মারেফত কি এবং মারেফত কাকে বলে। ইলমে মারিফত জাগরনের পদ্ধতি।
মারেফত কি?
মারেফত হলো উপলব্দি জ্ঞান যা হৃদয় দ্বারা উপলব্দি করতে হয়। প্রত্যেক জিনিস বা প্রত্যেক কর্মের দুটি দিক রয়েছে, একটি হলো বাহ্যিক বা স্থুল আর অপরটি হলো অভ্যন্তরিন বা সূক্ষ। স্থুল জ্ঞান দিয়ে বাহ্যিক অনেক কিছুই আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু স্থুল জ্ঞান দিয়ে সূক্ষ বিষয় উপলব্দি করা যায় না। সূক্ষ জ্ঞান দিয়ে সূক্ষ বিষয় উপব্দি করতে হয়। আর মারেফত উপলব্দি করতে হলে সূক্ষ জ্ঞান দরকার।
অন্যভাবে বলতে গেলে বলা যায়, প্রত্যেক জিনিসের বা কর্মের মূল লক্ষ্য বা তাৎপর্য রয়েছে। মারেফত হলো কোন বিষয়ের তাৎপর্য জ্ঞান যা সূক্ষ উপলব্দি ক্ষমতা দ্বারা বুঝতে হয়।
সুতরাং মারেফত হলো সূক্ষ জ্ঞান, উপলব্দি জ্ঞান। এটা বর্ননা দিয়ে বুঝানোর বিষয় নয়, হৃদয় দিয়ে উপলব্দি করার বিষয়।
মারেফত নিয়ে মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি (রহঃ) এর মন্তব্য-
মারিফত নিয়ে বিখ্যাত আধ্যাত্বিক মহাপুরুষ জালালুদ্দিন রুমি (রহঃ) তার বিখ্যাত গ্রন্থ মসনবী শরীফ এ কিছু কথা লিখেছেন। নিম্নে তা হুবহু তুলে ধরলাম।
চুঁ বছুরাত্ বেংগরী চশমাত দো আস্ত,
তু ব নূরাশ দর্ নেগার কানে এক্ তু আস্ত।
লা জেরা মচুঁ বর একে উফ্তাদ নজর,
আঁ একে বীনি দো না আইয়াদ দর্ বছর।
নূরে হর দো চশ্মে না তাওয়াঁ ফরকে করদ,
চুঁকে দর নূরাশ নজরে আন্দাখতে মর্দ।
উ চেরাগ আর হাজের্ আইয়াদ দর্ মকান,
হরি একে বাশদ্ বছুরাতে জেদ্দে আঁ।
ফরকে না তাওয়াঁ করদ নূরে হরি একে,
চুঁ ব নূরাশ রুয়ে আরী বে শকে।
উত্লুবুল মায়ানী মিনাল ফরকানে কুল।
লা নু ফাররেকু বাইনা আহাদেম্ মের রুছুল
গার তু ছাদ ছীবো ও ছদাই ব শুমারী,
ছাদ নুমাইয়াদ এক বুদ্ চুঁ ব ফেশারী
দর মায়ানী কেছমতে ও আদাদে নীস্ত,
দর মায়ানী তাজ্ জীয়া ও আফরাদে নীস্ত।
অর্থ: মাওলানা বলেন, ” আমি এই মারেফাত সম্বন্ধে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করিতাম, কিন্তু ভয় করি যে, কাহারও অন্তঃকরণ বিগ্ড়াইয়া না যায়। অত্যন্ত সূক্ষ্ম রহস্য। ফালাদ লোহার তরবারীর ন্যায় অত্যন্ত ধারাল। যদি তোমার নিকট ঢাল না থাকে, তবে পিছনে হটিয়া যাওয়াই উত্তম। এত সূক্ষ্মও তীক্ষ্ণ বিষয় ঢাল ব্যতীত আলোচনা করিতে অগ্রসর হওয়া উচিত না। কেননা, তরবারী কাটিতে কখনও লজ্জা বোধ করে না। এই রকমভাবে এই তীক্ষ্ম বিষয় যখন ভ্রান্ত ধারণার অন্তঃকরণে পতিত হইবে, তখন তাহার ঈমান নষ্ট হইয়া যাইবে। এইজন্য আমি আমার তরবারী কোষাবদ্ধ করিয়া রাখিলাম। তাহা হইলে কোনো তেড়া বুঝের লোক বিপদে পড়িবে না।”
মারেফত নিয়ে বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) এর মন্তব্য-
মারেফত এর সাথে সৃষ্টির মুলের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তাই আধ্যাত্বিক ব্যাক্তিত্ব আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) তার সিররুল আসরার গ্রন্থে লিখেছেন, সৃষ্টির মুলে (হাকিকতে) পৌছতে হলে মারেফতের জ্ঞান অপরিহার্য। মারেফতের জ্ঞান ছাড়া লক্ষ্যস্থলে পৌছানো সম্ভব নয়।
অর্থাৎ মানব জনমের উদ্দ্যেশ্য হলো পুন্য কর্ম দ্বারা লক্ষ্যস্থলে হাকিকতে পৌছা। হাকিকতের চরম লক্ষ্যস্থলে পৌছতে হলে মারেফত বা আধ্যাত্বিকতার মধ্যদিয়ে পৌছাতে হয়। আধ্যাত্বিকতা বা মারেফত ছাড়া হাকিকতে পৌছার আর কোন রাস্থা পৃথিবীতে নেই। আর পৃথিবীতে যত মত পথ ধর্ম এবং এবাদত রয়েছে প্রত্যেকেরই লক্ষ্য উদ্দ্যেশ্য হলো হাকিকতে পৌছা। কারন জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আমরা সকলেই হাকিকতের কেন্দ্রবিন্দু আলমে আরওয়াহ থেকে এসেছি। আর যেখান থেকে এসেছি সেখানে ফিরে যাওয়াই মানুষ্য জনমের একমাত্র লক্ষ্য উদ্দেশ্য।
এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত আধ্যাত্বিক মহাপুরুষ জালাল উদ্দিন রুমি (রহঃ) তার বিখ্যাত মসনবী শরীফে লিখেছেন, ” মাওলানা বলেন, আমরা আলমে আরওয়াহ্র (রূহের জগতের) মধ্যে একই পদার্থ ছিলাম; সেখানে কোনো ভাগাভাগি ছিল না, আর কোনো সংখ্যাও ছিল না। সেখানে আমাদের দেহের কোনো অস্তিত্ব-ই ছিলনা। সূর্যের ন্যায় একই আলো জ্বলিতেছিল। পানির মত স্বচ্ছ পদার্থ ছিলাম। যখন খাটিঁ নূর ইহ-জগতে দেহরূপ ধারণ করিয়া আসিল, তখন বিভিন্নরূপ ধারণ করিয়া সংখ্যায় পরিণত হইল। প্রত্যেক দেহের সাথে রূহের সম্বন্ধ স্থাপিত হইল। যেমন পাথরের কণায় সূর্যের কিরণ পতিত হইলে প্রত্যেক কণায় পৃথক পৃথক আলো দেখায়, সেইরূপ আমাদের দেহে রূহের আলো আসিয়া পৃথকভাবে সংখ্যায় পরিণত করিয়াছে।।” অর্থাৎ আমরা আলমে আরওয়াহ বা স্রষ্টার অখন্ড সত্ত্বা থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে সৃষ্টি হয়ে এসেছি। তখন আমাদের প্রতিজ্ঞা ছিলো স্রষ্টাকে সর্বক্ষন মনে রাখব। এক মুহুর্তের জন্য স্রষ্টাকে ভুলবনা। জগতে এসে যে কোন কাজই করিনা কেন এক মুহুর্তও স্রষ্টার স্বরন ছাড়া থাকবনা। কিন্তু বিষয়টা ঘটলো উল্টও। আমরা প্রতি মুহুর্তই স্রষ্টাকে ভুলিয়া রইলাম। এর পর স্রষ্টা আমাদের জন্য একের পর এক ধর্ম গ্রন্থ প্রেরন করতে থাকলেন এবং প্রত্যেক ধর্ম গ্রন্থে এবাদতের বিভিন্ন নিয়ম বেধে দিলেন যাতে করে কমপক্ষে এবাদতের সময়টাতে তাকে স্বরন করা যায়। কিন্তু হায়! দুঃখের বিষয় মানুষ সারাদিন তাকে স্বরন করবে তো দুরের কথা অল্প সময়ের জন্য শরীয়তি বা বাহ্যিক এবাদতের সময়ও মানুষের মন সৃষ্টিকর্তার স্বরন ধরে রাখতে পারেনা। মানুষের মন ছুটে বেড়ায় দুনিয়াবি নানা কাজ কর্মে। মানুষের এবাদত হয়ে যায় অন্তঃস্বারশুন্য একটা পদ্বতি মাত্র। অর্থাৎ মানুষ এবাদতের নামে শুধুমাত্র অন্তঃস্বারশুন্য কিছু পদ্বতি পালন করে চলছে।
মারেফতের বা আধ্যাত্বিকতার সংজ্ঞা
আধ্যাত্বিকতাকে অল্প কথায় সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। কারন আধ্যাত্বিকতার মুলের সাথে রয়েছে সৃষ্টির মুলের গভীর সম্পর্ক। যেখানে আধ্যাত্বিকতার প্রকাশ রয়েছে বুঝতে হবে এটা সৃষ্টির মুলেরই প্রকাশ। অর্থাৎ আধ্যাত্বিকতা যেখান থেকে উৎপত্তি এই ভ্রম্মান্ড সেখান থেকই উৎপত্তি। আর কেউ যদি এই আধ্যাত্বিকতার চরম সীমায় পৌছতে পারে তবে সে সৃষ্টির আদি অন্ত সব জানতে পারে এবং সমগ্র সৃষ্টি নিয়ন্ত্রন সে করতে পারে।
মারেফত বা আধ্যাত্বিকতার সীমানা বা শেষ কোথায়?
