতির ইচ্ছায় যেন আমরা বেছে আছি। আমার বাড়ী আমার গাড়ী এগুলো যেন কিছুই আমার নয়। এগুলোর প্রতি যেন আমার আধিক মায়া বা আকর্ষন না থাকে।মারেফত আমার বলতে যেন কিছুই নাই। আমি যেন অল্প কয়েকদিনের জন্য এখানে এসেছি। এভাবেই প্রকৃতির কাছে নিজেকে সোপর্দ করতে হবে।এভাবেই নিজের ইচ্ছা আকাঙ্খাকে প্রকৃতির কাছে বিলিন করে দিতে হবে, তবেই মনের মধ্যে আস্তে আস্তে আধ্যাত্বিকতা জাগরিত হবে।

৪। শ্বাস-প্রশ্বাস এর অনুসরনঃ

জন্ম লগ্ন থেকেই আমরা মনের আজান্তে প্রতিনিয়ত শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ে চলছি। এই শ্বাস প্রশ্বাস আদান প্রদান আমাদের জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে ঘটতে থাকে। শ্বাস প্রশ্বাস এর সাথে মনের ভাবের সম্পর্ক রয়েছে। আর মনের ভাবের সাথে আধ্যাত্বিকতার সম্পর্ক রয়েছে। আর যখনই শ্বাস প্রশ্বাস এর অনুসরন করবেন তখনই মন অন্য বিষয় ভাবনা থেকে বিরত হতে শুরু করবে। তখন মন আত্মমুখী হবে।মারেফত

এভাবে মনকে বাহিরের ভাবনা থেকে আত্মমুখী করে তুললে আস্তে আস্তে আধ্যাত্বিকতা জাগরিত হতে শুরু করবে। প্রশ্ন আসতে পারে এটা আপনি কখন করবেন? আপনি প্রতিদিন যে কোন সময় এটা করতে পারেন। যত বেশি করবেন তত ভালো। পারলে সারা দিনই করতে পারেন। কারন এটাতে কাজের কোন ব্যাঘাত ঘটেনা।

৫। গুরু ধ্যান

গুরু ধ্যান হলো মারেফত জাগরনের আরেকটি অন্যতম পদ্বতি। যুগ যুগ ধরে গুরু ধ্যান এর মাধ্যমে তাপসগন আধ্যাতিকতা জাগরন করে আসছেন। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে গুরু ধ্যান পদ্বতি খুবই জনপ্রিয়। বিশেষ করে ইন্ডিয়াতে এর প্রচলন সবছেয়ে বেশি। খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তি বু আলীশাহ কলন্দর, আমির খছরু নিজামুদ্দিন আউলিয়া সবাই গুরু ধ্যান এর মাধ্যমে আধ্যাতিকতার উচ্চ শিখরে আরোহন করেছিলেন। আবার মধ্যপ্রাচ্যে ও যে সব মহাপুরুষ আধ্যাতিকতার উচ্চ শিখরে পৌছেছিলেন তারা ও এ পদ্বতির মাধ্যমে উচ্চ শিখরে পৌছেছিলেন। আব্দুল কাদের জিলানী,জালাল উদ্দিন রুমি,ইমাম গাজ্জালী তাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের লালন সাঁই লিখাতে গুরুবাদ এর ধারনা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।

হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) এর জীবনী-বানী ! গরীবে নেওয়াজ এর কারামত

হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) এর জীবনী-বানী ! গরীবে নেওয়াজ এর কারামত

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী পরিচিতি ও ইতিহাস পাঠে জানা যায়, যে সকল মহান ব্যক্তির অক্লান্ত কর্ম প্রচেষ্টার ফলে বঙ্গ-ভারতে সােনালী ইসলামের নির্মল আদর্শ প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ সম্ভব হয়েছে, তাদের মধ্যে রূহানী জগতের খাটি প্রজ্ঞাদাতা সূফী কুলের শিরােমণি মর্দে মুজাহিদ হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) এর নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়।

একথা বাস্তাব সত্য যে তিনিই সাধক কুলের সম্রাট সুফীবৃন্দের গৌরব, তাপসগণের শিরমণি ইসলামী রেনেসাঁর অগ্রনায়ক হযরত মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহতার বিচিত্র জীবন কাহিনী ধ্যানােপাসনার জন্য প্রেরণাদানকারী হিসাবে আমাদের নিকট খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ইতিহাসের পাতা খুললে আমরা দেখতে পাই ইসলামের জন্য তার আত্মত্যাগ তাকে ইতিহাসের সােনালী পাতায় অবিস্মরণীয় করে রেখেছে। সত্যি কথা বলতে কি তার জীবন কাহিনী বহু কর্তি ও সাধনা সমৃদ্ধ ছিল। আলেম কুলের শিরমণি হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ সােনালী ইসলামের নির্মল আদর্শ প্রচারে বহু বাধা বিপত্তির সম্মুখিন হয়ে শেষ পর্যন্ত সফলতার স্বর্ণ শিখরে আরােহণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

ঐতিহাসিকগণ বলেন, বঙ্গ-ভারতের ইসলাম প্রচারেখাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) যে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন, তাহা ইতিহাসের পাতায় চিরকাল অম্লান হয়ে থাকবে। তাকে কেন্দ্র করে অনেক উপাখ্যান রচিত হয়েছে। পরিশেষে আমরা এইরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে সত্যের সৈনিক হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) এমন একজন আদর্শ স্থানীয় মানুষ ছিলেন যে পার্থিব ভােগ বিলাসিতা দূরের কথা কৃচ্ছ সাধনায়ই কেটে ছিল তা সারাজীবন। ইতিহাসবেত্তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে জানা যায়, আলেম কুলের শিরমণি হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ-এর হাতে অসংখ্য মুসলমান ও অমুসলমান বাইয়াত গ্রহণ করে নিজেদের জীবন ধন্য করেছেন। ( মারেফত কি এবং মারেফত কাকে বলে )

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী
খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী

জন্ম ও বংশ পরিচয় :-

 

