মারেফতের জ্ঞান কিভাবে অর্জন করতে হয় বা আধ্যাত্বিকতা জাগরনের পদ্বতি।
মারেফতের জ্ঞান কিভাবে অর্জন করতে হয়ঃ সৃষ্টিগত ভাবে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে মারেফত বা আধ্যাত্বিকতা লুকায়িত রয়েছে। কারন আমাদের প্রত্যেকের উৎপত্তি পরমাত্মা থেকে। আর আধ্যাত্বিকতার মুল হচ্ছে পরমাত্মা। কিন্তু মারেফত বা আধ্যাত্বিকতা সকলের মধ্যে প্রকাশ পায়না। যাদের মন যতটুকু পরিমান পরমাত্মার নিকটে অবস্থান করে ততটুকু পরিমান আধ্যাত্বিকতাই তাদের মধ্যে জাগরিত হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে পৃথিবিতে খুব অল্প সংখ্যক লোকের মনের ভাব পরমাত্বার ভাবের কাছাকাছি রয়েছে। আর যাদেরই বা কাছাকাছি রয়েছে তাও খুব অল্প ভাব। কারন মানুষের ভাবনা পরমাত্মার দিকে যেতে চায় না। মানুষ পরমাত্মার ভাবনা ভাবতে চায় না। মনুষ ভাবতে চায় না তার মূল কোথায়? সে কোথা থেকে এসেছে? তাই মানুষ তার মূল পরমাত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ফলে তাদের মনে আধ্যাত্বিকতাও জাগ্রত হয় না।
মোটকথা যে যতটূকু পরমাত্মার সাথে বা সৃষ্টির মুলের সাথে সংযুক্ত রয়েছে তার ততটুকু আধ্যাত্বিকতা রয়েছে। আর আমাদের সাথে পরমাত্মার বা সৃষ্টির মূলের সম্পৃক্ততা নেই বলে আমাদের আধ্যাত্বিক জাগরনও হয় না।
আর কারো খুব অল্প আকারে মারেফতের জ্ঞান বা আধ্যাত্বিকতা জাগরিত হয়। আবার কারো একটু বেশি জাগ্রত হয়। তবে চুরান্ত পর্যায়ে জাগ্রত হয় কেবল মহাপুরুষদের মাঝে। আর এই পৃতিবীতে মহাপুরুষ বড়ই দুর্লভ। তবে যার মধ্যে যতটুকু মারেফতের জ্ঞান বা আধ্যাত্বিকতা জাগরিত হয় ততটুকুকে লালন করে আস্তে আস্তে আধ্যাত্বিকতা বাড়াতে হয়। কারন আধ্যাত্বিকতা জাগরন কোন সাধারন বিষয় নয়। এটা সৃষ্টিগত ভাবে মনের মধ্যে থাকতে হয়। আর সৃষ্টিগত ভাবে মনের মধ্যে না থাকলে এটা জাগানো সম্ভব নয়।
উপরে উল্লেখিত কথাগুলি সকলের জন্য প্রযোজ্য নয়। এটা শুধু উচু স্তরের সাধকদের বেলায় প্রযোজ্য। কারন আধ্যাত্বিকতার চুরান্ত পর্যায়ে পৌছার অনুভুতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এটা বর্ণনা দেওয়াও সম্ভব নয়। যে ঐ স্তরে পৌছেছে কেবল সেই তা বুঝতে পারবে। এই জন্য আধ্যাত্বিক মহাপুরুষ জালাল উদ্দিন রুমি (রহ) বলেছেন, যদি সূর্য পৃ্থিবীর কাছে চলে আসে পৃথিবী তা সহ্য করতে পারবে না। পৃথিবী জ্বলে পুরে ছারকার হয়ে যাবে। সেই রুপ ভাবে মানুষের হৃদয়ে যদি হঠাৎ উচু স্তরের আধ্যাত্বিকতা প্রকাশ পায় তাহলে মানুষ সহ্য করতে পারবেনা। মানুষের হৃদয় জ্বলে পুরে ছারকার হয়ে যাবে।
উপরের কথাগুলি এইজন্য বললাম যে, আমরা আধ্যাত্বিকতার অল্প অনুভুতি পেয়েই মনে করি যে, এটাই বুঝি আধ্যাত্বিকতার পরিপক্কতা। না এটা মোটেই না। এটা আধ্যাত্বিকতার ছুয়া মাত্র। আমি আগেই বলেছি পূর্ণ আধ্যাত্বিকতা কোন সাধারন বিষয় নয়। পবিত্র মহাগ্রন্থ গীতাতে বলা হয়েছে, সাধুকুলে জন্ম লাভ করা দুর্লভ জনম। অর্থাৎ একজন আধ্যাত্বিক মহাপুরুষের সংস্পর্শে থাকাই দুর্লভ বা পরম সৌভাগ্যের বিষয়। তাহলে পুর্ন আধ্যাত্বিকতা লাভ করা যে কত বড় দুর্লভ বিষয় তা একটু ভেবে দেখুন।
তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমাদের হৃদয়ে আধ্যাত্বিকতা যদি জাগরিত নাও হয় তবুও বার বার শ্রেষ্টা করা উচিত। কারন জাগ্রত করার শ্রেষ্টা করাও পরম সৌভাগ্যের বিষয়। পৃথিবীতে কয়জনই বা এর শ্রেষ্টা করে।
মারেফতের জ্ঞান বা আধ্যাত্বিকতা জাগরনের পদ্ধতি এবং মারেফত কিভাবে অর্জন করতে হয়।
১। পজেটিভ চিন্তা চেতনাঃ
মানুষ কর্মমুখী। কর্ম করেই মানুষকে বাঁচতে হয়। কিন্তু কর্মের মূলে রয়েছে চিন্তা চেতনা বা মনের ভাব। মানুষের প্রত্যেকটি কর্মের মূলে যেন