আর যখন কেউ আধ্যাত্বিকতার শেষ সীমানায় পৌছে যায় তখন তার দুনিয়ার প্রতি আর আকর্ষন থাকেনা। তার মাঝে দুনিয়ার আর কোন কামনা বাসনা থাকেনা। তার মন শিশুর মত নির্মল ও পবিত্র হয়ে যায়। তখন সে দেখতে পায় দুনিয়ার সমস্ত সৃষ্টি তার অধিনে রয়েছে। তখন তার মনে বিন্দুমাত্র ইচ্ছা থাকেনা সৃষ্টিকে পরিবর্তন করার। এই জন্য বলা হয় যাদের মাঝে বিন্দুমাত্র দুনিয়ার ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা রয়েছে তারা আধ্যাত্বিকতার শেষ সিমানায় পৌছতে পারেনা।
আধ্যাত্বিকতার সীমানা যে কত প্রসারিত তা আমাদের ধারনারও বাহিরে। কারন আধ্যাত্বিকতার সীমানার কাছে আমাদের জ্ঞান খুবই নগন্য। আমাদের এই ক্ষুদ্র জ্ঞান দিয়ে আধ্যাত্বিকতার পরিধি বিশ্লেষন করা আসাধ্য বিষয়। যারা আধ্যাত্বিকতায় পরিপুর্নতা লাভ করেছে কেবল তারাই এর মর্ম বুঝতে পারবে। আধ্যাত্বিকতা ভাষায় বর্ননা দিয়ে বুঝানো যায়না। এটা বুঝতে হলে প্রখর অনুভুতি শক্তি থাকা চাই। কারন অনুভুতির মাধ্যমে এটা উপলব্দি করতে হয়। বিখ্যাত আধ্যাত্বিক মহাপুরুষ জালাল উদ্দিন রুমি বলেছেন,যদি সুর্য পৃথিবীর কাছে চলে আসে তবে পৃথিবী জ্বলে পুরে ছার কার হয়ে যাবে। অনুরুপভাবে কারো হৃদয়ে যদি হঠাত আধ্যাত্বিকতা প্রকাশ পায় তবে তার হৃদয় জ্বলে পুরে যাবে।
উপরেরর কথাগুলি গভীর উচ্চমার্গের কথা। সচরাচর আমরা আধ্যাত্বিকতা নিয়ে এত গভীরে ভাবিনা। কারন জগতের বড় বড় আধ্যাত্বিক লোক সম্পর্কে আমরা খুজ খবর রাখিনা এবং তাদের জীবনে আধ্যাত্বিকতা অর্জন করতে গিয়ে কত ধাপ অতিক্রম করেছেন তা আমরা জানতে চাই না। নিজের মধ্যে আধ্যাত্বিকতার অল্প ছুয়াতে আমরা মনে করি আমরা আধ্যাত্বিক হয়ে গেছি।
এমন কি কোন লোকের মধ্যে যদি অলৌকিকতা বা বিরাট কারামতি ও প্রকাশ পায় তবুও বুঝতে হবে এগুলো আধ্যাতিকতার শেষ সীমানার তুলনায় খুবই নগন্য। তবে অলৌকিকতা প্রকাশ হওয়া এটাও কোন সাধারন বিষয় নয়। অলৌকিকতা বা কারামত প্রকাশ কেবল উচ্চপর্যায়ের আধ্যাত্বিক মহাপুরুষদের বেলায় হয়ে থাকে।
মারেফত বা আধ্যাত্বিকতা এবং পুর্ন বা চরম আধ্যাত্বিকতা
আমিও একসময় এই ভুলের মধ্যে ছিলাম। আমি ২০০৭ সালের ২৭ শে মার্চ থেকে ধ্যান সাধনা শুরু করেছিলাম। প্রথম বছর ধ্যান করার পর আমার মধ্যে প্রচুর শারীরীক ও মানষিক পরিবর্তন লক্ষ্য করি। হৃদয়ে ও অনুভুতির বিরাট পরিবর্তন হওয়ার ফলে আমি ভাবতে শুরু করেছিলাম আমি বিরাট আধ্যাত্বিক লোক হয়ে গেছি। আমি বর্তমানে ২০২১ সালে এসেও আমার ধ্যান সাধনা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু ধ্যান সাধনা করতে করতে বর্তমানে ২০২১ সালে এসে যতই ধ্যানের গভীরে পৌছতে থাকি ততই বুঝতে পারি যে আধ্যাত্বিকতার শেষ সীমানায় পৌছা একটা দুর্লভ বিষয়।
বর্তমানে আমি কোন পর্যায়ে এসে এসব কথা বলতেছি আমার শরীরের লক্ষন সম্পর্কে কিছুটা বর্ননা দিলে যারা আধ্যাত্বিকতা সম্পর্কে বুঝে তারা কিছুটা বুঝতে পারবে। আপনারা হয়ত বিখ্যাত আধ্যাত্বিক মহাপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ ও ফকির লালন সাঁই এর কথা শুনেছেন। তাদের লেখনিতে আধ্যাত্বিকতা নিয়ে গভীর তত্ব পাওয়া যায়। স্বামী বিবেকানন্দের লিখা রাজযোগ গ্রন্থতে তিনি লিখেছেন ধ্যান সাধনার কোন এক পর্যায়ে এসে মানব শরীরে কুরুকুন্ডলী জাগ্রত হয়। আমি ধ্যান সাধনা শুরু করার এক বছর পরে আমার দেহে কুরুকুন্ডলি জাগ্রত হয়ে গিয়েছিল। তখন কুরুকুন্ডলী শব্দের সঙ্গে আমার কোন পরিচয় ছিলনা। কুরুকুন্ডলী জাগার অনেক দিন পরে যখন আমি রাযযোগ বইটা পড়েছি তখন বুঝতে পেরেছি এটার নাম কুরুকুণ্ডলী। আর ধ্যান সাধনা শুরু করার অনেক দিন পর যখন মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি (রহঃ) এর মসনবী শরীফ পড়লাম তখন দেখলাম, মোরাকাবা মোশাহেদার (ধ্যান) কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন,” মোরাকাবার প্রথম অবস্থায় অসুস্থতা অনুভব করলেও এতে ভয় পাওয়ার কারন নাই।
ধ্যান সাধনা ও কুরুকুন্ডলী জাগরন
কুরুকুণ্ডলী জাগার পরে মেরুদন্ডের নিচ থেকে উপরের দিকে যে এক প্রশান্তির ধারা বইতে থাকে তা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। যত একা থাকবেন প্রশান্তির ধারা তত আধিক পরিমানে বাড়তে থাকবে। তাই আমি ২০০৬ সালের ২৭ শে মার্চের পর থেকে ২০২১ অবধি পর্যন্ত আমি একা থাকতে খুবই পছন্দ করি এবং বেশির ভাগ সময়ে একাই থাকি।
কুরুকুন্ডলী হলো এমন একটি শক্তি যা মেরুদণ্ডের গুরা থেকে উৎপন্ন হয়। বড় বড় আধ্যাত্বিক মহাপুরুষদের ভাষায় পৃথিবীতে গোটা কয়েক সৌভাগ্যবান মানুষের মধ্যে কুরুকুণ্ডলী জাগ্রত হয়। কুরুকুণ্ডলী জাগ্রত হওয়ার পর শরীরে ভিতরে আরও কত লক্ষন যে প্রকাশ পায় তা বলার বাহিরে। যাইহোক বড় বড় আধ্যাত্বিক লোকদের শাস্ত্র পড়ে জানা যায় যে কুরুকুণ্ডলী দেহের মধ্যে জাগরিত হওয়া সাধারন বিষয় নয়। খুব অল্প লোকের মধ্যেই এগুলা প্রকাশ পায়। আর এই দীর্ঘ সময় ধ্যান সাধনা করার পর যখন আমি উপলব্দি করার চেষ্টা করলাম আধ্যাত্বিকতার শেষ কোথায় তখন আমি বোবা হয়ে গেলাম। এতদিন পর আমি বুঝতে পাড়লাম আধ্যাত্বিকতার যাত্রা শুরু করলাম মাত্র।
সুতরাং পুর্ন আধ্যাত্বিকতা অর্জন করা যে কত বড় কঠিন কাজ আমরা কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছি। আধ্যাত্বিকতা অর্জন করতে হলে দীর্ঘ সময় কঠিন পরিশ্রম করতে হবে।