রূহানী জগতের খাটি প্রজ্ঞাদাতা হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী সাহেবের জন্ম হয় সিস্তানের গনজর পল্লীতে। ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিকোণ থেকে জানা যায়, তার পিতা খাজা গিয়াসুদ্দীন ছিলেন একাধারে খােদাভক্ত আবেদ এবং বিত্তশালী ব্যক্তি। তিনি সর্বদা কুরান ও সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন যাপন করতে চেষ্টা করতেন। সুতরাং খাজা সাহেব বাল্যকালে অত্যন্ত যত্ন ও স্নেহের সাথে প্রতিপালিত হয়ে ছিলেন। হযরত খাজা মঈনুদ্দীন হাসান চিশতী সানজারী রহমাতুল্লাহ পবিত্র আরবের সুবিখ্যাত কুরাইশ বংশদ্ভূত হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুর নিম্নতর বংশধর ছিলেন। ইতিহাস পাঠে জানা যায়, তিনি মাতৃ বংশসূত্র ও পিতৃ বংশসূত্র উভয় দিক দিয়াই সত্যের সৈনিক শেরে খােদার সহিত ওঁতপােতভাবে জড়িত ছিলেন। সত্যের সেনানী হযরত খাজা গরীবে নেওয়াজ মঈনুদ্দীন হাসান চিশতী রহমাতুল্লাহ এর জন্ম সাল ও তারিখ সম্বন্ধেও সুসাহিত্যিক লেখকদের মধ্যে বেশ মত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। ( জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী )

১। সিয়ারুল আকতারের লেখকের মতে সত্যের অগ্রনায়ক হযরত খাজা গরীবে নেওয়াজ রহমাতুল্লাহ এর জন্মসাল হল ৫৩৭ হিজরী। তিনি বহু চিন্তা ভাবনা যুক্তি তর্ক ও বিস্তারিত আলােচনার পর তার জন্ম দিন হিসাবে ৫৩৭ হিজরী সালের ১৪ই রজব সােমবারকে মনােনয়ন করেছেন এবং তিনি, এ কথা বলেছেন যে সুফীকুলের শিরমণি ইসলামী রেনেসাঁর অগ্রনায়ক খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ উক্ত তারিখেই ধরাধামে আগমন করেছেন।

২। অন্যদিকে খাজা সাহেবের রহমাতুল্লাহ সাল ও তারিখ সম্বন্ধে প্রসিদ্ধ গ্রন্থ সজিনাতুন আসফিয়ার-এর লেখক উল্লেখ করেছেন যে, আলেম কুলের শিরমণি হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) হিজরী ৫৩০ সনের ১৪ই রজব সােমবার বােহে সাদিকের সময় এ ধরাধামে আগমন করেছেন। উক্ত আলােচনা হতে অনুধাবন করা যেতে পারে যে, উভয় লেখকই দুইটি বিষয়ে একমত এবং একটি বিষয়ে ভিন্নমত পােষণ করতেছেন। যে বিষয়দ্বয়ে তারা একমত প্রকাশ করেছেন তাহা হল ১৪ই রজব এবং সােমবার। কিন্তু সনের ক্ষেত্রে উভয় এমন মত পােষণ করেছেন যে এখন দুই মতের মধ্যে সাত বছরের ব্যবধান রয়েছে। তবে খাজা গরীব নেওয়াজ রহমাতুল্লাহ যে কোন সালেই জন্মগ্রহণ করুন না কেন, ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামী ব্যান্ডকে সমুন্নত করবার জন্য তিন যে অবদান রেখে গেছেন তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে।

ইতিহাস পাঠে জানা যায়, সৈয়দা উমমুল ওয়ারা গর্ভাবস্থায় অনেক নেক স্বপ্ন দেখেছিলেন। এমনও দেখা গেছে বহু সময় তিনি নিজের স্বপ্নের কথা সলজ্জভাবে স্বামী হযরত খাজা গিয়াসুদ্দীন রহমাতুল্লাহ এর নিকট ব্যক্ত করতেন। পূন্যবান ও বিচক্ষণ স্বামী তাকে নানাভাবে প্রবােধ দান করতেন এবং মনে মনে ভাৰী সুসন্তানের চন্দ্র মুখ দেখবার প্রত্যাশায় উৎফুল্ল হয়ে উঠতেন। | সত্যি কথা বলতে হয়, একদিন তাদের বাসগৃহে উজ্জ্বল করে রূহানী জগতের খাটি প্রদাতা সত্যের দিশারী খাজা গরীব নেওয়াজ রহমাতুল্লাহ ধরাধামে পদার্পন করেন। তার আগমনে সারা পরিবারে আনন্দের ফোয়ারা ছুটলো। ইতিহাস বেত্তারা বলেন, তার আগমনের তিন কিংবা সাত দিন পর, নবজাত শিশুর নাম রাখা হয় মঈনুদ্দীন কিন্তু বিবি উম্মু ওয়ার ও খাজা গিয়াসুদ্দীন রহমাতুল্লাহ তাকে হাসান নামেই ডাকতেন। যার কারণে ইতিহাস বেত্তারা এ জীবনীকার হাসান-শব্দটিকে তার আসল নামের সহিত সংযুক্ত করে তার নামকে মঈনুদ্দীন হাসান বলে উল্লেখ করেন।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী
খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী

বাল্য জীবনঃ

ইসলামের দিশারী সুফীসুধক হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) এর বয়স যখন সাত বৎসরে উপনিত হয়েছে, তখন হতেই তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়মিত আদায় করতেন। শুধু নামাজ আদায় করে ক্ষ্যান্ত হতেন না। এই বাচ্চা বয়সে তিনি নিয়মিত রােজা রাখতেন ও জিকিরের মজলিসে যােগ দিতেন। যদি কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কথা তার কানে আসত, শুনিমাত্রই তিনি বাধাবিপত্তি পেরিয়ে মজলিসে অংশগ্রহণ করতেন। প্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণ একটু চিন্তা করলেই অনুধাবন করতে পারবেন যে, খাজা মঈনউদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ বাল্যকালে কতদূর খােদাভীতি অর্জন করেছিলেন, যাহা নিম্নের ঘটনার দ্বারাই প্রতিফলিত হবে।

একদা তিনি স্বীয় পিতার সাথে ঈদের নামাজ পড়তে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন, এহেন সময় পথিমধ্যে এক অন্ধ ও অসহায় বালককে ময়লা ও ছেড়া কাপড় পরিধান করে নামাজ পড়তে দেখলেন। সত্যি, খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ, উহা দেখিবামাত্রই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। ইহাতে তার হৃদয়ের মনিকোঠায় এক অজানা ব্যথার উদয় হল। তিনি এ বালকের অবস্থা দেখতে দাঁড়ায়ে বহুক্ষণ চিন্তা করলেন। ইতিহাস বেত্তারা বলেন, তাপৰ পিতার অনুমতি ও নির্দেশের অপেক্ষা না করে নিজের পরিধেয় নতুন বস্ত্র খুলিয়া অন্ধ বালকটিকে পরিধান করালেন এবং হরষিত চিত্তে মহান করুণার আধার আল্লাহ জাল্লা শানুর শুকুরিয়া আদায় করলেন এবং নিঃস্ব অবস্থায় ঈদের নামাজ আদায় করে মনের হয়ে নিজ গৃহে প্রতীত্যন করলেন। হানী জগতের খাটি প্রজ্ঞাদাতা হযরত খাজা মঈনউদ্দি চিশতী রহমাতুল্লাহ এর সমুদয় কার্য কলাপই হযরত খাজা গিয়াসুদ্দীন (রাঃ) অদূরে থেকে নিরীক্ষণ করলেন, এবং মনে মনে বিশ্বনিয়ন্তা আল্লাহ রাব্দুল আলামীনের শুকর গুজারী করলেন।

