প্রেম, দ্রোহ, মানবতা ও সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর ৪৫’তম শাহাদাৎ বার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রাণ পুরুষ, প্রেম দ্রোহ মানবতা ও সাম্যের অগ্রপথিক, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ক্ষূরধার লেখনী ও সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে সকল রকম অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার আর জুলুম নিপীড়নের বিরুদ্ধে ইস্পাত কঠিন প্রতিবাদের সূচনা করেছেন। তাঁর অনন্য সৃষ্টিতে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর প্রতিভাধর স্বাক্ষর রাখেননি, মানবতার আলো ছড়াননি। তিনি জালিমের জুলুমের বিরুদ্ধে মজলুমকে বিদ্রোহ করার প্রেরণা যুগিয়েছেন। তাঁর রচিত কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির ভাণ্ডারকে প্রানবন্ত ও সমৃদ্ধ করেছে। শোষণের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম তাঁকে ’বিদ্রোহী কবি’ মর্যাদায় ভূষিত করেছে।
মানব প্রেমের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। মানুষকে ভালোবেসে তাদের কল্যাণে আত্মনিবেদিত হতে তাঁর সৃষ্টিশীল রচনাশৈলী আমাদের সমগ্র জাতিকে উদ্বুদ্ধ ও বেগবান করেছে। যতদিন রবে এই ভাষা ও সাহিত্য সংস্কৃতি ততোদিন তাঁর সৃষ্টি ও সাহিত্যকর্ম আমাদেরকে স্বদেশ প্রেমে অনুপ্রাণিত করবে বলে বিশ্বাস করি।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যার গান ও কবিতা যুগে যুগে বাঙালির জীবন সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে। দাসত্ব ও গোলামীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ জাতিকে শোষণ ও উৎপীড়ন থেকে মুক্ত হবার ডাক দিয়ে তিনি লিখেছিলেন,
“বল বীর, বল উন্নত মম শির, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না -বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত”।
শুধু তাই নয় কবি নজরুল ইসলাম সব ধর্মবর্ণ ও গোত্রের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় মানবতার জয়গান গেয়েছেন। তাঁর একটি কবিতার বিখ্যাত একটি লাইন ছিল, ”মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান”। তিনি ছিলেন সব ধর্মীয় চেতনার উর্ধ্বে। তার একটি কথাতেই এটা ছিল পরিষ্কার, “জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছো জুয়া”। এ থেকেই অনুমেয় যে তিনি একজন অসামান্য প্রতিভা, অহিংস, উদার ও মহৎ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিদ্রোহী ও জাগরণের এই কবি বিশ শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে উপমহাদেশের অবিভক্ত বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাজী নজরুল ইসলামকে বর্ণনা করেছিলেন “ছন্দ স্বরসতীর বরপুত্র” হিসাবে। নজরুলের প্রতিভার যে অনন্য দিকটা ছিল সেটা হলো তার বিদ্রোহী চেতনার বহিঃপ্রকাশ। সমাজ ধর্ম রাজনীতি সব কিছুর বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ ও বিদ্রোহে তিনি সোচ্চার হয়েছেন তার সাহিত্যকর্ম ও সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে। তার কালজয়ী বিদ্রোহী কবিতাই তাকে অমর করে রেখেছে। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যর্থ অনুকরণ ও অনুসরণের কৃত্রিমতা থেকে আধুনিক বাংলা সাহিত্য ও কবিতাকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলামের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে প্রতিভাবান ও ফলপ্রসূ। তাই তিনিই রবীন্দ্রোত্তর সাহিত্যে আধুনিকতার পথিকৃৎ বলে মনে করি।
প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতা, গান ও উপন্যাসসহ অন্যান্য লেখনী ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পরাধীন ভারতে বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্য ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও সোচ্চার কণ্ঠ ছিলেন। সে কারণে ইংরেজ সরকার তার গ্রন্থ ও রচনা বাজেয়াপ্ত করে তাকে কারাদণ্ড দিয়েছিল। কারাগারেও তিনি অনশন করে বিদেশী সরকারের জেল জুলুমের, অন্যায় অবিচার ও ব্যভিচারের প্রতিবাদ করেছিলেন। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তাঁর ভূমিকার জন্য বহুবার কারাবন্দী হয়েছিলেন বিদ্রোহী এই অগ্নী পুরুষ। বন্দী অবস্থায় তিনি লিখেছিলেন, “রাজবন্দীর জবানবন্দী”। তার এইসব সাহিত্যকর্মে আধিপত্য ও সাম্রাজ্যবাদের প্রকট বিরোধিতায় তাদের মসনদ কেঁপে উঠে ছিল। তিনি নির্ভীক চেতনায় বীরত্বের অগ্নী শিখা। তিনি সততা ও সত্যাদর্শের মূর্তিমান উজ্জল দৃষ্টান্ত বলেই লিখেছেন, ” অসত্যের কাছে কভু নত নাহি হবে শির, ভয়ে কাপে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর”।
শ্রদ্ধেয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি। একাধারে তিনি কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গীতিকার, সুরকার, গায়ক, অভিনেতা, রাজনৈতিক সংগঠক ও দার্শনিক ছিলেন। তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগরাগিণী সৃষ্টি করে বাংলা সংগীত জগতকে সমৃদ্ধ ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। প্রেম, দ্রোহ, সাম্যবাদ ও জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে জাতিকে সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহী কবিতা, জ্বালাময়ী রণ সংগীত ও গান ছিল প্রেরণার উৎস। এই কবিতা, গান ও সাহিত্যকর্মই বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। তাঁর লেখনী জাতীয় জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে এবং কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে। তারই প্রেরণা ও জাগরণ জাতিকে চিরকালই মুক্তি ও স্বাধীনতার পথ দেখাবে।
বাঙালী জাতির মুক্তি ও আলোর পথ প্রদর্শক মহান কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৭৬ সালের ২৯’শে আগস্ট শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি তার কৃতকর্মের মধ্যেই চির অমর হয়ে থাকবেন। তাহার মহান কৃতকর্মের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
বহুগুণের অধিকারী প্রতিভাধর আলোকবর্তিকা এই কীর্তিমানকে আল্লাহ জান্নাতের শ্রেষ্ঠতম আসনে অধিষ্ঠিত করুন।
বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায়-
শারফিন চৌধুরী রিয়াজ।