ডাঃ শাহীনুর আহমেদ চৌধুরী (আধ্যাত্বিক সাধক)
মারেফতের জ্ঞান কিভাবে অর্জন করতে হয় বা আধ্যাত্বিকতা জাগরনের পদ্বতি।
মারেফতের জ্ঞান কিভাবে অর্জন করতে হয়ঃ সৃষ্টিগত ভাবে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে মারেফত বা আধ্যাত্বিকতা লুকায়িত রয়েছে। কারন আমাদের প্রত্যেকের উৎপত্তি পরমাত্মা থেকে। আর আধ্যাত্বিকতার মুল হচ্ছে পরমাত্মা। কিন্তু মারেফত বা আধ্যাত্বিকতা সকলের মধ্যে প্রকাশ পায়না। যাদের মন যতটুকু পরিমান পরমাত্মার নিকটে অবস্থান করে ততটুকু পরিমান আধ্যাত্বিকতাই তাদের মধ্যে জাগরিত হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে পৃথিবিতে খুব অল্প সংখ্যক লোকের মনের ভাব পরমাত্বার ভাবের কাছাকাছি রয়েছে। আর যাদেরই বা কাছাকাছি রয়েছে তাও খুব অল্প ভাব। কারন মানুষের ভাবনা পরমাত্মার দিকে যেতে চায় না। মানুষ পরমাত্মার ভাবনা ভাবতে চায় না। মনুষ ভাবতে চায় না তার মূল কোথায়? সে কোথা থেকে এসেছে? তাই মানুষ তার মূল পরমাত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ফলে তাদের মনে আধ্যাত্বিকতাও জাগ্রত হয় না।
মোটকথা যে যতটূকু পরমাত্মার সাথে বা সৃষ্টির মুলের সাথে সংযুক্ত রয়েছে তার ততটুকু আধ্যাত্বিকতা রয়েছে। আর আমাদের সাথে পরমাত্মার বা সৃষ্টির মূলের সম্পৃক্ততা নেই বলে আমাদের আধ্যাত্বিক জাগরনও হয় না।
আর কারো খুব অল্প আকারে মারেফতের জ্ঞান বা আধ্যাত্বিকতা জাগরিত হয়। আবার কারো একটু বেশি জাগ্রত হয়। তবে চুরান্ত পর্যায়ে জাগ্রত হয় কেবল মহাপুরুষদের মাঝে। আর এই পৃতিবীতে মহাপুরুষ বড়ই দুর্লভ। তবে যার মধ্যে যতটুকু মারেফতের জ্ঞান বা আধ্যাত্বিকতা জাগরিত হয় ততটুকুকে লালন করে আস্তে আস্তে আধ্যাত্বিকতা বাড়াতে হয়। কারন আধ্যাত্বিকতা জাগরন কোন সাধারন বিষয় নয়। এটা সৃষ্টিগত ভাবে মনের মধ্যে থাকতে হয়। আর সৃষ্টিগত ভাবে মনের মধ্যে না থাকলে এটা জাগানো সম্ভব নয়।
উপরে উল্লেখিত কথাগুলি সকলের জন্য প্রযোজ্য নয়। এটা শুধু উচু স্তরের সাধকদের বেলায় প্রযোজ্য। কারন আধ্যাত্বিকতার চুরান্ত পর্যায়ে পৌছার অনুভুতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এটা বর্ণনা দেওয়াও সম্ভব নয়। যে ঐ স্তরে পৌছেছে কেবল সেই তা বুঝতে পারবে। এই জন্য আধ্যাত্বিক মহাপুরুষ জালাল উদ্দিন রুমি (রহ) বলেছেন, যদি সূর্য পৃ্থিবীর কাছে চলে আসে পৃথিবী তা সহ্য করতে পারবে না। পৃথিবী জ্বলে পুরে ছারকার হয়ে যাবে। সেই রুপ ভাবে মানুষের হৃদয়ে যদি হঠাৎ উচু স্তরের আধ্যাত্বিকতা প্রকাশ পায় তাহলে মানুষ সহ্য করতে পারবেনা। মানুষের হৃদয় জ্বলে পুরে ছারকার হয়ে যাবে।
উপরের কথাগুলি এইজন্য বললাম যে, আমরা আধ্যাত্বিকতার অল্প অনুভুতি পেয়েই মনে করি যে, এটাই বুঝি আধ্যাত্বিকতার পরিপক্কতা। না এটা মোটেই না। এটা আধ্যাত্বিকতার ছুয়া মাত্র। আমি আগেই বলেছি পূর্ণ আধ্যাত্বিকতা কোন সাধারন বিষয় নয়। পবিত্র মহাগ্রন্থ গীতাতে বলা হয়েছে, সাধুকুলে জন্ম লাভ করা দুর্লভ জনম। অর্থাৎ একজন আধ্যাত্বিক মহাপুরুষের সংস্পর্শে থাকাই দুর্লভ বা পরম সৌভাগ্যের বিষয়। তাহলে পুর্ন আধ্যাত্বিকতা লাভ করা যে কত বড় দুর্লভ বিষয় তা একটু ভেবে দেখুন।
তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমাদের হৃদয়ে আধ্যাত্বিকতা যদি জাগরিত নাও হয় তবুও বার বার শ্রেষ্টা করা উচিত। কারন জাগ্রত করার শ্রেষ্টা করাও পরম সৌভাগ্যের বিষয়। পৃথিবীতে কয়জনই বা এর শ্রেষ্টা করে।
মারেফতের জ্ঞান বা আধ্যাত্বিকতা জাগরনের পদ্ধতি এবং মারেফত কিভাবে অর্জন করতে হয়।
১। পজেটিভ চিন্তা চেতনাঃ
মানুষ কর্মমুখী। কর্ম করেই মানুষকে বাঁচতে হয়। কিন্তু কর্মের মূলে রয়েছে চিন্তা চেতনা বা মনের ভাব। মানুষের প্রত্যেকটি কর্মের মূলে যেন
পজেটিভ চিন্তা থাকে। মানুষ যেন সব সময় সৎ চিন্তা করে। মানুষ যেন সবসময় নিজের সার্থের কথা চিন্তা না করে পরার্থে নিজেকে বিলিয়ে দেয়। মানুষের কোন কর্ম বা চিন্তাই যেন তার নিজের স্বার্থের জন্য না হয়। মানুষ যেন অসৎ চিন্তা থেকে দূরে থাকে। কারন মানুষের মনের প্রিত্যেকটি চিন্তাই মনের মধ্যে স্তরে স্তরে জমা হতে থাকে। আর স্তরে স্তরে জমাকৃত পজিটিভ চিন্তার সমষ্টি যদি অধিক পরিমান হয় তবেই মানুষের মনের মধ্যে আস্তে আস্তে আধ্যাত্বিকতা জাগরিত হতে শুরু করে।
২। ধ্যানঃ
আধ্যাত্বিক জাগরনের জন্য ধ্যান হচ্ছে অন্যতম শক্তিশালী পদ্ধতি। সৃষ্টির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যত মহাপুরুষ পৃথিবীতে এসেছেন তাদের জীবনী থেকে জানা
যায় যে তারা প্রত্যেকেই জীবনের কোন না কোন সময়ে ধ্যান সাধনা করেছেন। যেমন ইসলাম ধর্মের প্রচারক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) একটানা ১৫ বছর হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যান সাধনা করেছেন। বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারক গৌতম বুদ্ধ সারাজীবন ধ্যান সাধনা করেছেন। হিন্দু ধর্মের গীতাতে ধ্যান সাধনার উপরেই সবছেয়ে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মোট কথা আধ্যাত্বিকতা জাগরনের সবছেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হচ্ছে ধ্যান। ধ্যানের দ্বারাই মানুষ তার নিজের মধ্যে আধ্যাত্বিক জাগরন ঘটাতে পারে।
৩। নিজেকে প্রকৃতিতে বিলিন করে রাখাঃ