উপসংহারে একথা বলা যেতে পারে যে, সূফী সাধক আলেম কুলের শিরমণি হযরত খাজা মঈনউদ্দিন চিশতী রহমাতুল্লাহ ইসলামের ইতিহাসের তথা ইতিহাসের পাতায় চির ভাস্কর হয়ে থাকবেন, তা তার বাল্যকালের প্রতিভা, চালচলন থেকেই প্রকাশ পেয়েছিল। ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে, হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী রহমাতুল্লাহ ছিলেন দুনিয়ার গছে আজম, কুতুবুল আক্তার এবং সমগ্র জিল ও ইনসানগণের পথ প্রদর্শক। তিনি যে বেলায়েতী গগনের দীপ্তিমান সূর্যস্বরূপ হবেন তা তার বাল্যকালেয় প্রতিচ্ছৰি থেকেই অনুধবন করা যেত। ইসলামের ইতহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায়, তিনি মাতৃ গর্ভ হতে তিনি অলীরূপে ভূমিষ্ট হয়েছিলেন। ( জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী )

একথা বাস্তব সত্য যে শিশুকাল হতেই তিনি অকল্পনীয় কারামত এবং ঐশী, ক্ষমাসমূহের অধিকারী ছিলেন। একথাও শুনা যায় কেবলমাত্র যখন সাত বৎসর বয়সে উপনিত হয়েছিলেন এ সময় তিনি অর্থসহ ঐশীগ্রন্থ আল কোরান হেফজ করেন। অল্প দিনের মধ্যে তিনি ইলমে হাদীস ও ইলমে ফেকাতত পান্ডিত্ব অর্জন করেন। প্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণ শুনলে অবাৰ হবেন সত্যের অগ্রনায়ক খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী রহমাতুল্লাহ মাত্র পনের বছর বয়সে এলমে তাছাউফ তত্ব সম্পর্কিত একখানা মূল্যবান গ্রন্থ তক্ত প্রণীত হয়েছিল। বাল্যকালের এসব নিদর্শন থেকেই প্রমাণ করেছিল যে তিনি ইসলামের একজন অলী হবেন।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী

ত্রিজীবন ও অধ্যবসায়ঃ

যে ব্যক্তি এলমে দ্বীন হাসিলের উদ্দেশ্যে বের হয়, ফিরে আসার পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহর পথেই থাকে।” (আল হাদীস) | খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ সেই সময়ে দ্বীন অর্জনের নিমিত্ত ঘরবাড়ী পরিত্যাগ করলেন। প্রথমে তিনি সমৱকাৰ গমন করলেন। সে সময় সমরকন্দ ও বােখরা ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র হিসাবে বিখ্যাত ছিল। বড় বড় মােহাদ্দেছ, ফকীহ, দার্শনিক ও চিন্তাশীল পণ্ডিতগণ সেখানে বাস করতেন। খাজা সাহেব প্রথমে কোরআন শরীফ হেফজ করলেন। অতঃপর তাফসীর, হাদীছ, ফেকা, ওসূল মানতেক ইত্যাদি বিষয় অধ্যায়ন করলেন। তখনকার দিনে সাধারণত মানুষের স্মৃতিশক্তি প্রখর ছিল। খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ এর স্মৃতিশক্তি ছিল তার চাইতেও প্রখর। কোরআন শরীফ হেফম করতে তার মাত্র গুটিকয়েক দিন সময় ব্যয়িত হয়েছিল। তাফসীর হাদীছ ইত্যাদি শিক্ষা করতেও তার খুব বেশি দিন লাগে নাই। বিশেষতঃ দুনিয়ার পিছনে তার কোন আকর্ষণ ছিল না বলিয়া একনিষ্ঠ ভাবে তিনি সাধনা করতে পেরেছিলেন এবং এর ফলেই শিক্ষাক্ষেত্রে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি প্রচুর দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হন। যাহেরী বিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করেও তার তৃষ্ণাতুর মনের আন-পিপাসা নিবৃত হইল না। তিনি বােখরা পরিত্যাগ করে আবার নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করলেন।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী

খাজা ওসমান হারুনী রহমাতুল্লাহ নিকট বাইয়াত গ্রহণঃ

ইসলামের ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায়; তৎকালে নিশাপুরের অধিবাসী খাজা ওসমানহারুনী ছিলেন সুফী জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র। আলেম কুলের শিরমণি যুগ সেরা তাপস। ইসলামী রেনেসাঁর অগ্রনায়ক হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ, আধ্যাত্মিক জগতের শেষ প্রান্তে পেীছার মানষে দেশ বিদেশে যােগ্য মাশায়েখ খুছতেছিলেন। যাই হােক অনেক খোজাখুজির পর শেষ পর্যন্ত যােগ্য মাশায়েক খাজা ওসমান হারুনী হমাহ কে পেয়ে অবশেষে তার নিকট মুরীদ হয়ে আধ্যাত্মিক জগতের পথকে সুগম করলেন এবং নিজেকে ধন্য করলেন।

ইতিহাস বেত্তারা বলেন, রুহানী জগতের আঁটি প্রজ্ঞাদাতা হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ আড়াই বছরকাল পীরের খেতমতে ছিলেন। কঠোর ইবাদত, রিয়াযাত ও মোরাকাবা মােশাহিদৱ মাধ্যমে তিনি বাতেনী কামালিয়াত অর্জন করে সফর শুরু করলেন। ইতিহাস বেক্তারা বলেন, প্রথমে তিনি মক্কা শরীফে উপস্থিত হয়ে হজ্জ পালন করলেন। এর পর মদিনা শরীফে নিখিল বিশ্বের ত্রাণকর্তা সুপারিশের কান্ডারী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর পবিত্র রওজা মােৰাৱক যিয়ারত করবার সময় শুনতে পাইলেন, নৰীয়ে দোজাহান হযরত মুহাম্মদ (সঃ) তাকে বলতেছেন, তোমাকে আমি হিন্দুস্থানের বেলায়েত অর্জন করতেছি। তুমি যেখানে যেয়ে সােনালী ইসলামের নির্মল আদর্শের কথা মানুষের মাঝে প্রচার কর। সত্য কথা বলতে কি, সত্যের সৈনিক হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রাঃ) যখন এই দেশে আগমন করলেন, তখন হিন্দুস্থানের প্রায় সর্বত্রই মুর্তি পূজার প্রচলন ছিল। সত্যি কথা বলতে হয় সিন্ধু বিজয়ের ফলে এই দেশে মুসলিম সভ্যতা যতটুকু প্রসার লাভ করেছিল, কালের প্রভাবে তাও বিলিন হয়ে গিয়েছিল। | খােদাদ্রোহীদের প্রতারণার জালে আবদ্ধ হয়ে এই দেশবাসী দেব দেবীর পূজায় নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন। তাদের শােচনীয় পরিনামের কথা স্মরণ করে রুহানী জগতের খাটি প্রজ্ঞাদাতা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ ভ্রান্ত মানবদিগকে সত্যিকার খোদার দিকে ফিরায়ে আনার জন্য আত্ম নিয়ােগ করলেন। ( জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) এর জীবনী )