পজেটিভ চিন্তা থাকে। মানুষ যেন সব সময় সৎ চিন্তা করে। মানুষ যেন সবসময় নিজের সার্থের কথা চিন্তা না করে পরার্থে নিজেকে বিলিয়ে দেয়। মানুষের কোন কর্ম বা চিন্তাই যেন তার নিজের স্বার্থের জন্য না হয়। মানুষ যেন অসৎ চিন্তা থেকে দূরে থাকে। কারন মানুষের মনের প্রিত্যেকটি চিন্তাই মনের মধ্যে স্তরে স্তরে জমা হতে থাকে। আর স্তরে স্তরে জমাকৃত পজিটিভ চিন্তার সমষ্টি যদি অধিক পরিমান হয় তবেই মানুষের মনের মধ্যে আস্তে আস্তে আধ্যাত্বিকতা জাগরিত হতে শুরু করে।
২। ধ্যানঃ
আধ্যাত্বিক জাগরনের জন্য ধ্যান হচ্ছে অন্যতম শক্তিশালী পদ্ধতি। সৃষ্টির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যত মহাপুরুষ পৃথিবীতে এসেছেন তাদের জীবনী থেকে জানা
যায় যে তারা প্রত্যেকেই জীবনের কোন না কোন সময়ে ধ্যান সাধনা করেছেন। যেমন ইসলাম ধর্মের প্রচারক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) একটানা ১৫ বছর হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যান সাধনা করেছেন। বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারক গৌতম বুদ্ধ সারাজীবন ধ্যান সাধনা করেছেন। হিন্দু ধর্মের গীতাতে ধ্যান সাধনার উপরেই সবছেয়ে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মোট কথা আধ্যাত্বিকতা জাগরনের সবছেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হচ্ছে ধ্যান। ধ্যানের দ্বারাই মানুষ তার নিজের মধ্যে আধ্যাত্বিক জাগরন ঘটাতে পারে।
৩। নিজেকে প্রকৃতিতে বিলিন করে রাখাঃ
এমন ভাবে জীবন যাপন করা যেন জীবনে নিজের কোন ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা না থাকে। সবই যেন প্রকৃতির ইচ্ছা।প্রকৃতির ইচ্ছায় যেন আমরা বেছে আছি। আমার বাড়ী আমার গাড়ী এগুলো যেন কিছুই আমার নয়। এগুলোর প্রতি যেন আমার আধিক মায়া বা আকর্ষন না থাকে। আমার বলতে যেন কিছুই নাই। আমি যেন অল্প কয়েকদিনের জন্য এখানে এসেছি। এভাবেই প্রকৃতির কাছে নিজেকে সোপর্দ করতে হবে।এভাবেই নিজের ইচ্ছা আকাঙ্খাকে প্রকৃতির কাছে বিলিন করে দিতে হবে, তবেই মনের মধ্যে আস্তে আস্তে আধ্যাত্বিকতা জাগরিত হবে।
৪। শ্বাস-প্রশ্বাস এর অনুসরনঃ
জন্ম লগ্ন থেকেই আমরা মনের আজান্তে প্রতিনিয়ত শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ে চলছি। এই শ্বাস প্রশ্বাস আদান প্রদান আমাদের জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে ঘটতে থাকে। শ্বাস প্রশ্বাস এর সাথে মনের ভাবের সম্পর্ক রয়েছে। আর মনের ভাবের সাথে আধ্যাত্বিকতার সম্পর্ক রয়েছে। আর যখনই শ্বাস প্রশ্বাস এর অনুসরন করবেন তখনই মন অন্য বিষয় ভাবনা থেকে বিরত হতে শুরু করবে। তখন মন আত্মমুখী হবে।
এভাবে মনকে বাহিরের ভাবনা থেকে আত্মমুখী করে তুললে আস্তে আস্তে আধ্যাত্বিকতা জাগরিত হতে শুরু করবে। প্রশ্ন আসতে পারে এটা আপনি কখন করবেন? আপনি প্রতিদিন যে কোন সময় এটা করতে পারেন। যত বেশি করবেন তত ভালো। পারলে সারা দিনই করতে পারেন। কারন এটাতে কাজের কোন ব্যাঘাত ঘটেনা।
৫। গুরু ধ্যান
গুরু ধ্যান হলো মারেফত জাগরনের আরেকটি অন্যতম পদ্বতি। যুগ যুগ ধরে গুরু ধ্যান এর মাধ্যমে তাপসগন আধ্যাতিকতা জাগরন করে আসছেন। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে গুরু ধ্যান পদ্বতি খুবই জনপ্রিয়। বিশেষ করে ইন্ডিয়াতে এর প্রচলন সবছেয়ে বেশি। খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তি বু আলীশাহ কলন্দর, আমির খছরু নিজামুদ্দিন আউলিয়া সবাই গুরু ধ্যান এর মাধ্যমে আধ্যাতিকতার উচ্চ শিখরে আরোহন করেছিলেন। আবার মধ্যপ্রাচ্যে ও যে সব মহাপুরুষ আধ্যাতিকতার উচ্চ শিখরে পৌছেছিলেন তারা ও এ পদ্বতির মাধ্যমে উচ্চ শিখরে পৌছেছিলেন। আব্দুল কাদের জিলানী,জালাল উদ্দিন রুমি,ইমাম গাজ্জালী তাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের লালন সাঁই লিখাতে গুরুবাদ এর ধারনা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।