এমন ভাবে জীবন যাপন করা যেন জীবনে নিজের কোন ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা না থাকে। সবই যেন প্রকৃতির ইচ্ছা।প্রকৃতির ইচ্ছায় যেন আমরা বেছে আছি। আমার বাড়ী আমার গাড়ী এগুলো যেন কিছুই আমার নয়। এগুলোর প্রতি যেন আমার আধিক মায়া বা আকর্ষন না থাকে। আমার বলতে যেন কিছুই নাই। আমি যেন অল্প কয়েকদিনের জন্য এখানে এসেছি। এভাবেই প্রকৃতির কাছে নিজেকে সোপর্দ করতে হবে।এভাবেই নিজের ইচ্ছা আকাঙ্খাকে প্রকৃতির কাছে বিলিন করে দিতে হবে, তবেই মনের মধ্যে আস্তে আস্তে আধ্যাত্বিকতা জাগরিত হবে।
৪। শ্বাস-প্রশ্বাস এর অনুসরনঃ
জন্ম লগ্ন থেকেই আমরা মনের আজান্তে প্রতিনিয়ত শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ে চলছি। এই শ্বাস প্রশ্বাস আদান প্রদান আমাদের জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে ঘটতে থাকে। শ্বাস প্রশ্বাস এর সাথে মনের ভাবের সম্পর্ক রয়েছে। আর মনের ভাবের সাথে আধ্যাত্বিকতার সম্পর্ক রয়েছে। আর যখনই শ্বাস প্রশ্বাস এর অনুসরন করবেন তখনই মন অন্য বিষয় ভাবনা থেকে বিরত হতে শুরু করবে। তখন মন আত্মমুখী হবে।
এভাবে মনকে বাহিরের ভাবনা থেকে আত্মমুখী করে তুললে আস্তে আস্তে আধ্যাত্বিকতা জাগরিত হতে শুরু করবে। প্রশ্ন আসতে পারে এটা আপনি কখন করবেন? আপনি প্রতিদিন যে কোন সময় এটা করতে পারেন। যত বেশি করবেন তত ভালো। পারলে সারা দিনই করতে পারেন। কারন এটাতে কাজের কোন ব্যাঘাত ঘটেনা।
৫। গুরু ধ্যান
গুরু ধ্যান হলো মারেফত জাগরনের আরেকটি অন্যতম পদ্বতি। যুগ যুগ ধরে গুরু ধ্যান এর মাধ্যমে তাপসগন আধ্যাতিকতা জাগরন করে আসছেন। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে গুরু ধ্যান পদ্বতি খুবই জনপ্রিয়। বিশেষ করে ইন্ডিয়াতে এর প্রচলন সবছেয়ে বেশি। খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তি বু আলীশাহ কলন্দর, আমির খছরু নিজামুদ্দিন আউলিয়া সবাই গুরু ধ্যান এর মাধ্যমে আধ্যাতিকতার উচ্চ শিখরে আরোহন করেছিলেন। আবার মধ্যপ্রাচ্যে ও যে সব মহাপুরুষ আধ্যাতিকতার উচ্চ শিখরে পৌছেছিলেন তারা ও এ পদ্বতির মাধ্যমে উচ্চ শিখরে পৌছেছিলেন। আব্দুল কাদের জিলানী,জালাল উদ্দিন রুমি,ইমাম গাজ্জালী তাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের লালন সাঁই লিখাতে গুরুবাদ এর ধারনা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
ডাঃ শাহীনূর আহমেদ চৌধুরী ( শাহীন শাহ্ ) – আধ্যাত্বিক সাধক।
শেখ ফরীদউদ্দীন আত্তার
শেখ ফরীদউদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ এর পরিচিতিঃ হযরত শেখ ফরীদউদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ -এর আসল নাম মুহাম্মদ ইবনে আবুবকর ইব্রাহীম। ফরীদউদ্দীন তাঁর ডাক নাম। ‘আত্তার’ ছদ্মনামে তিনি কাব্য সাধনা করতেন। এক সময় আতরের ব্যবসা করতেন বলে মুসলিম দুনিয়ায় তিনি ফরীদউদ্দীন আত্তার নামেই পরিচিত।
তাঁর জন্ম ৫১৩ হিজরী সনে। অবশ্য সন-তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। মধ্য এশিয়ার সুপ্রসিদ্ধ নিশাপুরে তাঁর জন্ম। তাঁর মৃত্যু সম্বন্ধে ঐতিহাসিকগণ মােটামুটি একমত। চেঙ্গিস খাঁর বাগদাদ আক্রমণের সময় এক তাতারীর হাতে তিনি নিহত হন। বাল্য ও কৈশাের জীবনে লেখাপড়া সম্পন্ন করে তিনি ওষুধের ব্যবসায় নিয়ােজিত হন।
এই সময়ের একটি ঘটনায় তাঁর জীবনধারার আমূল পরিবর্তিত হয়ে যায়। একদিন তিনি তার দোকানে কর্মব্যস্ত এক ভিক্ষুক এসে দোকানে ভিক্ষা প্রার্থনা করেন। ব্যস্ততার দরুন তিনি কোন রূপ সাড়া না দেওয়ায় তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ভিক্ষুক আরও জোরে দ্বিতীয়বার ভিক্ষার দাবী জানায়। কিন্তু তাতেও কোনও ফল হল না। তখন হতাশ হয়ে ভিক্ষুক বললেন, সামান্য পয়সা খরচ করতে তুমি এত কুণ্ঠিত। না জানি প্রিয় প্রাণটা দেওয়ার ব্যাপারে তুমি কিরূপ কর। ভিক্ষুকের কথাটি এবার কানে যায় ফরীদউদ্দীনের। বিরক্ত হয়ে বললেন, তুমি যেমন ভাবে প্রাণ দিবে, আমিও তেমন ভাবেই দিব?, বটে! ভিক্ষুক বলল, আমি যেভাবে দিব, তুমিও সেভাবেই দিবে? দেখা যাক, বলে সে তৎক্ষণাৎ তার কাঁধের ঝুলি মাথার নিচে দিয়ে মাটির ওপর শুয়ে পড়ে বার বার কলেমা তাইয়্যেবা, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আবৃত্তি করতে থাকে। আর ঐ অবস্থাতেই সে মারা যায়।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলেন ফরীদউদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ। ভিক্ষুকের দাফন কাৰ্য শেষ করে তিনি তার ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় জিনিসপত্র মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে সংসার বিরাগী হয়ে যান। প্রচুর ভাবান্তর সৃষ্টি হয় তার মনে। মানসিক প্রশান্তির সন্ধানে তিনি হাজির হন হযরত রুকনুদ্দীন আফাক রহমাতুল্লাহ-এর দরবারে। তার কাছেই তিনি মারেফাত জ্ঞানের পাঠ গ্রহণ করেন। পরে হজ্জ যাত্রায় মক্কা শরীফে গিয়ে সেখানে তরীকতের শিক্ষায় আত্মনিয়ােগ করেন। অবশেষে হযরত শেষ আজদুদ্দীন বাগদাদী রহমাতুল্লাহ-এর কাছে মারেফাত জ্ঞানে দীক্ষিত হন। আর সেখানে বেশ কিছুদিন অবস্থান করে উচ্চ তত্ত্ব-জ্ঞানের অধিকারী হন।