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী

দিল্লীর প্রতিকূল অবস্থাঃ

ইতিহাস বেত্তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে জানা যায়, যে, দিল্লীর রাজা ছিলেন তখন পৃথ্বিরাজ। তারাইনের প্রথম যুদ্ধে তিনি বিপ্লবী বীর মুহাম্মদ ঘুরীর মত বাহাদুরকেও পরাজিত করেছিলেন। মুহাম্মদ ঘুরীর এই আক্রমণ সমস্ত হিন্দু দিগকে মুসলিম বিদ্বেষী করে তুলছিল। হিন্দুগণ মুসলমানদিগকে নীচ আত ও মে বলে ধারণা করত এবং তাদের কথা শুনলে চটে যেত। এহেন ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে রুহানী জগতের খাটি প্রজ্ঞাদাতা আলেম কুলের শিরমণি মর্দে মুজাহিদ খাজা সাহেব আল্লাহর শপথ নিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করে সর্বস্তরের মানুষকে গােনালী ইসলামের দিকে আহবান দিতে লাগলেন। দেশ বিদেশ হতে মানুষ তার দরবারে আসত।

মহান আল্লাহ জাল্লা শানুর অসীম কৃপায় খাজা সাহেবের সুমিষ্ট ভাষণ ও আন্তরিক রুহানিয়াতের প্রভাবে ক্রমে ক্রমে লােকেরা সত্যের দিকে ঝুকে পড়ল। তার অলৌকিক ক্ষমতা দর্শনে ও যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য শ্ৰবনে বহু গোঁড়া হিন্দু তাকে শ্রদ্ধার সৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন। প্রিয় পাঠক, পাঠিকাগণ উক্ত আলােচনা থেকেই অনুধাবন করতে পারেন যে সত্যের সৈনিক হযরত খাজা সাহেব কত উচ্চ পর্যায়ের লোক ছিলেন। একথা দিবালোকের ন্যায় সমুজল যে হযরত খাজা মঈনুদ্দীন সাধক কুলের শিরমণি ছিলেন। ইতিহাসের পাতা খুললে দেখা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বস্তরের মানুষের কিকট তিনি একজন সর্বজন মান্য ও এজাজান তাপস ব্যক্তি ছিলেন। সত্যি কথা বলতে হয় ইসলাম প্রচারে তার অবদান ছিল অবিস্বরনীয়।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী 

আজমীর গমনঃ

খাজা বাবার জীবনী ও অলৌকিক ঘটনাঃ

খাজা সাহেব তার প্রাণপ্রিয় মুরীদ খাজা কুতুবুদ্দীনকে দিল্লীতে রেখে আজমীরের দিকে রওয়ানা হলেন। খাজা সাহেব আজমীরে গমন করে যেখানে নিজ বাসভূমি স্থাপন করলেন তা ছিল হিন্দু রাজার চারণভূমি। আলেমকুলের শিৱমণি খাজা মঈনুমীন চিশতী রহমাতুল্লাহ-কে দেখে রাখালগণ বিরক্ত হলেন, শুধু বিরক্ত নয় শেষ পর্যন্ত সেইখান হতে তাকে চলে যাওয়ার জন্য বলল। প্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণ এই ভেবে দেখুন খাজা সাহেব কতদূর আল্লাহর মায়ার বান্দা ছিলেন।

সন্ধ্যার সময় রাখালগাল উটগুলাে সহাস্থানে রেখে চলে গেলেন। পরের দিন খুব ভােরে রাখালগণ এসে দেখলাে উটের চামড়া মাটির সাথে যুক্ত হয়ে আছে। এহেন অবস্থা দেখে রাখালগণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন, অগত্যা রাখালগণ সাধক কুলের শিরমণি খাজা সাহেবের পদপ্রান্তে পড়ে মাফ চাইল। মাফ চাওয়া মাত্রই দেখলাে উটগুলাে যথাস্থানে দাঁড়াইয়া রয়েছে। অল্পক্ষণের মধ্যে এই অলৌক্কি ঘটনা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। এই ঘটনার পর থেকেই তার কাছে বহু হিন্দু ইসলাম গ্রহণ করলেন।

আনা সাগরের তীরবর্তী মন্দির এর কথা সর্বজন বিদিত যে, রাজকীয় রাখালদের উৎপীড়নে সাধক কুলের শিরমণি হযরত খাজা সাহেব ঐতিহাসিক আনা সাগর তীরবর্তী ঝর্ণার নিকট আস্তানা স্থাপন করেন, তিনি সেখান থেকে ইসলাম প্রচার করে চলছেন। ইতিহাসবেত্তাদের মতে, ঐতিহাসিক আনা সাগরের দুই তীরে বহু সংখ্যক মন্দির বিদ্যমান ছিল। এখানে এসে তিনশত পূজারী পূজা করত। দেশর নামি দামি ব্যক্তিবর্গ ও রাজ পরিষদের লোকজন মাঝে মাঝে এসে এই সকল মন্দিরে পূজা করত। ইতিহাস বেত্তাদের মুখে একথাও শুনা যায় মন্দিরে প্রতিদিন তিন মন তেল খরচা হতাে। বহুদিন ধরে পূজা সাধনের কাজ নির্বিঘ্নে চলে আসছিল। একদিন সন্ধ্যার সময় পূজারীরা মধুমাখা আজানের ধ্বনি শুনতে পেয়ে জজ ফকীরের স্পর্ধা দেখে অবাক হয়ে গেল।

পূজারীগণ রাজ সিংহাসনে গিয়ে অভিযােগ করল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় অভিযোগ শুনে রাজা ক্রোধান্ধ হয়ে সেই মুহূর্তে একদল সিপাহী প্রেরণ করলেন। সত্যি কথা বলতে হয় রাজার আদেশ পেয়ে সিপাহীরা রুহানী জগতের খাটি প্রজ্ঞাদাতা হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ সাবের উপর খেপে গেল। আক্রোশ করে খ্যান্ত হলেন না, বরং খাজা সাহেবকে তাড়াইয়া দিতে উদ্যত হল। রাজকীয় সৈন্য বাহিনীয়রা সূফী কুলের শিরমণি হযরত খাজা সাহেবের নিকটবর্তী হয়ে নানা প্রকার গালাগালি বর্ষণ করতে লাগল। এদিকে সত্যের সৈনিক হযরত খাজা সাহেব আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। রাজকীয় সৈন্যবাহিনীরা যে তাকে বিভিন্ন ভাষায় গালিগালাজ দিতেছে সেদিকে মােটই তার খেয়াল ছিল না। যাই হােক খাজা সাহেব ধ্যান শেষে তাদেরকে নরমভাবে জিজ্ঞেস করলেন তােমরা কি চাও? সত্যি, তোমাদের আমি বলি তােমরা সামনে আর এক কদমও এসাে না, তাহলে তােমাদের উপর আল্লাহর গজব বর্ষিত হবে।

খাজা বাবার জীবনী ও ইতিহাস পাঠে জানা যায়, রাজকীয় বাহিনী খাজা সাহেবের এই আদেশ অমান্য করে সামনে অগ্রসর হতে লাগল। অগত্য খাজা সাহেব তাদের দিকে এক মুষ্ঠি ধূলি নিক্ষেপ করলেন। সত্যি, ধূলি নিক্ষেপ করা মাত্রই রাজকীয় বাহিনীর সৈন্যদল পাগল হয়ে চিৎকার করতে করতে পালায়ে বাঁচল। ইতিহাস বেত্তাদের কাছে একথা সুস্পষ্ট যে সৈন্য দলের কেউ অন্ধ, কেউ বধির, কেউ খঞ্জ আর কেউ মাতাল হয়ে গেলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই রাজার নিকট এই অলৌকিক কাজের কথা পৌছাল। প্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণ এখান থেকেই অনুধাবন করতে পারেন যে, সত্যের সেনানী সূফী সাধক হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী কত উচ্চ পর্যায়ের আল্লার ওলী ছিলেন।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী

গরীবে নেওয়াজ এর কারামত

রামদেব ও অজয় পালের ইসলাম গ্রহণঃ

 

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় পৃথ্বিরাজ ভাবছিলেন যে আলেমকূলের শিরমণি হযরত খাজা গরীবে নেওয়াজ একজন অসামান্য যাদুকর, এই চিন্তা ভাবনা করার পর শেষ পর্যন্ত তৎকালীন নামকরা যাদুকর রামদেব ও অজয় পালকে তলব করলেন। আর আদেশ পেয়ে তারা তড়িৎগতিতে খাজা সাহেবের নিকট হাজির হল। ঐ সময়, সাধক হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। তাদের আগমনে ধ্যান ভঙ্গ করে তাদের প্রতি জ্যোতির্ময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। একথা সর্বদা মনে রাখতে হবে হেদায়েত করার মালিক একমাত্র আল্লাহই, সত্যিই মুহূর্তের মধ্যে রামদেব ও অজয় পালের হৃদয়ে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা দেখা দিল। মহান করুণার আঁধার আল্লাহ জাল্লা শানুহুর কুদরত কে বুঝতে পারে? তাৎক্ষণিকভাবে তারা রুহানী জগতের খাটি প্রজ্ঞাদাতা হযরত খাজা সাহেবের পদপ্রন্তে লুটিয়ে পড়ল এবং ইসলামের ছায়া তলে আশ্রয় নিল । ( মারেফত কি এবং মারেফত কাকে বলে )

 

প্রিয় পাঠক পাঠিকাগণ একটু ভেবে দেখুন আল্লার অলীকে তাড়াতে এসে তারা নিজেরাই ইসলাম ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করলেন। আলেমকূলের শিমণি হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রামদেবের ইসলাম গ্রহণ করার পর তার নাম রাখলেন ‘মুহাম্মদ সাদী, অভিধান সূত্রে জানা যায়, সাদী অর্থ ভাগ্যবান। পরবর্তীতে রামদেব কামেল ওলী হিসেবে সুনাম সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। অজয় পাল ইসলাম গ্রহণ করার পর খাজা সাহেব তার নাম রাখেন আবদুল্লা বিয়ানী।

পৃথিরাজের উপর খাজা সাহেবের অভিশাপ

পৃথিরাজের উপর খাজা সাহেবের অভিশাপ ইহিহাস বেত্তারা বলেন, প্রথম তরাইনের যুদ্বে মুহাম্মদ ঘুরী পরাজিত হয়ে পুনরায় দ্বিতীয়বার যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। অতীব সত্য কথা যে, এই যুদ্ধে পৃথ্বিরাজ বিপুল সৈন্যবাহিনী নিয়ে পরাজিত ও নিহত হলেন। ইতিহাসবিদগণ ও ইসলামী জ্ঞানতাপসগণ বলেন, দ্বিতীয় তরাইনের যুদ্ধের পশ্চাতে সূফী কুলেল শিরমণি হযরত খাজা সাহেব-এর অভিশাপ খুবই কার্যকরী হয়েছিল। প্রথমতঃ সাধককুলের শিরমণি হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ সাহেব পৃথ্বিরাজকে ইসলাম গ্রহণ করবার জন্য এক চিঠিতে দাওয়াত দিয়েছিলেন। খাজা সাহেব তার মূল্যবান চিঠির মধ্যে উল্লেখ করেন যে, পৃথ্বিরাজ একথা সর্বজন বিদিত যে, মূর্তি অচেতন পদার্থ তার কোন শক্তি নেই। সে মানব জাতির কোন প্রকার উপকার করতে পারে না। মহান আল্লাহ জাল্লা শানুহ এক, অদ্বিতীয় তার কোন শরীক নেই। অতএব, তুমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সােনালী ইতিহাসের নির্মল আদর্শ অনুযায়ী জীবন গঠন কর। তোমার উপর আল্লাহর রহমতের করুণা বর্ষিত হবে।

 

খাজা সাহেবের চিঠি পেয়ে পৃথ্বিরাজ ক্রোধে উন্মাদ হয়েছিলেন। দ্বিতীয়তঃ পৃথ্বিরাজ খাজা সাহেবের এক ভক্ত মুরীদ কর্মচারীকে অন্যায়ভাবে চাকুরী হতে বরখাস্ত করায় খাজা সাহেব একথা শুনে এক টুকরাে কাগজে লিখে পাঠান “আমি তোমাকে জীবিত অবস্থায় মুসলিম সৈন্যদের হাতে সােপর্দ করলাম। প্রিয় পাঠকপাঠিকাগণ রুহানী জগতের খাটি প্রজ্ঞাদাতা খাজা সাহেবের এই অভিশাপ সত্যে পরিণত হয়েছে, তা একটু খেয়াল দিয়ে শুনুন এবং চিন্তা করে দেখুন খাজা সাহেব কতদূর আল্লাহ ওয়ালা ছিলেন।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী

চিশতীয়া তরীকা ?