তার মৃত্যু সম্পর্কে যা জানা যায়, তা এরকম- তাতারী দস্যুরা নিশাপুর আক্রমণ করে সেখানে অবাধ লুণ্ঠন ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। হযরত ফরীদউদ্দীনও তাদের আক্রমণের শিকার হন। এক তাতারী যখন তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত, তখন কোন একজন বললেন, এ দরবেশকে হত্যা না করে, তার বদলে আমার কাছ থেকে দশ হাজার মোহর নাও। সঙ্গে সঙ্গে ফরীদউদ্দীন বলে ওঠেন, মাত্র দশ হাজার মােহরের বিনিময়ে আমাকে বিক্রি করাে না। আমার পাপ যে এর চেয়েও অনেক বেশী। আততায়ী প্রলুবন্ধ হয়ে উঠল। আরও বেশী অর্থ পাওয়ার লােভে সে তাকে নিয়ে পথে চলল।
কিছুদূর যাওয়ার পর অন্য একটি লোেক তাকে বন্দী অবস্থায় দেখে তাতারীকে বলল, তুমি হযরতকে হত্যা না করে আমাকে দিয়ে দাও। আমি তােমাকে এক বােঝা খড় দিচ্ছি। এবার ফরীদউদ্দীন বললেন, হ্যা, তাই দাও। আমার দাম এর চেয়েও কম। তাতারী বুঝল, তামাসা করা হচ্ছে। রাগে উত্তেজনায় ক্ষিপ্ত হয়ে সে তখনই তাকে এক কোপে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলল “এভাবে দস্যুরা মানুষের ইতিহাসে চির কলঙ্কিত হয়ে থাকল। অপর দিকে, যুগ যুগান্তের জন্য আলােকময় উজ্জ্বল পুরুষ হিসেবে মানুষের হৃদয়ে ও ইতিহাসের খাতায় বেঁচে রইলেন হযরত ফরীদউদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ।
বিখ্যাত মসনবী শরীফে বিশ্বনন্দিত মরমী কবি আল্লামা হযরত জালালুদ্দীন রুমী রহমাতুল্লাহ শেখ আত্তারের প্রতি অফুরন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেছেন। এমনকি, তার একটি কবিতাও সংকলিত করেন মসনবী শরীফ গ্রন্থে।
হযরত ফরীদউদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ সম্পর্কে হযরত জালালুদ্দীন রুমী বলেন, দেড়শাে বছর পর আল্লাহ পাক তার ওপর আপন জ্যোতি অবতীর্ণ করেন। পারসিক কবি আল্লামা জামী বলেন, শেখ ফরীদউদ্দীনের বাক্যে অহাদানিয়াতের যে মাহাত্ম্য ও মারেফাতের গুঢ় রহস্যের সন্ধান পাওয়া যায়, তা অন্য কোন সুফী কবির কবিতায় মেলে না।
কেউ কেউ বলেন, তার রচিত পদ্য ও গদ্য গ্রন্থের সংখ্যা একশাে চৌদ্দ- কুরআন শরীফের সূরার সমসংখ্যক। এ বিষয়ে গাজী নূরুল্লাহ শােস্তরী হিমাতুল্লাহ-ও তাঁর রচিত গ্রন্থ মাজালেসুল মুমিনীনে অনুরূপ মত পােষণ করেন। তার রচিত তাযকিরাতুল আউলিয়া, মানতিকততায়ির, মুসবিততনামা, আসরারনামা, তাইসিরনামা, ইলাহীনামা, পেন্দেনামা, অসিয়ত, দীউয়ান, শারহুল কলব, খুশরুগােল খুবই উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ। এইসব গ্রন্থ সারা বিশ্বে বিপুলভাবে আজও সমাদৃত হয়। এগুলির জনপ্রিয়তা কল্পনাতীত। বহু গ্রন্থকার বই কাটতির জন্য নিজের নামের বদলে শেখ ফরীদউদ্দীন রহমাতুল্লাহ-এর নাম ব্যবহার করেছেন, এও এক অভিনব ঘটনা বৈকি। নকল। শেখ ফরীদউদ্দীন রহমাতুল্লাহ-এর গ্রন্থের মধ্যে একখানি হল লিসানুল হাকীকত- যা এখনও লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সুরক্ষিত আছে।
“তাযকিরাতুল আউলিয়া গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি যা লিখেছেন, তাতে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিসত্তার স্বরূপ উপলব্ধি করা যায় অনায়াসে। নম্রতা ও বিনয়ের সে এক উজ্জ্বল প্রতিবিম্ব ছিলেন তিনি। নিজেকে অত্যন্ত দীন, হীন ও নিকৃষ্ট বলে মনে করতেন তিনি। আর সে কারণেই তত্ত্ব-জ্ঞানী ও আল্লাহ-প্রেমী হিসেবে মানুষের মনে তিনি চিরজাগরুক হয়ে রয়েছেন এবং থাকবেন।
তাঁর রচিত গ্রন্থের বিষয়বস্তু ও রচনাশৈলীও অভিনব। সর্বপ্রথমে উচ্চারিত হয়েছে মহান আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূলের প্রশংসা ও প্রশান্তি। পরের বিষয়ে এসেছে খােলাফায়ে রাশেদীনের খ্যাতি-সুখ্যাতি। তারপর শুরু হয়েছে আসল বক্তব্য। কিন্তু ভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা। কাহিনীর নায়কেরা উপস্থাপিত হয়েছে পাখি রূপে। যেমন, হুদহুদ, তােতা, মােরগ, পায়রা, শানা, বুলবুল, বাজ ইত্যাদি।
কাহিনীর অবতারণা করা হয়েছে পাখিদের নিয়েই। যেমন- উল্লিখিত পাখি একদিন এক সভায় মিলিত হয়ে নিজেদের মধ্য থেকে একজন বাদশাহ নির্বাচন করার ইচ্ছা প্রকাশ করল এ.পদের জন্য সর্বপ্রথম ছী মােরগের নাম প্রস্তাব করল হুদহুদ পাখি। কিন্তু তার প্রস্তাবে কেউ রাজি হল না। কার কী আপত্তি, তাও তারা খুলে বলল। আর প্রত্যেকের বক্তব্য গভীর মনােযােগের সঙ্গে শুনে গেল হুদহুদ। তারপর, একে একে সকলের কথা খণ্ডন করল। তখন সর্বসম্মতি ক্রমে হী মােরগকেই তারা তাদের বাদশা নির্বাচিত করল। তারপর তার কর্মধারা সম্পর্কিত বিষয়গুলিকে গ্রন্থকার প্রশ্নোত্তরের ভঙ্গিতে উপস্থাপিত করেছেন। সাধারণতঃ তরীকতপন্থীদের মনে যে বিষয়গুলি জেগে ওঠে, সেগুলিকেই তিনি সংশ্লিষ্ট করেছেন এ গ্রন্থের মাঝে। এ ধরনের একখানি গ্রন্থ হল ‘মানতিকুত তায়ির’। পবিত্র কুরআনের সূরা নমল থেকে গ্রন্থখানির নাম চয়ন করা হয়েছে। | কুরআনে হুদহুদ পাখির উল্লেখ আছে। হযরত সুলায়মান (আঃ)-এর প্রিয় পাখি হুদহুদ । বুঝতে পারা যায়, বুদ্ধিমত্তায় হুদহুদ পাখিই পক্ষিকুল শিরােমণি। আর হযরত ফরীদউদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ-ও তাঁর রচনামালায় হুদহুদকে এক বুদ্ধিদীপ্ত পাখি হিসেবে চিত্রিত করেছেন। পাখি নয়, যেন এক তত্ত্ব-জ্ঞানী হিসাবে কথা বলছেন।