 

একথা সর্বজন বিদিত যে ইলমে মারেফাতের অনেকগুলি তরীকার মধ্যে চারটি তরীকাই আসল, যথাঃ-চিশতীয়, কাদিরীয়া, নকশবন্দীয়া মুজাদ্দেদীয়া। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে জানা যায় চিশতী হিন্দুস্থানের একটি গ্রামের নাম । সাধক ‘কুলের শিরমণি সত্যের সৈনিক হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ ও তরীকার অধিকাংশ তাপসগণ এই গ্রামে অবস্থান করতেন বলে তার নামানুসারে তাদের প্রবর্তিত তৈরিকার নাম চিশতীয়া তরীকা হয়েছে। ইতিহাস, বেত্তারা বলেন, চিশতিয়া তরিকা যদিও খাজা সাহেবের আগেই প্রচলিত ছিল। কিন্তু এই তরীকার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ লাভ করে তারই সময় হতে। এই তরিকার অজিফা ও আমল অত্যন্ত সহজ ও সরল হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষ অতি সহজে এই তরীকার চর্চা ও অনুসরণ করতে সক্ষম হয়।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী

খাজা বাবার কতিপয় বিশেষ উপদেশাবলীঃ

 

বিভিন্ন সময়ে সূফী সাধক হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ নিজ শিষ্যবর্গকে যে সব মূল্যবান নসীহত প্রদান করেছেন তার তুলনা হয় না। নিম্নে তার কতিপয় নসীহত দেওয়া হলঃ

১। এলেম গভীর সাগর সাদৃশ্য, মারেফত উহার তরঙ্গ।

 

২। দান করলেই খােদায়ী নেয়ামত লাভ করা সম্ভব।

 

৩। আরেফের(কামেল লোকের) নিদর্শন এই যে, তিনি মৃত্যুকে বন্ধু মনে করেন এবং প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে তিনি খােদাকে স্মরণ করেন।’

 

৪। মুহাব্বতের নিদর্শন এই যে, বান্দা আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করবে এবং সাথে সাথে তার এ ভয়ও থাকবে যেন তার নৈকট্য হতে সে বঞ্চিত না হয়।

 

৫। পিতামাতার দিকে ভক্তিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকানও এবাদত।

 

৬। হতভাগা সেই লােক, যে নিজেকে গুণাহর কাজে লিপ্ত করে।

 

৭। পরিশ্রম ব্যতীত কোন কিছুই লাভ করা সম্ভব নয়।

৮। চার শ্রেণীর লােক খুবই ভালঃ ১মঃ যে দরবেশ সর্বদা নিজেকে ধনী মনে করে। অর্থাৎ সম্বলহীন হওয়া সত্ত্বেও যে নিজের দারিদ্র কখনও প্রকাশ করে না। ২য়ঃ যে ক্ষুধার্ত নিজেকে তৃপ্ত ভাবে, ৩য়ঃ যে চিন্তাক্লিষ্ট বিপন্ন সর্বদা হাসিমুখে থাকে, ৪র্থঃ যে লােক শত্রুর সহিত বন্ধু সুলভ আচরণ করে।

 

৯। সর্ব প্রথম যে বিষয়টি মানুষের উপর ফরয করা হয়েছে, তা হল আল্লাহর মারেফত।

 

১০। তাওবার শুরু কয়েকটি-জাহেলের সংসর্গ পরিত্যাগ করা, ভ্রান্তিদের থেকে দূরে থাকা, অবিশ্বাসীদের সান্নিধ্য পরিহার করা, খােদার প্রিয় বান্দাদের সােহবত অবলম্বন করা ও নেক কাজে মনােনিবেশ করা ।

 

১১। নেক করার চাইতে নেককারের সােহবত যত উত্তম, পাপ করার চাইতে পাপীর সােহবত তত খারাপ।

 

১২। কোরআন শরীফ, কাবাগৃহ, পিতামাতা, আলেম ও ওস্তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করা এবাদতের শামিল।

 

১৩। আরেফ(কামেল লোক) যখন নীরব থাকেন,তখন তুমি মনে করবে তিনি প্রভুর সাথে কথা বলতেছেন।

১৫। ঐ ব্যক্তি প্রকৃত দরবেশ যার কাছে এসে কোন লােক খালি হাতে ফেরত যায়না।

 

১৬। ভালবাসার প্রকৃত দাবীদার ঐ সকল লােক, যারা সর্বদা বন্ধুর কথা শুনতে ভালোবাসে।

 

১৭। সত্যিকার বন্ধু ঐ ব্যক্তি, যে বন্ধুর দেওয়া বিপদকে হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করে।

 

১৮। একজন মুসলিম ভাইকে বেইজ্জতি বা অপদস্থ করলে যত ক্ষতি হয় সারাজীবন গুনার কাজে লিপ্ত থাকলেও তত ক্ষতি হয় না। |

 

১৯। যে সকল কথা বা কাজ আল্লাহ পাক অপছন্দ করেন, বান্দাও যদি সেই সকল কাজ ও কথা ঘৃণা করতে শিখে, তবেই তার দােস্তী সে অনায়াসে লাভ করতে পারে।

 

২০। ক্ষুধার্তকে অন্নদান, অভাগ্রস্তের অভাবপূরণ ও শত্রুর সাথে সদাচরণ, চরিত্রের বিশেষ গুণ।

 

২১। ঐ ব্যক্তিই প্রকৃত প্রেমিক যার ইহলােক ও পরলােকের সকল আশা ত্যাগ করে একমাত্র মহান মাহবুব আল্লাহ তায়ালার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে।

 

২২। কোন লােক ততক্ষণ আরেফ(কামেল) হতে পারে না, যতক্ষণ না সে নিজ অস্তিত্ব একেবারে ভুলে না যায়।

 

২৩। প্রেমের পথে যে অটল থাকে, প্রেমাগ্নি তার অস্তিত্বকে বিলোপ করে দেয়।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) জীবনী