কবিতা রচনার ব্যাপারেও তিনি সমকালের বহু কবিকে ছাড়িয়ে গেছেন। যাঁকে অদ্বিতীয় বলা চলে। কেউ কেউ ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রশ্নে তাঁর সম্বন্ধে দ্বিমত পােষণ করেন। কিন্তু তাঁর জীবন ও সাহিত্য ছিল সম্পূর্ণ সংশয়মুক্ত ও সুন্দর তত্ত্বজ্ঞানে ভরপুর। | এ গ্রন্থ রচনা প্রসঙ্গ তাযকিরাতুল আউলিয়া’র গ্রন্থণা সম্পর্কে হযরত ফরীদউদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ আল্লাহ পাকের এবং তার পরে রাসূলে করীমের প্রতি প্রশংসার পর লিখেছেন, পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফের পরে সাধক দরবেশগণের কালামই সবচেয়ে বেশী মর্যাদাশীল। কেননা সেগুলি আল্লাহর প্রেমের প্রাচুর্যে উজ্জ্বল, পার্থিব কলুষতা তাদের স্পর্শ করে না বলেই তারা সর্বজন মান্য বলে আমি মনে করি। সাধকগণের মধ্যে কেউ মারেফাতপন্থী, কেউ আল্লাহ প্রেমিক। কেউ কেবল একত্ববাদী। আবার কারও মধ্যে হয়তাে সব বৈশিষ্ট্যগুলিই বিদ্যমান। কারও মধ্যে হয়তাে বা রয়েছে সাধারণ ধরনের নিম্নস্তরের গুণাবলী।
যাই হােক, এই মহান প্রেমিকদের কাহিনী রচনার পেছনে তিনি কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। যেমন, তিনি মনে করেন, কাজটি ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এগুলি পাঠ করে পাঠকের জ্ঞানের প্রসারতা যদি বৃদ্ধি পায়, তবে তার লেখকের জন্য শুভকামনা জানাবেন। আর তাতে তার কবরও প্রশস্ত হতে পারে। একে নাজাতের ওসিলাও করা যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
যেমন- বুআলী দাক্কাককে প্রশ্ন করা হয়, মহান তাপসগণের প্রত্যক্ষ উপদেশ যখন পাওয়া যায় না, তখন তাঁদের বাণী কোন মাধ্যম দ্বারা শুনে কি উদ্দেশ্য পূরণ হতে পারে?
তিনি ইতিচাচক উত্তর দিয়ে বলেন, মহৎ লােকদের ঘটনা শুনলে শ্রোতার মনে সৎ সাহস ও আল্লাহর প্রতি আসক্তি বৃদ্ধি পায়। অহমিকা দূর হয়। ন্যায়-অন্যায় বিচারবােধ জাগে। কোনটি ভালাে, কোনটি মন্দ তা তার চোখ দেখতে পায়।
শেখ মাহফুজ রহমাতুল্লাহ রলেন, নিজের মানদন্ডে কাউকে বিচার করাে না। বরং আউলিয়াদের মানদন্ড ব্যবহার কর। তবেই তাদের মহত্ব ও নিজের ক্ষুদ্রত্ব উপলব্ধি করতে পারবে। |
জুনায়েদ বাগদাদী রহমাতুল্লাহ-কে প্রশ্ন করা হয়, সাধক দরবেশের গল্পগাথা শুনে বিশেষ কি উপকার হয়? বাগদাদী রহমাতুল্লাহ বলেন, এদের পবিত্র বাণীগুলি আল্লাহর সৈন্যের ন্যায়। এগুলি দুর্বল মনকে সবল করে। অন্তরে সাহস এনে দেয়। পাঠক এগুলি থেকে সাহায্য পায়। কুরআন শরীফে আল্লাহ বলছেন, হে মুহাম্মদ! আমি আপনার কাছে নবী-রাসূলের কাহিনী বলছি। এতে আপনার মনে শক্তি ও সাহসের সঞ্চার হবে এবং আপনি মনে শান্তি লাভ করবেন।
হযরম মুহাম্মদ (সঃ) বলেন, ধার্মিক ও ওলীদের জীবন কাহিনী আলােচনা মাহফিলে আল্লাহর রহমত অবতীর্ণ হয়। আর এ রহমত প্রাপ্তির আশায় যদি কেউ দপ্তর বিছিয়ে দেয়, তবে যতদূর সম্ভব তিনি বিফল হবেন না।
এই বিপর্যয়ের যুগে তাপসগণের জ্যোতির্ময় জীবন মানুষকে সাহায্য করে। মৃত্যুর পূর্বে সৌভাগ্য অর্জন করে ধরাধাম থেকে বিদায় নেওয়া সম্ভব হয়।
হযরত ফরীদউদ্দীন রহমাতুল্লাহ বলেন, আমি যখন কুরআন-হাদীসের পর তাপসগণের বানীকে উত্তম এবং কুরআন-হাদীস অনুযায়ী তাদেরকে উত্তম বন্ধুরূপে দেখতে পেলাম, তখন তাদের জীবনালেখ্যর বিষয় আলােচনা করতে আত্মনিয়ােগ করলাম। যদিও আমি তাদের সমপর্যায়ভুক্ত নই, তবুও তাদের এই কাজকে ব্রত হিসাবে গ্রহণ করলাম। কেননা হাদীসে রয়েছে, যে লােক যে দলের অনুসরণ করে, সে রােজ কিয়ামতে সে দলেরই অন্তর্ভুক্ত হবে।
হযরত জুনায়েদ রহমাতুল্লাহ বলেন, যে নিজেকে হাকীকত-পন্থী বলে প্রকাশ করে, তুমি তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখ, তার চরণধুলি গ্রহণ কর। কেননা, তার মনে যদি এ ব্যাপারে সাহস না থাকত, তাহলে সে এই দাবী না করে অন্য যে কোন বস্তুর দাবী করত।
হযরত আত্তার রহমাতুল্লাহ বলেন, পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ অনুধাবন করা জটিল ব্যাপার। তবে সাধক দরবেশগণের জীবন-কাহিনী তা বােঝার জন্য ভাষ্য গ্রহের কাজ করে। অতএব, তাযকিরাতুল আউলিয়া’ নামক এ গ্রন্থখানি ইরান, ইরাক ও তুরস্কসহ বিরাট এলাকার ভাষাভাষীদের জন্য ফারসী ভাষায় রচনা করা হল।
একটি সাদী নীতি হল, কেউ কারও ইচ্ছা-বিরােধী কথা বললে সে তার ওপর এমন বিরক্ত হয় যে, রাগের বশে তাকে মেরে ফেলতেও পারে অথচ, কথাটা মিথ্যে। এখন সহজেই ধরে নেওয়া যায়, একটি, মিথ্যে কথার যদি প্রভাব থাকে, তাহলে সত্য কথার প্রভাব শতগুণ বেশী হবে। আউলিয়াদের জীৱন-কাহিনী শততায় সমৃদ্ধ। অতএব, এর দ্বারা মানুষ পুরােপুরি প্রভাবিত হবে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
তিনি আরও বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে মনে এই আশা পােষণ করে আসছি যে, সাধক-দরবেশগণের, আলােচনা ছাড়া আর কোন আলােচনা শুনব না ও হযরত বুআলী রহমাতুল্লাহ বলেছেন, আমার দুটি ইচ্ছা। এক, কুরআন পাকের আলােচনা শােনা, দুই, পূণ্যবান লােকের সাক্ষাৎ লাভ করা। যেহেতু আমি এখনও সম্পূর্ণ, লিখতে পড়তে বলতে জানি না; আমি এমন লােকের খোঁজ করি, যে আমাকে আল্লাহর ওলীদের কথা বলবে, আর আমি তা নীরবে শুনে যাব। অথবা, আমি তাদের কথা বলব, সে তা চুপচাপ শুনবে। এছাড়া আমার আর কিছুই কাম্য নয়।
সত্য বলতে কি, যদি জান্নাতেও তাদের বিষয়ে আলােচনা না হয়, তাহলে অধম বুআলী তেমন জান্নাত লাভেও প্রত্যাশী নয়। হযরত আত্তার রহমাতুল্লাহ বলেন, আমারও মনের এই কথা। হযরত ইউছুফ হামদানী রহমাতুল্লাহ-কে একবার জিজ্ঞেস করা হয়, এ যুগ চলে গেলে আল্লাহর ওলীগণ যখন দুনিয়া থেকে বিদায় নেবেন, তখন আমরা কি নিয়ে থাকব, বা তখন আমাদের অবলম্বন কি হবে, আমরা মনকে সান্ত্বনাই বা দেব কিসের, দ্বারা? তিনি জবাব দেন, এঁদের জীবনীগ্রন্থ থেকে প্রতিদিন কিছু কিছু পাঠ করবে। আর এসব নিয়ে আলাপ-আলােচনা করে দিন কাটাবে।
শেখ ফরীদউদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ বলেন, ওলী-আউলিয়াগণের প্রতি আমার আকর্ষণ, শ্রদ্ধা ও ভক্তি ছেলেবেলা থেকেই। তাদের অমূল্য বাণী মনে শান্তি ও তৃপ্তি দেয়। নিয়ম হল, মানুষ তার প্রিয়জনের সান্নিধ্য চায়। আর তা সম্ভব না হলে, তার আলাপ-আলােচনায় মগ্ন থাকতে চায়। এটা মানুষের চিরন্তন রীতি। বলা বাহুল্য, এরই ভিত্তিতে আমি তাপসজীবনের ওপর এই গ্রন্থ রচনা করলাম। বিশেষ করে, যুগটাও এমন, যখন আল্লাহর প্রিয়জনদের বাণী অবলুপ্তপ্রায়।
তাছাড়া কিছু কিছু লােককে সাধক-দরবেশের বেশে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু প্রকৃত ওলী একেবারেই দুর্লভ। এই পরিপ্রেক্ষিতে হযরত জুনায়েদ রহমাতুল্লাহ, একদা আল্লামা শিবলী রহমাতুল্লাহ-কে বলেন, ‘দেখ ! তামাম দুনিয়া খোঁজ করে কোন প্রকৃত ওলী পাও কিনা। পেলে কথা নেই, সঙ্গে সঙ্গে তাকে ভালাে করে ধরে থাক।
হযরত শেখ ফরীদউদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ আরও বলেন, আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি এ যুগে মানুষ অতিমাত্রায় পাপাসক্ত হয়ে আল্লাহর ওলীদের একেবারে ভুলে যাচ্ছে। এইজন্য তাদেরই স্মরণার্থে এই গ্রন্থ রচনা করে আমি এর নাম দিলাম ‘তাযকিরাতুল আউলিয়া” অর্থাৎ তাপস স্মরণিকা- যেন বিপথগামী মানুষ এ গ্রন্থ পাঠ করে তাদের কথা স্মরণ করে ও তাদের রীতিনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নিজেদের কল্যাণ সাধন করতে পারে। | দরবেশদের জীবন-কাহিনীও মানুষের কিছু উপকার করে। যেমনঃ
(১) তাঁদের অমূল্যবাণী মানুষের মন থেকে পার্থিব লােভ, মােহ ও ভালােবাসা দূর করে।
(২) পরকালের চিন্তা-ভাবনাও দূরীভূত হয়।
(৩) হৃদয়ে আল্লাহ প্রেমের সৃষ্টি হয়।
(৪) তাদের কাহিনী শুনে মানুষ পরকালের সম্বল লাভে তৎপর হয়।
(৫) আল্লাহর প্রতি প্রেম-বেদনায় পূর্ণ আল্লাহপ্রেমীদের হৃদয়গুলির বাস্তব রূপটি উপলব্ধি করা যায়।
হযরত শেখ ফরীদউদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহ বলেন, আমি একান্তভাবে আশা করি যে, রােজ কিয়ামতে আল্লাহ এই ‘তাযকিরাতুল আউলিয়া গ্রন্থখানির বদৌলতেই হয়তাে আমাকে নাজাত দেবেন। সব রকমের নৈরাশ্যের মাঝেও অন্ধকারে হয়তাে মুক্তির আলাে দেখাবেন।
শেষ কথা’। সবশেষে তিনি দয়াময় দাতা আল্লাহ পাকের দরবারে প্রার্থনা জানান, হে প্রভু! আপনি আপনার নবী-রাসূল ও তাঁর প্রিয় তাপস-তাপসীগণের উসিলায় আপনার মনােনীত পূণ্যবানদের থেকে এ অধম দাসকে দূরে সরিয়ে রাখবেন না, আপনার অনুগ্রহ-দৃষ্টি থেকে বঞ্চিতও করবেন না।
করুণাময় প্রভু আমার! আমি আপনার প্রিয় বন্ধুগণের এক অধম দাস। আপনার দরবারে তার কাতর প্রার্থনা, আপনি তার এ গ্রন্থখানাকে আপনার দীদার লাভের উসিলা করে দিন। প্রভু গাে, জানি আপনি প্রার্থনা কবুলকারী । আল্লাহুম্মা আমীন, সুম্মা আমীন!
আবু হামিদ আল-গাজ্জালি (রহঃ)
আবু হামিদ আল-গাজ্জালীঃ ইমাম গাযালী (র)-এর নাম মুহাম্মাদ। ডাকনাম আবু হামেদ। পিতার নামও মুহাম্মাদ ছিল। তুস জেলায় ৪৫০ হিজরীতে তাহিরান নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার ওসিয়ত মুতাবেক তাঁর এক বন্ধু—যিনি একজন একনিষ্ঠ ‘ইলম-দোস্ত ও সূফী গরীব মুসলমান ছিলেন-তাঁর শিক্ষার বন্দোবস্ত করতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন এবং তাকে কোন মাদরাসায় ভর্তি হবার পরামর্শ দেন। অনন্তর তিনি একটি মাদরাসায় ভর্তি হয়ে শিক্ষা অর্জনে আত্মনিয়ােগ করেন।
ইমাম গাযালী (র) স্বদেশে শায়খ আহমাদ আর-রাযেকানীর নিকট থেকে শাফিঈ মযহাবের ফিকাহশাস্ত্রে তা’লীম হাসিল করেন। এরপর জর্দানে ইমাম আবু নসর ইসমাঈলীর নিকট পড়াশুনা করেন। এরপর নিশাপুর গিয়ে ইমামুল হারামায়নের মাদরাসায় ভর্তি হন এবং অতি অল্পদিনেই তিনি তার ৪০০ সহপাঠীর মধ্যে একটি বিশিষ্ট আসন লাভ করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর খ্যাতিমান উস্তাদের সহযােগী (নায়েব)-তে পরিণত হন, এমন কি ইমামুল-হারামায়ন তার সম্পর্ক বলতেন, “গাযালী (র) হলেন গভীর সমুদ্র।” ইমামুল-হারামায়ন-এর ইনতিকালের পর তিনি নিশাপুর থেকে বহির্গত হন। সে সময় তাঁর বয়স ছিল ২৮ বছর, অথচ তখনাে তাকে বড় বড় বর্ষীয়ান ‘উলামা’র চেয়ে অধিকতর বিশিষ্ট ও কামালিয়তের অধিকারী মনে করা হত।
এর পর ইমাম গাযালী (র) নিজামুল-মুলকের দরবারে যান। তাঁর খ্যাতি ও বিশেষ যােগ্যতার কারণে নিজামুল-মুলক তাকে অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধা সহকারে দরবারে গ্রহণ করেন। এখানে ছিল দুর্লভ রত্নসম। জ্ঞানী-গুণীদের সমাবেশ। জ্ঞানের আলােচনা ও ধর্মীয় মুনাজারা (বিতর্ক) তখনকার দরবার, মজলিস, এমন কি বিবাহানুষ্ঠান ও শােক সভারও একটি অপরিহার্য অঙ্গ ছিল। ইমাম গাযালী (র) যাবতীয় বিতর্ক আলােচনায় সকলের ওপর জয়ী হতেন। তাঁর অতুলনীয় যােগ্যতাদৃষ্টে নিজামুল-মুলক তাঁকে নিজামিয়া মাদরাসার অধ্যক্ষ হিসাবে মনােনীত করেন, যা ছিল সে যুগে একজন ‘আলিমের জন্য সম্মান ও মর্যাদার সর্বোচ্চ সােপান। সে সময় গাযালীর বয়স ৩৪ বছরের বেশী ছিল না।