ইন্তেকাল ও দাফনঃ

একথা সর্বজন বিদিত যে মানুষ মরণশীল। জন্মিলে মরতে হয়। এ নীতির উপর ভিত্তি করে বিশ্ব নিয়ন্তা আল্লাহ রাব্দুল আলামীনের প্রিয় হাবীব নিখিল বিশ্বের ত্রাণকর্তা সুপারিশের কান্ডারী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর মত নবীও মৃত্যুর শীতল স্পর্শ হতে পরিত্রাণ পাননি। অতপর রুহানী জগতের খাটি প্রজ্ঞাপাতা হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহ ও একদিন চীর বিদায়ের ইঙ্গিত প্রাপ্ত হলেন তার মহা প্রস্থানের সময় ঘনাইয়া আসল। ইতিহাস পাঠে জানা যায়, তার মৃত্যু সম্বন্ধে কথিত আছে যে আলেমকুলের শিরমণি হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী যে রাত্রে ইহধাম ত্যাগ করেছিলেন, সেই রাত্রিতে বিশ্বনিয়ন্তা আল্লাহ রাব্দুল আলামীনের অসংখ্যক অলীআল্লাহ থাকে দেখতে পান যে সাইয়্যেদুল মুরসালিন হযরত মুহাম্মদ (সঃ) বলতেছেন মঈনুদ্দীন আল্লাহ পাকের বন্ধু । আমরা তাকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করবার জন্য আগমন করছি ।

 

ইতিহাস বেত্তরা বলেন, হিজরী ৬২৭ সালের ৬ই রজব তারিখে ইশার নামাজ আদায় করবার পর সুফী সাধক হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রাহঃ) নিজ কক্ষে ঢুকলেন এবং ভিতর হতে উক্ত কামরা বন্ধ করে দিলেন, ক্রমে ফজরের সময় হল। অতীব দুঃখের বিষয় হল প্রতিদিনের মত আর হুজুরার দরজা খুলল না। খাদেমগণ অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। পরিশেষে দরজা ভেঙ্গে দেখা গেল যে সূফী সাধক রুহানী জগতের খাটি প্রজ্ঞাদাতা হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী সাহেবের প্রাণ বায়ু শেষ হয়ে গেছে। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। খাজা সাহেবের ইহধাম ত্যাগের সংবাদ শুনে জনসাধারণ অত্যন্ত মর্মাহত হয়। দেশ বিদেশ হতে মানুষের ঢল নেমে আসল। তার জানাযার নামাজে অসংখ্য লােক শরীক হন। তার সুযােগ্য পুত্র খাজা ফখরুদ্দীন রহমতুল্লাহ জানাযার নামাজ পড়ান। তিনি যে হুজরায় মৃত্যু বরণ করেন সেই দুজরাতেই তাকে দাফন করা হয়।

আবু হামিদ আল-গাজ্জালি (রহঃ)

আবু হামিদ আল-গাজ্জালি (রহঃ)

আবু হামিদ আল-গাজ্জালীঃ ইমাম গাযালী (র)-এর নাম মুহাম্মাদ। ডাকনাম আবু হামেদ। পিতার নামও মুহাম্মাদ ছিল। তুস জেলায় ৪৫০ হিজরীতে তাহিরান নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার ওসিয়ত মুতাবেক তাঁর এক বন্ধু—যিনি একজন একনিষ্ঠ ‘ইলম-দোস্ত ও সূফী গরীব মুসলমান ছিলেন-তাঁর শিক্ষার বন্দোবস্ত করতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন এবং তাকে কোন মাদরাসায় ভর্তি হবার পরামর্শ দেন। অনন্তর তিনি একটি মাদরাসায় ভর্তি হয়ে শিক্ষা অর্জনে আত্মনিয়ােগ করেন।

ইমাম গাযালী (র) স্বদেশে শায়খ আহমাদ আর-রাযেকানীর নিকট থেকে শাফিঈ মযহাবের ফিকাহশাস্ত্রে তা’লীম হাসিল করেন। এরপর জর্দানে ইমাম আবু নসর ইসমাঈলীর নিকট পড়াশুনা করেন। এরপর নিশাপুর গিয়ে ইমামুল হারামায়নের মাদরাসায় ভর্তি হন এবং অতি অল্পদিনেই তিনি তার ৪০০ সহপাঠীর মধ্যে একটি বিশিষ্ট আসন লাভ করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর খ্যাতিমান উস্তাদের সহযােগী (নায়েব)-তে পরিণত হন, এমন কি ইমামুল-হারামায়ন তার সম্পর্ক বলতেন, “গাযালী (র) হলেন গভীর সমুদ্র।” ইমামুল-হারামায়ন-এর ইনতিকালের পর তিনি নিশাপুর থেকে বহির্গত হন। সে সময় তাঁর বয়স ছিল ২৮ বছর, অথচ তখনাে তাকে বড় বড় বর্ষীয়ান ‘উলামা’র চেয়ে অধিকতর বিশিষ্ট ও কামালিয়তের অধিকারী মনে করা হত।

এর পর ইমাম গাযালী (র) নিজামুল-মুলকের দরবারে যান। তাঁর খ্যাতি ও বিশেষ যােগ্যতার কারণে নিজামুল-মুলক তাকে অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধা সহকারে দরবারে গ্রহণ করেন। এখানে ছিল দুর্লভ রত্নসম। জ্ঞানী-গুণীদের সমাবেশ। জ্ঞানের আলােচনা ও ধর্মীয় মুনাজারা (বিতর্ক) তখনকার দরবার, মজলিস, এমন কি বিবাহানুষ্ঠান ও শােক সভারও একটি অপরিহার্য অঙ্গ ছিল। ইমাম গাযালী (র) যাবতীয় বিতর্ক আলােচনায় সকলের ওপর জয়ী হতেন। তাঁর অতুলনীয় যােগ্যতাদৃষ্টে নিজামুল-মুলক তাঁকে নিজামিয়া মাদরাসার অধ্যক্ষ হিসাবে মনােনীত করেন, যা ছিল সে যুগে একজন ‘আলিমের জন্য সম্মান ও মর্যাদার সর্বোচ্চ সােপান। সে সময় গাযালীর বয়স ৩৪ বছরের বেশী ছিল না।Imam Ghazali

৪৮৪ হিজরীতে তিনি বিরাট শান-শওকতের সঙ্গে বাগদাদে প্রবেশ করেন এবং নিজামিয়ায় পাঠ দান শুরু করেন। অল্পদিনেই তাঁর যােগ্য শিক্ষকতা, উত্তম আলােচনা ও জ্ঞানের গভীরতার কথা সারা বাগদাদে ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্র- শিক্ষক ও জ্ঞানী-গুণী তার বিদ্যাবত্তা থেকে উপকৃত হবার জন্য চতুর্দিক থেকে নিজামিয়ায় এসে ভীড় জমাতে লাগল। তার দরূস-মাহফিল গােটা মনুষ্যকুলের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়। তিন শ’র মত সমাপ্ত পর্যায়ের ছাত্র, শত শত আমীর-উমারা’ ও রঈস এতে শরীক হতেন। ক্রমে ক্রমে তার উন্নত মস্তিষ্ক ও মেধা, ইলমী ফযীলত ও শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব বাগদাদে এমন প্রভাব-প্রতিপত্তি সৃষ্টি করে যে, তিনি সাম্রাজ্যের নেতৃস্থানীয় সদস্যবর্গের সমমর্যাদা লাভ করেন।