৪৮৪ হিজরীতে তিনি বিরাট শান-শওকতের সঙ্গে বাগদাদে প্রবেশ করেন এবং নিজামিয়ায় পাঠ দান শুরু করেন। অল্পদিনেই তাঁর যােগ্য শিক্ষকতা, উত্তম আলােচনা ও জ্ঞানের গভীরতার কথা সারা বাগদাদে ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্র- শিক্ষক ও জ্ঞানী-গুণী তার বিদ্যাবত্তা থেকে উপকৃত হবার জন্য চতুর্দিক থেকে নিজামিয়ায় এসে ভীড় জমাতে লাগল। তার দরূস-মাহফিল গােটা মনুষ্যকুলের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়। তিন শ’র মত সমাপ্ত পর্যায়ের ছাত্র, শত শত আমীর-উমারা’ ও রঈস এতে শরীক হতেন। ক্রমে ক্রমে তার উন্নত মস্তিষ্ক ও মেধা, ইলমী ফযীলত ও শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব বাগদাদে এমন প্রভাব-প্রতিপত্তি সৃষ্টি করে যে, তিনি সাম্রাজ্যের নেতৃস্থানীয় সদস্যবর্গের সমমর্যাদা লাভ করেন।
তাঁর সম্পর্কে তাঁর সমসাময়িক শায়খ আবদুল গাফির ফারসী বলেন, “তার জাকজমক ও আড়ম্বরের সামনে আমীর-উমারা’, উযীর, এমন কি স্বয়ং দরবারে খিলাফতের শান-শওকত পর্যন্ত নিষ্প্রভ হয়ে যায়। এমনি সময়ে ৪৮৫ হিজরীতে তাকে ‘আব্বাসী খলীফা মুক ‘তাদী বিল্লাহ মালিক শাহ সালজুকীর বেগম তুর্কান খাতুনের নিকট (যিনি সে সময় সাম্রাজ্যের হর্তা-কর্তা ছিলেন) স্বীয় দূত বানিয়ে পাঠান। খলীফা মুক ‘তাদী বিল্লাহর স্থলাভিষিক্ত খলীফা মুস্তাজহির ইমাম গাযালী (র)-এর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রাখতেন এবং তার একনিষ্ঠ ভক্ত ও অনুরক্ত ছিলেন। তারই নির্দেশে ইমাম গাযালী (র) বাতেনী মতবাদের বিরুদ্বে কিতাব লিখেন এবং খলীফার সঙ্গে সম্পর্কিত করে এর নাম রাখেন ‘মুস্তাজহিরী।
এগার বছরের চলমান জীবন এবং এর অভিজ্ঞতা:
এই চরম উন্নতি ও উত্থানের স্বাভাবিক দাবি ছিল যে, ইমাম গাযালী (র) এতে তৃপ্তি লাভ করবেন এবং এই বৃত্তের মাঝেই তিনি তার গােটা জীবন কাটিয়ে দেবেন, যেমনটি তার কতক উস্তাদ করেছেন। কিন্তু তার অস্থির স্বভাব ও প্রকৃতি, উন্নত মনােবল, দুরন্ত সাহসিকতা উন্নতির এই চরম পর্যায়েও তাকে সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত রাখতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে এই উন্নত মনােবল ও হিম্মতই তাঁকে ইমাম’ ও ‘হুজ্জাতুল-ইসলাম বানিয়েছিল। দুনিয়াতে জাঁকজমক, আড়ম্বর, সম্মান ও পদবীর কুরবানী এবং স্বীয় উদ্দেশ্যের প্রতি একাগ্রতা ও সত্যের প্রতি আকর্ষণের এমন দৃষ্টান্ত বিরল। ইমাম গাযালী (র) স্বয়ং সেসব অবস্থা ও কার্যকারণ বর্ণনা করেছেন যা তাকে এমন পদক্ষেপ গ্রহণে উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং যা তাকে টেনে বের করেছিল শিক্ষা ও দরস প্রদানের কাজ থেকে। যা হােক, শেষ পর্যন্ত তিনি জ্ঞান রাজ্যের বাদশাহী ছেড়ে নিশ্চিত জ্ঞান ও ইন্দ্রিয়াতীত সম্পদের তালাশে বেরিয়ে পড়েন এবং স্বীয় লক্ষ্যে কামিয়াবী লাভ করেন। ‘Al-Munkiju Minaddalal” নামক গ্রন্থে তিনি এ সম্পর্কে লিখেছেন :- বিস্তারিত পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
মাইজভান্ডারী জীবন কাহিনী- বানী ও কারামত
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (রহঃ)।।।
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (রহঃ)। মাইজভান্ডারী তরীকার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি । তিনি জন্ম গ্রহন করেন (রহঃ) বাংলা ১২৩৩ এবং ১৮২৬ সালের ১লা মাঘ মাইজভান্ডার শরীফে । তিনি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)এর বংশধর ছিলেন। তার পিতা ছিলেন সৈয়দ মতিউল্লাহ (রহঃ) এবং মাতা ছিলেন সৈয়দা খায়রুন্নেছা বিবি (রহঃ)। চার বছর বয়সে নিজ গ্রামের মক্তবে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। অতঃপর তিনি কলকাতায় চলে যান এবং ১২৬৮ হিজরি সনে তিনি কলকাতায় তার শিক্ষাজীবন শুরু করেন। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সহিত শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১২৬৯ হিজরি সালে তিনি যশোর জেলায় যান এবং সেখানে তিনি কাজী পদে যোগদান করেন। ১২৭০ হিজরিতে তিনি কাজী পদ থেকে পদত্যাগ করে কলকাতায় চলে যান এবং কলকাতায়মুন্সি বু-আলী মাদ্রাসার প্রধান মোদার্রেছের পদে নিয়োযিত হন।
শেখ সৈয়দ আবু শাহমা মুহাম্মদ ছালেহ আল কাদেরী লাহোরী (রহঃ) ছিলেন আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী(রহঃ) এর পীর। আর আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী(রহঃ) তিনি তরিকতের বড় ভাই হযরত সৈয়দ দেলাওয়ার আলী পাকবাজ (রহঃ) এঁর কাছ থেকে কুতুবিয়তের ফয়েজ অর্জন করেন। ১৮৫৭ সালে হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী তাঁর পীরে ত্বরিকতের নির্দেশে নিজ গ্রাম মাইজভান্ডারে চলে আসেন। এরপর থেকে আস্তে আস্তে মাইজভান্ডার আধ্যাত্মিক সাধক ও দোয়া প্রত্যাশীদের ভীড়ে পরিনত হয় এবং ক্রমান্বয়ে এই সাধকের বাসগৃহ মানবতার কল্যানকর এক উচ্চমার্গীয় আধ্যাত্মিক দরবারে পরিণত হয়। লোকসমাজে পরিচিতি পায় ‘মাইজভান্ডার দরবার শরীফ’ হিসেবে।
জিয়াউল হক মাইজভান্ডারীর জীবনী
গোলামুর রহমান বাবা ভান্ডারীর অলৌকিক ঘটনা বা কারামত
জিয়াউল হক মাইজভান্ডারীর ২০টি বানী
জিয়াউল হক মাইজভান্ডারীর ১৮টি বানী