তাঁর সম্পর্কে তাঁর সমসাময়িক শায়খ আবদুল গাফির ফারসী বলেন, “তার জাকজমক ও আড়ম্বরের সামনে আমীর-উমারা’, উযীর, এমন কি স্বয়ং দরবারে খিলাফতের শান-শওকত পর্যন্ত নিষ্প্রভ হয়ে যায়। এমনি সময়ে ৪৮৫ হিজরীতে তাকে ‘আব্বাসী খলীফা মুক ‘তাদী বিল্লাহ মালিক শাহ সালজুকীর বেগম তুর্কান খাতুনের নিকট (যিনি সে সময় সাম্রাজ্যের হর্তা-কর্তা ছিলেন) স্বীয় দূত বানিয়ে পাঠান। খলীফা মুক ‘তাদী বিল্লাহর স্থলাভিষিক্ত খলীফা মুস্তাজহির ইমাম গাযালী (র)-এর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রাখতেন এবং তার একনিষ্ঠ ভক্ত ও অনুরক্ত ছিলেন। তারই নির্দেশে ইমাম গাযালী (র) বাতেনী মতবাদের বিরুদ্বে কিতাব লিখেন এবং খলীফার সঙ্গে সম্পর্কিত করে এর নাম রাখেন ‘মুস্তাজহিরী।

এগার বছরের চলমান জীবন এবং এর অভিজ্ঞতা:

এই চরম উন্নতি ও উত্থানের স্বাভাবিক দাবি ছিল যে, ইমাম গাযালী (র) এতে তৃপ্তি লাভ করবেন এবং এই বৃত্তের মাঝেই তিনি তার গােটা জীবন কাটিয়ে দেবেন, যেমনটি তার কতক উস্তাদ করেছেন। কিন্তু তার অস্থির স্বভাব ও প্রকৃতি, উন্নত মনােবল, দুরন্ত সাহসিকতা উন্নতির এই চরম পর্যায়েও তাকে সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত রাখতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে এই উন্নত মনােবল ও হিম্মতই তাঁকে ইমাম’ ও ‘হুজ্জাতুল-ইসলাম বানিয়েছিল। দুনিয়াতে জাঁকজমক, আড়ম্বর, সম্মান ও পদবীর কুরবানী এবং স্বীয় উদ্দেশ্যের প্রতি একাগ্রতা ও সত্যের প্রতি আকর্ষণের এমন দৃষ্টান্ত বিরল। ইমাম গাযালী (র) স্বয়ং সেসব অবস্থা ও কার্যকারণ বর্ণনা করেছেন যা তাকে এমন পদক্ষেপ গ্রহণে উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং যা তাকে টেনে বের করেছিল শিক্ষা ও দরস প্রদানের কাজ থেকে। যা হােক, শেষ পর্যন্ত তিনি জ্ঞান রাজ্যের বাদশাহী ছেড়ে নিশ্চিত জ্ঞান ও ইন্দ্রিয়াতীত সম্পদের তালাশে বেরিয়ে পড়েন এবং স্বীয় লক্ষ্যে কামিয়াবী লাভ করেন। ‘Al-Munkiju Minaddalal” নামক গ্রন্থে তিনি এ সম্পর্কে লিখেছেন :- বিস্তারিত পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

To read Imam Gazzali Biography in English CLICK here

মাইজভান্ডারী জীবন কাহিনী- বানী ও কারামত

মাইজভান্ডারী জীবন কাহিনী- বানী ও কারামত

সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (রহঃ)।।।

সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (রহঃ)। মাইজভান্ডারী তরীকার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি । তিনি জন্ম গ্রহন করেন (রহঃ) বাংলা ১২৩৩ এবং ১৮২৬ সালের ১লা মাঘ মাইজভান্ডার শরীফে । তিনি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)এর বংশধর ছিলেন। তার পিতা ছিলেন সৈয়দ মতিউল্লাহ (রহঃ) এবং মাতা ছিলেন সৈয়দা খায়রুন্নেছা বিবি (রহঃ)। চার বছর বয়সে নিজ গ্রামের মক্তবে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। অতঃপর তিনি কলকাতায় চলে যান এবং ১২৬৮ হিজরি সনে তিনি কলকাতায় তার শিক্ষাজীবন শুরু করেন। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সহিত শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১২৬৯ হিজরি সালে তিনি যশোর জেলায় যান এবং সেখানে তিনি কাজী পদে যোগদান করেন। ১২৭০ হিজরিতে তিনি কাজী পদ থেকে পদত্যাগ করে কলকাতায় চলে যান এবং কলকাতায়মুন্সি বু-আলী মাদ্‌রাসার প্রধান মোদার্‌রেছের পদে নিয়োযিত হন।

মাইজভান্ডারী

শেখ সৈয়দ আবু শাহমা মুহাম্মদ ছালেহ আল কাদেরী লাহোরী (রহঃ) ছিলেন আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী(রহঃ) এর পীর। আর আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী(রহঃ) তিনি তরিকতের বড় ভাই হযরত সৈয়দ দেলাওয়ার আলী পাকবাজ (রহঃ) এঁর কাছ থেকে কুতুবিয়তের ফয়েজ অর্জন করেন। ১৮৫৭ সালে হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী তাঁর পীরে ত্বরিকতের নির্দেশে নিজ গ্রাম মাইজভান্ডারে চলে আসেন। এরপর থেকে আস্তে আস্তে মাইজভান্ডার আধ্যাত্মিক সাধক ও দোয়া প্রত্যাশীদের ভীড়ে পরিনত হয় এবং ক্রমান্বয়ে এই সাধকের বাসগৃহ মানবতার কল্যানকর এক উচ্চমার্গীয় আধ্যাত্মিক দরবারে পরিণত হয়। লোকসমাজে পরিচিতি পায় ‘মাইজভান্ডার দরবার শরীফ’ হিসেবে।

জিয়াউল হক মাইজভান্ডারীর জীবনী

গোলামুর রহমান বাবা ভান্ডারীর অলৌকিক ঘটনা বা কারামত

জিয়াউল হক মাইজভান্ডারীর ২০টি বানী

জিয়াউল হক মাইজভান্ডারীর ১৮টি বানী


 

মনসুর হাল্লাজ এর জিবনী জানতে এখানে ক্লিক করুন।